তাওহিদের ঘোষণায় শুরু হবে ১৪৪৪ হিজরির ২১তম তারাবিহ। আজকের তারাবিহতে সুরা যুমার (৩২-৭৫) সুরা মুমিন এবং সুরা হা-মিম আস-সাজদা (১-৪৬) পড়া হবে। সে সঙ্গে ২৪তম পারার তেলাওয়াত শেষ হবে। আল্লাহ তাআলার প্রতি মিথ্যা আরোপকারীদের পরিচয়ে শুরু হবে আজকের তারাবিহ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
Advertisement
فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ کَذَبَ عَلَی اللّٰهِ وَ کَذَّبَ بِالصِّدۡقِ اِذۡ جَآءَهٗ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَهَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡکٰفِرِیۡنَ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে আর সত্য সমাগত হওয়ার পর তা অস্বীকার করে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে আছে? (এমন) কাফিরদের আবাসস্থল কি জাহান্নামে নয়?’ (সুরা যুমার: আয়াত ৩২)
আজ তারাবিহের মুসল্লিরা আল্লাহর রহমতের ওপর আস্থা রাখার প্রাণশক্তি ফিরে পাবে। কারণ আজ হাফেজে কোরআনগণ মহান রবের সে আশার বাণী ঘোষণা করবেন। আজকের তারাবিহের আলোচ্য বিষয়গুলো তুলে ধরা হলো-
Advertisement
সুরা যুমার (৩২-৭৫)
সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। সুরাতুল গোরাফ নামেও এটি পরিচিত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সুরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হলেও হজরত হামযা রাদিয়াল্লাহু আনহুর হত্যাকারী সম্পর্কিত যে তিনটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, আয়াত তিনটি মদীনায় অবতীর্ণ। এ সুরার অধিকাংশ বক্তব্য তাওহিদ সম্পর্কিত। যারা তাওহিদে বিশ্বাস করে, তাদের পুরস্কার; যারা অবিশ্বাস করে তাদের শাস্তির কথাও এ সুরায় ঘোষিত হয়েছে। মানবতার কলংক শিরক তথা অংশীবাদের বাতুলতা ঘোষণা করা হয়েছে।
কেয়ামতের দিন কাফের ও মোশরেকদের টেনেহিঁচড়ে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে আর মুত্তাকিদের জান্নাতে প্রবেশের জন্য আহ্বান করা হবে। ফেরেশতারা তাদের অভ্যর্থনা জানাবেন, তাদের খেদমতে সালাম পেশ করবেন আর তারা আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে আপন নিবাস জান্নাতে প্রবেশ করবেন। সর্বশেষ আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিবসে বান্দাদের মধ্যে ন্যায় বিচারভিত্তিক ফয়সালা করবেন। যাতে আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠত্ব, মাহাত্ম্য এবং গুণাবলী সন্নিবেশিত হয়েছে।
আজকের তারাবিহের শুরুতে হাফেজে কোরআনদের কণ্ঠে তেলাওয়াত হবে-
Advertisement
فَمَنۡ اَظۡلَمُ مِمَّنۡ کَذَبَ عَلَی اللّٰهِ وَ کَذَّبَ بِالصِّدۡقِ اِذۡ جَآءَهٗ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَهَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡکٰفِرِیۡنَ
‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে আর সত্য সমাগত হওয়ার পর তা অস্বীকার করে তার চেয়ে বড় জালিম আর কে আছে? (এমন) কাফিরদের আবাসস্থল কি জাহান্নামে নয়?’ (সুরা যুমার: আয়াত ৩২)
আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা দাবি করে যে, আল্লাহর সন্তান-সন্ততি অথবা তাঁর শরিক আছে কিংবা তাঁর স্ত্রী আছে, অথচ তিনি এই সমস্ত জিনিস থেকে পাক ও পবিত্র। যাতে আছে তাওহিদ (আল্লাহর একত্ব), (দ্বীনের) বিধি-বিধান ও ফরজ কার্যাদি, পুনরুত্থান সম্পর্কীয় আকীদা ও বিশ্বাস, হারাম কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ এবং মুমিনদের জন্য সুসংবাদ ও কাফেরদের জন্য ধমক ও শাস্তির কথা। এ হল সেই দ্বীন ও শরিয়ত, যা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়ে আগমন করেছেন। এটাকে তারা (অবিশ্বাসীরা) মিথ্যা মনে করে।
পরের আয়াতে আল্লাহ তাআলা সত্যবাদী মুত্তাকি বান্দাদের পরিচয় এভাবে তলে ধরেছেন-
وَ الَّذِیۡ جَآءَ بِالصِّدۡقِ وَ صَدَّقَ بِهٖۤ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُتَّقُوۡنَ
‘আর যারা সত্য নিয়ে এসেছে এবং সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে, তারাই তো আল্লাহ-ভীরু, মুত্তাকি।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৩৩)
এ থেকে নবিজি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। যিনি সত্য দ্বীন নিয়ে আগমন করেছেন। কারো কারো নিকট এ কথাটি সাধারণ এবং এর লক্ষ্য এমন সকল ব্যক্তি, যারা তাওহিদের দাওয়াত দেয় এবং আল্লাহর শরিয়তের প্রতি মানুষকে পথপ্রদর্শন করে। কেউ কেউ এ থেকে হজরত আবু বাকার রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বুঝিয়েছেন। যিনি সর্ব প্রথম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যায়ন করেছেন এবং তাঁর উপর ঈমান এনেছেন। আবার কেউ কেউ এটাকে সাধারণ গণ্য করেছেন। যা সেই সব মুমিনকে শামিল করে, যারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালতের প্রতি ঈমান রাখেন এবং তাঁকে সত্য নবি বলে মনে করেন।
অবিশ্বাসীরা আসমান-জমিন সৃষ্টিতে আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা মানলেও তারা আল্লাহ তাআলার বিরোধিতা করে। আল্লাহ তাআলা বিষয়টি কোরআনুল কারিমে এভাবে তুলে ধরেছেন-
وَ لَئِنۡ سَاَلۡتَهُمۡ مَّنۡ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ لَیَقُوۡلُنَّ اللّٰهُ ؕ قُلۡ اَفَرَءَیۡتُمۡ مَّا تَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ اَرَادَنِیَ اللّٰهُ بِضُرٍّ هَلۡ هُنَّ کٰشِفٰتُ ضُرِّهٖۤ اَوۡ اَرَادَنِیۡ بِرَحۡمَۃٍ هَلۡ هُنَّ مُمۡسِکٰتُ رَحۡمَتِهٖ ؕ قُلۡ حَسۡبِیَ اللّٰهُ ؕ عَلَیۡهِ یَتَوَکَّلُ الۡمُتَوَکِّلُوۡنَ
‘আর তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, কে আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে ‘আল্লাহ’। বল, ‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ- আল্লাহ আমার কোনো ক্ষতি চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ডাক তারা কি সেই ক্ষতি দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমাকে রহমত করতে চাইলে তারা সেই রহমত প্রতিরোধ করতে পারবে’? বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট’। তাওয়াক্কুলকারীগণ তাঁর উপরই তাওয়াক্কুল করে।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৩৮)
কেউ কেউ বলেন যে, যখন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উল্লিখিত প্রশ্ন তাদের সামনে পেশ করলেন, তখন তারা বলল যে, সত্যিই তারা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত কোনো জিনিসকে দূর করতে পারবে না, তবে তারা সুপারিশ করবে। এরই ভিত্তিতে এই অংশটুকু অবতীর্ণ হয়েছে যে, সমস্ত কার্যকলাপের ব্যাপারে আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
যখন সমস্ত কিছু তাঁরই এখতিয়ারে, তখন অন্যের উপর নির্ভর করায় লাভ কি? এই জন্য ঈমানদারেরা কেবল তাঁরই উপর নির্ভর করে থাকে। তিনি ছাড়া অন্য কারো উপর তারা নির্ভর করে না, ভরসা ও আস্থা রাখে না।
মানুষের সঠিক পথ নির্দেশনার জন্য আল্লাহ তাআলা কোরআনুল কারিম নাজিল করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِنَّاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡکَ الۡکِتٰبَ لِلنَّاسِ بِالۡحَقِّ ۚ فَمَنِ اهۡتَدٰی فَلِنَفۡسِهٖ ۚ وَ مَنۡ ضَلَّ فَاِنَّمَا یَضِلُّ عَلَیۡهَا ۚ وَ مَاۤ اَنۡتَ عَلَیۡهِمۡ بِوَکِیۡلٍ
‘নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি যথাযথভাবে কিতাব নাজিল করেছি মানুষের জন্য; তাই যে সৎপথ অবলম্বন করে, সে তা নিজের জন্যই করে এবং যে পথভ্রষ্ট হয় সে নিজের ক্ষতির জন্যই পথভ্রষ্ট হয়। আর তুমি তাদের তত্ত্বাবধায়ক নও।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৪১)
মক্কাবাসীদের কুফরির উপর অটল থাকা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্য ছিল বড়ই কষ্টকর। তাই এই আয়াতে তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে যে, তোমার দায়িত্ব কেবল এই কিতাবের কথা বর্ণনা করে দেওয়া, যা আমি তোমার উপর অবতীর্ণ করেছি। তাদেরকে হেদায়াত দান করার দায়িত্ব তোমার নয়। যদি তারা হেদায়াতের পথ অবলম্বন করে নেয়, তবে তাতে তাদেরই লাভ। আর যদি তা অবলম্বন না করে, তবে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই হবে।
পরবর্তী আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর এমন এক পরিপূর্ণ কুদরতের এবং বিস্ময়কর কর্মের কথা উল্লেখ করছেন, যা মানুষ প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করে। আর তা হল, যখন সে ঘুমিয়ে যায়, তখন তার আত্মা আল্লাহর নির্দেশে তার (দেহ) থেকে যেন বেরিয়েই যায়। কেননা, তখন তার অনুভূতি ও বোধশক্তি বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর যখন সে জেগে ওঠে, তখন আত্মাকে ঠিক যেন তার মধ্যে পুনরায় প্রেরণ করা হয়। ফলে তার অনুভূতি আগের ন্যায় ফিরে আসে। অবশ্য যার জীবনের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে যায়, তার আত্মা আর ফিরে আসে না এবং সে মৃত্যুর হাতে ধরা খায়। এটাকেই মুফাসসিরগণ ‘ওয়াফাতে কুবরা’ (বড় মৃত্যু) এবং ‘অফাতে সোগরা’ (ছোট মৃত্যু) বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন-
اَللّٰهُ یَتَوَفَّی الۡاَنۡفُسَ حِیۡنَ مَوۡتِهَا وَ الَّتِیۡ لَمۡ تَمُتۡ فِیۡ مَنَامِهَا ۚ فَیُمۡسِکُ الَّتِیۡ قَضٰی عَلَیۡهَا الۡمَوۡتَ وَ یُرۡسِلُ الۡاُخۡرٰۤی اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ
‘আল্লাহ জীবসমূহের প্রাণ হরণ করেন তাদের মৃত্যুর সময় এবং যারা মরেনি তাদের নিদ্রার সময়। তারপর যার জন্য তিনি মৃত্যুর ফয়সালা করেন তার প্রাণ তিনি রেখে দেন এবং অন্যগুলো ফিরিয়ে দেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল কওমের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে।' (সুরা যুমার: আয়াত ৪২)
توفي এর শাব্দিক অর্থ লওয়া ও করায়ত্ত করা। আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, প্রাণীদের প্রাণ সর্বাবস্থায় ও সর্বক্ষণই আল্লাহ তাআলার আয়ত্ত্বাধীন। তিনি যখন ইচ্ছা তা হরণ করতে বা ফিরিয়ে নিতে পারেন। আল্লাহ তাআলার এ কুদরত প্রত্যেক প্রাণীই প্রত্যহ দেখে ও অনুভব করে। নিদ্রার সময় তার প্রাণ আল্লাহ তাআলার করায়ত্তে চলে যায় এবং ফিরিয়ে দেয়ার পর জাগ্রত হয়। অবশেষে এমন এক সময় আসবে, যখন তা সম্পূর্ণ করায়ত্ত হয়ে যাবে এবং ফিরে পাওয়া যাবে না। প্রাণ হরণ করা অর্থ তার সম্পর্ক দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। কখনও বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সবদিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, এরই নাম মৃত্যু। আবার কখনও শুধু বাহিকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়। আভ্যন্তরীণভাবে যোগাযোগ থাকে। এর ফলে কেবল বাহ্যিকভাবে জীবনের লক্ষণ, চেতনা ও ইচ্ছাভিত্তিক নড়াচড়ার শক্তি বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় এবং আভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে দেহের সঙ্গে প্ৰাণের সম্পর্ক বাকি থাকে। ফলে সে শ্বাস গ্রহণ করে ও জীবিত থাকে। এখানে প্রথমে বড় মৃত্যুর কথা পরে ছোট মৃত্যু বা ঘুমের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের অন্যত্রও দু’ধরনের মৃত্যুর উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে-
وَهُوَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ بِاللَّيْلِ وَيَعْلَمُ مَا جَرَحْتُمْ بِالنَّهَارِ ثُمَّ يَبْعَثُكُمْ فِيهِ لِيُقْضَىٰ أَجَلٌ مُسَمًّى ثُمَّ إِلَيْهِ مَرْجِعُكُمْ ثُمَّ يُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ
‘তিনিই রাতে তোমাদের মৃত্যু ঘটান এবং দিনে তোমরা যা কর তা তিনি জানেন। তারপর দিনে তোমাদেরকে তিনি আবার জীবিত করেন যাতে নির্ধারিত সময় পূর্ণ হয়। তারপর তাঁর দিকেই তোমাদের ফিরে যাওয়া। তারপর তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে তিনি তোমাদের অবহিত করবেন।’ (সুরা আল-আনআম: আয়াত ৬০)
এখানে প্রথমে ছোট মৃত্যু বা ঘুমের কথা, পরে বড় মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। (ইবনে কাসির)
মোটকথা এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মানুষকে এ অনুভূতি দিতে চাচ্ছেন যে, জীবন ও মৃত্যু কীভাবে তাঁর অসীম ক্ষমতার করায়ত্ব। শয়নে, জাগরণে, ঘরে অবস্থানের সময় কিংবা কোথাও চলাফেরা করার সময় মানব দেহের আভ্যন্তরীণ কোনো ত্রুটি অথবা বাইরের অজানা কোন বিপদ অকস্মাৎ এমন মোড় নিতে পারে যা তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। যে মানুষ আল্লাহর হাতে এতটা অসহায় সে যদি সেই আল্লাহ সম্পর্কে এতটা অমনোযোগী ও বিদ্ৰোহী হয় তাহলে সে কত অজ্ঞ। সে জন্যই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুমাবার আগে এবং ঘুম থেকে উঠে যে দোয়া করতেন তাতে রূহ ফেরত পাওয়ায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতেন। হাদিসে এসেছে, তিনি ঘুমাবার সময় বলতেন-
بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ أَمُوتُ وَأَحْيَا
‘হে আল্লাহ! আপনার নামেই আমি মারা যাই এবং জীবিত হই।’আর যখন ঘুম থেকে জাগতেন তখন বলতেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ
‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমাদের মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করেছেন। আর তাঁর কাছেই আমরা উত্থিত হবো।’ (বুখারি ৬৩১২)
সকল সুপারিশের মালিক আল্লাহ
قُلۡ لِّلّٰهِ الشَّفَاعَۃُ جَمِیۡعًا ؕ لَهٗ مُلۡکُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ ثُمَّ اِلَیۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ
‘হে রাসুল! আপনি বলুন, ‘সকল সুপারিশ আল্লাহর মালিকানাধীন। আসমানসমূহ ও যমীনের রাজত্ব একমাত্র তাঁরই। তারপর তোমরা তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তিত হবে।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৪৪)
সমস্ত ধরনের সুপারিশের মালিক হলেন একমাত্র আল্লাহ। তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। অতএব কেবল এক আল্লাহরই ইবাদত কেন করা হয় না, যাতে তিনি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং যাতে তার সুপারিশের জন্য কোন মাধ্যম খোঁজার প্রয়োজনই না পড়ে।
গায়েবের মালিক আল্লাহ
قُلِ اللّٰهُمَّ فَاطِرَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ عٰلِمَ الۡغَیۡبِ وَ الشَّهَادَۃِ اَنۡتَ تَحۡکُمُ بَیۡنَ عِبَادِکَ فِیۡ مَا کَانُوۡا فِیۡهِ یَخۡتَلِفُوۡنَ
‘বল, ‘হে আল্লাহ, আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টিকর্তা, গায়েব ও উপস্থিত বিষয়াদির জ্ঞানী; তুমি তোমার বান্দাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবে যাতে তারা মতবিরোধ করছে।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৪৬)
হজরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে জিজ্ঞাসা করলাম, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাহাজ্জুদের নামাজ কি দ্বারা শুরু করতেন? তিনি বললেন, তিনি যখন তাহাজ্জুদের জন্যে উঠতেন তখন এ দোয়া পাঠ করতেন-
اللَّهُمَّ رَبَّ جِبْرِيلَ , وَمِيكَائِيلَ , وَإِسْرَافِيلَ فَاطِرَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ , عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ أَنْتَ تَحْكُمُ بَيْنَ عِبَادِكَ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ ، اللَّهُمَّ اهْدِنِي لِمَا اخْتُلِفَ فِيهِ مِنَ الْحَقِّ , إِنَّكَ تَهْدِي مَنْ تَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
‘হে আল্লাহ! জিবরিল, মিকাইল ও ইসরাফিলের প্রভু, আসমানসমূহ ও জমিনের প্রভু, গায়েব ও প্রত্যক্ষ সবকিছুর জ্ঞানী, আপনিই আপনার বান্দারা যে সব বিষয়ে মতবিরোধ করছে তাতে ফয়সালা করবেন। যে ব্যাপারে মতবিরোধ করা হয়েছে তাতে আপনার অনুমতিক্রমে আমাকে সত্য-সঠিক পথ দিন। নিশ্চয়ই আপনি যাকে ইচ্ছা তাকে সরল সোজা পথের হেদায়েত করেন।’ (মুসলিম ৭৭০)
পরকালের আজাবের ভয়াবহতা
وَ لَوۡ اَنَّ لِلَّذِیۡنَ ظَلَمُوۡا مَا فِی الۡاَرۡضِ جَمِیۡعًا وَّ مِثۡلَهٗ مَعَهٗ لَافۡتَدَوۡا بِهٖ مِنۡ سُوۡٓءِ الۡعَذَابِ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ ؕ وَ بَدَا لَهُمۡ مِّنَ اللّٰهِ مَا لَمۡ یَکُوۡنُوۡا یَحۡتَسِبُوۡنَ
‘আর যারা জুলুম করেছে, যদি জমিনে যা আছে তা সব এবং এর সমপরিমাণও তাদের জন্য হয়; তবে কেয়ামতের দিন কঠিন আজাব থেকে বাঁচার জন্য মুক্তিপণস্বরূপ তারা তা দিয়ে দেবে। সেখানে আল্লাহর কাছে থেকে তাদের জন্য এমন কিছু প্রকাশিত হবে, যা তারা কখনো কল্পনাও করত না।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৪৭)
আজাবের কঠিনতা, ভয়াবহতা এবং তা এত প্রকারের হবে যে, তা হয়তো কোনো দিন তাদের ধারণা ও কল্পনাতেও আসেনি। অথবা যে সকল কাজ তারা ভালো মনে করে করেছিল তা তাদের সামনে আল্লাহর কাছে খারাপ রূপে প্রকাশ পাবে; যা ওরা কল্পনাও করেনি যে, তা আসলে খারাপ কাজ।
আল্লাহর পরীক্ষা
فَاِذَا مَسَّ الۡاِنۡسَانَ ضُرٌّ دَعَانَا ۫ ثُمَّ اِذَا خَوَّلۡنٰهُ نِعۡمَۃً مِّنَّا ۙ قَالَ اِنَّمَاۤ اُوۡتِیۡتُهٗ عَلٰی عِلۡمٍ ؕ بَلۡ هِیَ فِتۡنَۃٌ وَّ لٰکِنَّ اَکۡثَرَهُمۡ لَا یَعۡلَمُوۡنَ
‘অতঃপর কোন বিপদাপদ মানুষকে স্পর্শ করলে সে আমাকে ডাকে। তারপর যখন আমি আমার পক্ষ থেকে নি‘আমত দিয়ে তাকে অনুগ্রহ করি তখন সে বলে, ‘জ্ঞানের কারণেই কেবল আমাকে তা দেয়া হয়েছে’। বরং এটা এক পরীক্ষা। কিন্তু তাদের অধিকাংশই তা জানে না।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৪৯)
এ আয়াতে মানুষের উল্লেখ ‘জাতি’ হিসাবে করা হয়েছে। অধিকাংশ মানুষেরই এই অবস্থা যে, যখন তারা রোগ, অভাব-অনটন অথবা অন্য কোসো সমস্যার শিকার হয়, তখন তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে এবং তার সামনে কাকুতি-মিনতি করে।
নেয়ামত লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই অবাধ্যতা ও ধৃষ্টতার পথ অবলম্বন করে নেয় এবং বলে যে, এতে আল্লাহর আবার অনুগ্রহ কি? এ তো আমার পারদর্শিতার ফল। অথবা যে জ্ঞান ও দক্ষতা আমার রয়েছে, তারই মাধ্যমে এসব নেয়ামত অর্জিত হয়েছে। কিংবা আমি জানতাম যে, দুনিয়াতে এই সমস্ত জিনিস আমি পাব। কেননা, আল্লাহর কাছে আমার সম্মান অনেক।
প্রকৃতপক্ষে ব্যাপার তা নয়, যা তুমি মনে করছ অথবা বর্ণনা করছ। বরং এই নেয়ামতগুলো তোমার জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। এই দেখার জন্য যে, তুমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছ, না অকৃতজ্ঞ হচ্ছ। এই কথা যে, এটা আল্লাহর পক্ষ হতে অবকাশ ও পরীক্ষা।
মুমিনদের জন্য নিদর্শন
اَوَ لَمۡ یَعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یُّؤۡمِنُوۡنَ
‘তারা কি জানে না, আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছে রিজিক প্রশস্ত করেন, আর সীমিত করেন? নিশ্চয়ই এতে নিদর্শনাবলী রয়েছে এমন সম্প্রদায়ের জন্য, যারা ঈমান আনে।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৫২)
রিজিকের প্রশস্ততা ও সংকীর্ণতার মধ্যেও আল্লাহর তাওহিদের দলিল বিদ্যমান। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিশ্বজাহানে কেবল তাঁরই নির্দেশ ও কর্তৃত্ব চলে। তাঁরই পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা কার্যকর ও প্রভাবশীল। এই জন্য তিনি যাকে চান তাকে প্রচুর ধন দিয়ে ধন্য করেন এবং যাকে চান তাকে অভাব-অনটনে নাজেহাল করেন। তাঁর এই বিচার-বিবেচনায় যা তাঁর সুকৌশল ও ইচ্ছার উপর প্রতিষ্ঠিত। না কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে, আর না তাতে কোন পরিবর্তন সাধন করতে পারে। তবে এই নিদর্শনাবলী কেবল ঈমানদারদের জন্যই ফলপ্রসূ হয়। কেননা, তারাই এগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে উপকৃত হয় এবং আল্লাহর ক্ষমা লাভ করে।
আল্লাহর রহমত থেকে হতাশ না হওয়ার আহ্বান
قُلۡ یٰعِبَادِیَ الَّذِیۡنَ اَسۡرَفُوۡا عَلٰۤی اَنۡفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُوۡا مِنۡ رَّحۡمَۃِ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ یَغۡفِرُ الذُّنُوۡبَ جَمِیۡعًا ؕ اِنَّهٗ هُوَ الۡغَفُوۡرُ الرَّحِیۡمُ
‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ; আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে হতাশ হয়ো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
এই আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর মহা ক্ষমাশীলতার কথা বর্ণনা করেছেন। إسرَاف ‘ইসরাফ’ অর্থ পাপের আধিক্য ও তার প্রাচুর্য। ‘আল্লাহর করুণা হতে নিরাশ হয়ো না’ এর অর্থ, ঈমান আনার আগে অথবা তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুভূতি সৃষ্টি হওয়ারআগে যতই গুনাহ করে থাকুক, মানুষ যেন এই মনে না করে যে, আমি তো অনেক বড় পাপী, আমাকে আল্লাহ কীভাবে ক্ষমা করবেন? বরং সত্য হৃদয়ে যদি ঈমান আনে বা নিষ্ঠার সাথে যদি তওবা করে, তবে মহান আল্লাহ সমস্ত পাপকে মাফ করে দেবেন।
আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার কারণিক ঘটনা থেকেও এই অর্থই সাব্যস্ত হয়। কিছু কাফের ও মুশরিক এমন ছিল, যারা প্রচুর হত্যা ও ব্যভিচারে লিপ্ত ছিল। এরা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে উপস্থিত হয়ে বলল যে, আপনার দাওয়াত তো সঠিক, কিন্তু আমরা অনেক পাপের পাপী। যদি আমরা ঈমান আনি, তবে এই সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যাবে কি? এরই ভিত্তিতে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়।’ (বুখারি)
তবে এর অর্থ এই নয় যে, আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার আশায় খুব পাপ করে যাও। তাঁর যাবতীয় বিধি-বিধান ও ফরজ কার্যাদির ব্যাপারে কোনোই পরোয়া করো না এবং আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সীমা ও নিয়ম-নীতি নিষ্ঠুরতার সঙ্গে লঙ্ঘন করে যাও। এইভাবে তাঁর ক্রোধ ও প্রতিশোধকে আহবান জানিয়ে তাঁর রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার আশা করা একেবারে বোকামি ও খামখেয়ালী। এটা হল নিম ফলের বীজ লাগিয়ে আঙ্গুর ফলের আশা রাখার মতই। এই ধরনের মানুষের স্মরণ রাখা উচিত যে, তিনি যেমন তাঁর বান্দাদের জন্য غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ তেমনি তিনি তাঁর অবাধ্যজনদের জন্য عَزِيْزٌ ذُو اْنْتِقَامٍ ও বটে।
তাই তো কোরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে এই উভয় দিককে এক সঙ্গেই বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-
نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ، وَأَنَّ عَذَابِي هُوَ الْعَذَابُ الْأَلِيمُ
আমার বান্দাদেরকে বলে দাও, নিশ্চয়ই আমিই চরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু এবং আমার শাস্তিই হল অতি মর্মন্তুদ শাস্তি। (সুরা হিজর: আয়াত ৪৯-৫০)
সম্ভবতঃ এটাই কারণ যে, এখানে আয়াতের আরম্ভ يَا عِبَادِيْ (হে আমার বান্দাগণ!) দিয়ে হয়েছে। যার দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, যে ব্যক্তি ঈমান আনে অথবা সত্য হৃদয়ে তওবা করে প্রকৃত অর্থে সে তাঁর বান্দা হয়ে যাবে, তার পাপ যদি সমুদ্রের ফেনা বরাবরও হয়, তবুও তা মাফ হয়ে যাবে। তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য অবশ্যই ক্ষমাশীল ও দয়াবান।
হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, কিছু লোক ছিল, যারা অন্যায় হত্যা করেছিল এবং অনেক করেছিল। আরও কিছু লোক ছিল, যারা ব্যভিচার করেছিল এবং অনেক করেছিল। তারা এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে আরজ করল: আপনি যে ধর্মের দাওয়াত দেন, তা তো খুবই উত্তম, কিন্তু চিন্তার বিষয় হল এই যে, আমরা অনেক জঘন্য গুনাহ করে ফেলেছি। আমরা যদি ইসলাম গ্রহণ করি, তবে আমাদের তওবা কবুল হবে কি? এর পরিপ্রেক্ষিতেই আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়৷’ (বুখারি ৪৮১০, মুসলিম ১২২)
আল্লাহমুখী হওয়ার আহ্বান
وَ اَنِیۡبُوۡۤا اِلٰی رَبِّکُمۡ وَ اَسۡلِمُوۡا لَهٗ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَکُمُ الۡعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنۡصَرُوۡنَ
‘আর তোমরা তোমাদের রবের অভিমুখী হও এবং তোমাদের উপর আযাব আসার পূর্বেই তার কাছে আত্মসমর্পণ কর। তার (আযাব আসার) পরে তোমাদেরকে সাহায্য করা হবে না।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৫৪)
وَ اتَّبِعُوۡۤا اَحۡسَنَ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکُمۡ مِّنۡ رَّبِّکُمۡ مِّنۡ قَبۡلِ اَنۡ یَّاۡتِیَکُمُ الۡعَذَابُ بَغۡتَۃً وَّ اَنۡتُمۡ لَا تَشۡعُرُوۡنَ
‘আর অনুসরণ কর উত্তম যা নাযিল করা হয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে, তোমাদের উপর অতর্কিতভাবে আযাব আসার পূর্বে। অথচ তোমরা উপলব্ধি করতে পারবে না।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৫৫)
এখানে ‘উত্তম অবতীর্ণ বিষয়’ বলে কোরআনকে বোঝানো হয়েছে। সমগ্র কুরআনই উত্তম। একে এদিক দিয়েও উত্তম বলা যায় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তওরাত, ইঞ্জিল, যাবুর ইত্যাদি যত কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে, তন্মধ্যে উত্তম ও পূর্ণতম কিতাব হচ্ছে কোরআন অথবা আল্লাহর কিতাবের সর্বোত্তম দিকসমূহ অনুসরণ করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা যেসব কাজের নির্দেশ দিয়েছেন মানুষ তা পালন করবে। তিনি যেসব কাজ করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকবে এবং উপমা ও কিসসা-কাহিনীতে যা বলেছেন তা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্ৰহণ করবে। অপরদিকে যে ব্যক্তি তাঁর নির্দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, নিষিদ্ধ কাজসমূহ করে এবং আল্লাহর উপদেশ বাণীর কানা কড়িও মূল্য দেয় না, সে আল্লাহর কিতাবের এমন দিক গ্ৰহণ করে যাকে আল্লাহর কিতাব নিকৃষ্টতম দিক বলে আখ্যায়িত করে। (মুয়াসসার)
কেয়ামতের দিন যাদের চেহারা কালো হবে
وَ یَوۡمَ الۡقِیٰمَۃِ تَرَی الَّذِیۡنَ کَذَبُوۡا عَلَی اللّٰهِ وُجُوۡهُهُمۡ مُّسۡوَدَّۃٌ ؕ اَلَیۡسَ فِیۡ جَهَنَّمَ مَثۡوًی لِّلۡمُتَکَبِّرِیۡنَ
‘আর যারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে কিয়ামতের দিন তুমি তাদের চেহারাগুলো কালো দেখতে পাবে। অহঙ্কারীদের বাসস্থান জাহান্নামের মধ্যে নয় কি?’ (সুরা যুমার: আয়াত ৬০)
কালো হওয়ার কারণ হবে, আযাবের ভয়াবহতা এবং আল্লাহর ক্রোধের প্রত্যক্ষ দর্শন। হাদিসে এসেছে যে-
الْكِبْرُ بَطَرُ الْحَقِّ وَغَمْطُ النَّاسِ
‘অহংকার হল, সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তাচ্ছিল্য করা।’
আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে যে অহংকার প্রদর্শন করে, তার ঠিকানা হল জাহান্নাম।
মুত্তাকিদের জন্য সাফল্য
وَ یُنَجِّی اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا بِمَفَازَتِهِمۡ ۫ لَا یَمَسُّهُمُ السُّوۡٓءُ وَ لَا هُمۡ یَحۡزَنُوۡنَ
‘আর আল্লাহ মুত্তাকীদেরকে তাদের সাফল্যসহ নাজাত দেবেন। কোন অমঙ্গল তাদেরকে স্পর্শ করবে না। আর তারা চিন্তিতও হবে না।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৬১)
অকল্যাণ থেকে বেঁচে যাওয়া এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্য লাভ করা। আল্লাহ তাআলা আল্লাহভীরুদেরকে সেই সফলতা ও সৌভাগ্যের কারণে মুক্তি দেবেন, যা আগে থেকেই তাঁর কাছে তাদের জন্য সাব্যস্ত হয়ে আছে। তারা দুনিয়াতে যা কিছু ছেড়ে এসেছে, তার জন্য তাদের কোনো দুঃখ হবে না। আর যেহেতু তারা কেয়ামতের ভয়াবহতা হতে সুরক্ষিত থাকবে, তাই তারা কোন ব্যাপারে চিন্তিত ও দুঃখিত হবে না।
আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা
اَللّٰهُ خَالِقُ کُلِّ شَیۡءٍ ۫ وَّ هُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ وَّکِیۡلٌ لَهٗ مَقَالِیۡدُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بِاٰیٰتِ اللّٰهِ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ
‘আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং তিনি সব কিছুর তত্ত্বাবধায়ক। আসমানসমূহ ও যমীনের চাবিসমূহ তাঁরই কাছে। আর যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৬২-৬৩)
প্রত্যেক জিনিসের স্রষ্টাও তিনি এবং মালিকও তিনিই। তিনি যেভাবে চান, পরিচালনা করেন। প্রতিটি জিনিস তাঁর আয়ত্তে ও তাঁর পরিচালনার অধীনে বন্দী। কারো অবাধ্যতা করার অথবা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। وكيل (উকীল) অর্থ, দায়িত্বপ্রাপ্ত, কর্মবিধায়ক। প্রতিটি জিনিসই তাঁরই অধীনে এবং তিনি কারো অংশীদারী ছাড়াই সমস্ত কিছুর হেফাজত ও পরিচালনা করেন।
চাবি কারও হাতে থাকা তার মালিক ও নিয়ন্ত্রক হওয়ার লক্ষণ। তাই আয়াতের মর্মার্থ দাঁড়ায় এই যে, আকাশে ও পৃথিবীতে লুকায়িত সকল ভাণ্ডারের চাবি আল্লাহর হাতে। তিনিই এগুলোর রক্ষক, তিনিই নিয়ন্ত্রক, যখন ইচ্ছা যাকে ইচ্ছা যে পরিমাণ ইচ্ছা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা দান করবেন আর যাকে ইচ্ছা দান করেন না। (মুয়াসসার, তাবারি)
অবিশ্বাসীরা দলে দলে জাহান্নামে যাবে
وَ سِیۡقَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اِلٰی جَهَنَّمَ زُمَرًا ؕ حَتّٰۤی اِذَا جَآءُوۡهَا فُتِحَتۡ اَبۡوَابُهَا وَ قَالَ لَهُمۡ خَزَنَتُهَاۤ اَلَمۡ یَاۡتِکُمۡ رُسُلٌ مِّنۡکُمۡ یَتۡلُوۡنَ عَلَیۡکُمۡ اٰیٰتِ رَبِّکُمۡ وَ یُنۡذِرُوۡنَکُمۡ لِقَآءَ یَوۡمِکُمۡ هٰذَا ؕ قَالُوۡا بَلٰی وَ لٰکِنۡ حَقَّتۡ کَلِمَۃُ الۡعَذَابِ عَلَی الۡکٰفِرِیۡنَ قِیۡلَ ادۡخُلُوۡۤا اَبۡوَابَ جَهَنَّمَ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا ۚ فَبِئۡسَ مَثۡوَی الۡمُتَکَبِّرِیۡنَ
‘আর কাফিরদেরকে দলে দলে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা যখন জাহান্নামের কাছে এসে পৌঁছবে তখন তার দরজাগুলো খুলে দেয়া হবে এবং জাহান্নামের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে কি রাসূলগণ আসেনি, যারা তোমাদের কাছে তোমাদের রবের আয়াতগুলো তিলাওয়াত করত এবং এ দিনের সাক্ষাৎ সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করত’? তারা বলবে, ‘অবশ্যই এসেছিল’; কিন্তু কাফিরদের উপর আযাবের বাণী সত্যে পরিণত হল। বলা হবে, ‘তোমরা জাহান্নামের দরজাসমূহে প্রবেশ কর, তাতেই স্থায়ীভাবে থাকার জন্য। অতএব অহঙ্কারীদের আবাসস্থল কতই না নিকৃষ্ট’!’ (সুরা যুমার: আয়াত ৭১-৭২)
আল্লাহ তাআলা কাফের দূর্ভাগাদের অবস্থা বর্ণনা করছেন, কীভাবে তাদেরকে জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তাদেরকে সেদিকে অত্যন্ত কঠোর, ধমক ও কর্কশভাবে নেওয়া হবে। যেমন অন্যত্র বলেছেন, ‘যেদিন তাদেরকে ধাক্কা মারতে মারতে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের আগুনের দিকে’ (সুরা আত-তুর: আয়াত ১৩) এমতাবস্থায় যে, তারা থাকবে পিপাসার্ত ও ক্ষুধার্ত। যেমন অন্য আয়াতে এসেছে, ‘এবং অপরাধীদেরকে তৃষ্ণাতুর অবস্থায় জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নিয়ে যাব।’ (সুরা মারইয়াম: আয়াত ৮৬) তাদের অবস্থা হবে এমন যে, তারা বোবা, বধির ও অন্ধ হবে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মুখের উপর ভর দিয়ে চলবে। আল্লাহ বলেন, ‘আর আল্লাহ যাদেরকে পথনির্দেশ করেন তারা তো পথপ্রাপ্ত এবং যাদেরকে তিনি পথভ্রষ্ট করেন আপনি কখনো তাদের জন্য তাকে ছাড়া অন্য কাউকে অভিভাবক পাবেন না। আর কেয়ামতের দিন আমরা তাদেরকে সমবেত করব তাদের মুখে ভর দিয়ে চলা অবস্থায় অন্ধ, মূক ও বধির করে। তাদের আবাসস্থল জাহান্নাম; যখনই তা স্তিমিত হবে তখনই আমরা তাদের জন্য আগুনের শিখা বৃদ্ধি করে দেব।’ (সুরা আল-ইসরা: আয়াত৯৭)
যারা দলে দলে জান্নাতে যাবে
وَ سِیۡقَ الَّذِیۡنَ اتَّقَوۡا رَبَّهُمۡ اِلَی الۡجَنَّۃِ زُمَرًا ؕ حَتّٰۤی اِذَا جَآءُوۡهَا وَ فُتِحَتۡ اَبۡوَابُهَا وَ قَالَ لَهُمۡ خَزَنَتُهَا سَلٰمٌ عَلَیۡکُمۡ طِبۡتُمۡ فَادۡخُلُوۡهَا خٰلِدِیۡنَ وَ قَالُوا الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِیۡ صَدَقَنَا وَعۡدَهٗ وَ اَوۡرَثَنَا الۡاَرۡضَ نَتَبَوَّاُ مِنَ الۡجَنَّۃِ حَیۡثُ نَشَآءُ ۚ فَنِعۡمَ اَجۡرُ الۡعٰمِلِیۡنَ
‘আর যারা তাদের রবের তাকওয়া অবলম্বন করেছে তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে যখন তারা জান্নাতের কাছে আসবে এবং এর দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হবে এবং জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা ভালো ছিলে সুতরাং জান্নাতে প্রবেশ কর স্থায়ীভাবে অবস্থিতির জন্য। আর তারা (প্ৰবেশ করে) বলবে, সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের প্রতি তার প্রতিশ্রুতি সত্য করেছেন এবং আমাদের অধিকারী করেছেন এ জমিনের; আমরা জান্নাতে যেখানে ইচ্ছে বসবাসের জায়গা করে নেব। অতএব নেক আমলকারীদের পুরস্কার কত উত্তম!’ (সুরা যুমার: আয়াত ৭৩-৭৪)
ঈমানদার ও আল্লাহভীরুদেরকেও দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। প্রথমে ‘মুক্বার্রাবীন’ (নৈকট্যপ্রাপ্ত দল), তারপর ‘আবরার’ (সৎলোকদের দল), এইভাবে মর্যাদাক্রমে প্রত্যেক দল তার সমমানের দলের সঙ্গে শামিল থাকবে। যেমন- নবিরা নবিদের সঙ্গে, সত্যবাদীরা সত্যবাদীদের সঙ্গে, শহীদরা শহীদদের সঙ্গে এবং আলেমরা আলেমদের সঙ্গে। অর্থাৎ, প্রত্যেক দল তারই ন্যায় দলের বা তার সমমানের দলের সঙ্গে থাকবে।
হাদিসে এসেছে, ‘জান্নাতের আটটি দরজা। তার মধ্যে একটি দরজার নাম ‘রাইয়ান’। এই দরজা দিয়ে কেবল রোজাদাররা প্রবেশ করবে।’ (বুখারি ২২৫৭, মুসলিম ৮০৮)
এইভাবে অন্যান্য দরজারও নাম থাকবে। যেমন, বাবুস্ সালাত (নামাজের দরজা)। বাবুস্ সাদাকাহ (সাদকার দরজা)। বাবুল জিহাদ (জিহাদের দরজা) প্রভৃতি। (বুখারি)
প্রত্যেক দরজা চল্লিশ বছরের পথ সমতুল্য চওড়া হবে। তা সত্ত্বেও তা পরিপূর্ণ থাকবে। (মুসলিম)
সর্ব প্রথম জান্নাতের দরজায় করাঘাতকারী হবেন নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলােইহি ওয়া সাল্লাম। (মুসলিম)
জান্নাতে সর্বপ্রথম আগমনকারী দলটির চেহারা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত এবং দ্বিতীয় দলটির মুখমন্ডল আসমানে দীপ্যমান নক্ষত্রের মধ্যে সর্বাধিক উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় চমকাতে থাকবে। জান্নাতে তারা প্রস্রাব-পায়খানা এবং থুতু-শ্লেষ্মা হতে পাক ও পবিত্র হবে। তাদের চিরুণী হবে স্বর্ণের আর তাদের ঘর্ম হবে কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধময়। তাদের ধুনুচিতে সুগন্ধিময় আগর-কাঠ হবে। ডাগর চক্ষুবিশিষ্ট হুরগণ হবে তাদের স্ত্রী। তাদের উচ্চতা হবে আদম আলাইহিস সালামের মত ষাট হাত। (বুখারি)
বুখারির অপর একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, প্রত্যেকটি মুমিন দুটি করে হুর পাবে। তারা এত রূপসী ও সুন্দরী হবে যে, (স্বচ্ছ সৌন্দর্যের কারণে) তাদের গোশতপিন্ডের ভেতর থেকে পায়ের নলাস্থিত মজ্জাও দেখা যাবে।’ (বুখারি) কেউ কেউ বলেছেন, এই দুটি স্ত্রী হুর ছাড়া দুনিয়ার মহিলাদের মধ্য থেকে হবে।
আল্লাহ তাআলা যে ওয়াদা তার সম্মানিত রাসুলদের মাধ্যমে ঈমানদারদের দিয়েছেন। যেমন তারা দুনিয়াতেও এ দোয়া করেছিল- ‘হে আমাদের রব! আপনার রাসুলগণের মাধ্যমে আমাদেরকে যা দিতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা আমাদেরকে দান করুন এবং কেয়ামতের দিন আমাদেরকে হেয় করবেন না। নিশ্চয়ই আপনি প্রতিশ্রুতির ব্যতিক্রম করেন না।’ (সুরা আল-ইমরান: আয়াত ১৯৪)
সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য
وَ تَرَی الۡمَلٰٓئِکَۃَ حَآفِّیۡنَ مِنۡ حَوۡلِ الۡعَرۡشِ یُسَبِّحُوۡنَ بِحَمۡدِ رَبِّهِمۡ ۚ وَ قُضِیَ بَیۡنَهُمۡ بِالۡحَقِّ وَ قِیۡلَ الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
‘আর তুমি ফেরেশতাদেরকে আরশের চারপাশ ঘিরে তাদের রবের প্রশংসায় তাসবিহ পাঠ করতে দেখতে পাবে। আর তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার করে দেওয়া হবে এবং বলা হবে ‘সকল প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব আল্লাহর জন্য।’ (সুরা যুমার: আয়াত ৭৫)
আল্লাহর বিচার-ফায়সালার পর ঈমানদাররা জান্নাতে এবং কাফের ও মুশরিকরা জাহান্নামে চলে যাওয়ার পরের চিত্র আয়াতে এইভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে, ফেরেশতাগণ আল্লাহর আরশকে পরিবেষ্টিত রাখা অবস্থায় তাঁর পবিত্রতার ঘোষণা ও গুণবর্ণনায় ব্যস্ত থাকবেন। এখানে প্রশংসার সম্পর্ক কোনো এক সৃষ্টির সঙ্গে জোড়া হয়নি, যা থেকে জানা যায় যে, প্রতিটি জিনিস (কথা বলতে সক্ষম ও অক্ষম) এর মুখে থাকবে আল্লাহর হামদের তথা প্রশংসার সুর।
সুরা মুমিন
সুরাটি মক্কায় নাজিল হয়েছে। আল্লাহ তাআলা শুরুতেই তাঁর অসাধারণ গুণাবলী দিয়ে সুরাটি আরম্ভ করেছেন যে, তিনি পরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী, গোনাহ মার্জনাকারী, তাওবা কবুলকারী, অবাধ্য বিদ্রোহীদের কঠোর শাস্তি প্রদানকারী। তিনি অনন্ত অসীম ক্ষমতাবান। তাঁর কানো শরীক নাই। তিনি একমাত্র উপাস্য। সমগ্র মানব জাতীকে পরিশেষে তাঁর নিকটই প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অর্থাৎ এ সুরায়ও তাওহিদ বা একত্ববাদের গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ সুরায় আল্লাহ তাআলা তিনটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করেছেন-
>> তাওহিদ তথা একত্ববাদ সম্পর্কে
তিনি এক, তাঁর কোনো শরিক নেই; তাওহিদের বর্ণনা কোথাও দলিল-প্রমাণ সাব্যস্ত করেছেন; আবার কোথাও তাঁর আদেশ প্রদান করেছেন। এমনি ভাবে কুফর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছেন। সর্বোপরি এ সুরায় তাওহিদের ধারক ও বাহকদের প্রশংসা ও সুসংবাদ রয়েছে এ সুরায়।
>> দুনিয়ায় বিবাদ সৃষ্টিকারীদের ধমকি প্রদান
সত্যের ব্যাপারে এ বিবাদ সৃষ্টিকারীরা ব্যাপক, যারা বিশ্বনবিকে অস্বীকার করতেন। এ কারণে তাদেরকে ইহকালীন লাঞ্ছনা ও পরকালীন কঠোর শাস্তির ধমকি প্রদান করা হয়েছে।
>> বিশ্বনবিকে সান্ত্বনা প্রদান
মক্কার কাফের মুশরিক কর্তৃক বিশ্বনবি যখন নানান লাঞ্ছনা-প্রবঞ্চনা, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, অপপ্রচার এমনকি জীবন নাশের ব্যর্থ পরিকল্পনার সময় বিচলিত ঠিক তখনই আল্লাহ তাআলা তাঁর অসহায়ত্ববোধকে দূরীকরণ এবং স্বীয় মিশন পরিচালনায় অটল এবং অবিচল থাকার জন্য এ সুরার মাধ্যমেই সান্ত্বনা প্রদান করেন। তাই এ সুরায় স্থান পায় হজরত মুসা ও মরদুদ ফিরাউনের মধ্যকার ঘটনা।
সুরা হা-মিম আস-সাজদা (১-৪৬)
মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরাটি সিজদা, হা-মিম আস-সিজদা, মাসাবিহ ও ফুসসিলাত নামে পরিচিত। এ সুরায় বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রেসালাতের বর্ণনার পাশাপাশি মৃত্যুর পর মানুষের যে জীবন আসবে, সে সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয়েছে।
তাই যারা বিশ্বনবির প্রতি ঈমান আনয়নে অনীহা প্রকাশ করে এবং তার বিরোধীতা করে, তাদের উদ্দেশ্যে কঠোর সতর্কবানীও উচ্চারিত হয়েছে এ সুরায়।
এ সুরার ৩০-৩১ আয়াতে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন কাফেরদের কী অবস্থা হবে, তার বিবরণ শেষে মোমিন বান্দাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘তারা একবার মনেপ্রাণে আল্লাহকে রব বলে মেনে নিলে আমরণ এ বিশ্বাসের ওপর অটুট-অবিচল থাকে। মৃত্যুর সময় এবং কেয়ামতের দিন ফেরেশতারা তাদের বলবেন, ভয় পেও না, জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো। দুনিয়া ও আখেরাতে আমরা হলাম তোমাদের বন্ধু। জান্নাত তোমাদের জন্য, তোমাদের মন যা চায়, এমন সবকিছুই আছে সেখানে।’
সুরার শেষাংশে আল্লাহ তাআলার ন্যায়ানুগ ফয়সালার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘যে নেক আমল করবে, সে নিজের কল্যাণের জন্যই করবে। আর যে মন্দকাজ করবে তার প্রতিফল সে নিজেই ভোগ করবে। তোমার প্রতিপালক বান্দাদের প্রতি মোটেই জুলুম করেন না।’ (সুরা হা-মিম আস-সাজদাহ : আয়াত ৪৬)
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের এ গুরুত্বপূর্ণ সুরাগুলো বুঝে পড়ার এবং তাঁর ওপর আমল করার পাশাপাশি নিজেদের আকিদা-বিশ্বাসকে শিরকমুক্ত রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম