জাতীয়

বঙ্গবাজারের আগুনে ক্ষতি ৩০৩ কোটি টাকা

# অগ্নিকাণ্ডে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।# বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, এনেক্সকো টাওয়ার, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, বঙ্গ ইসলামিয়া ও বঙ্গ হোমিও মার্কেটের কাঠামোগত ক্ষতি প্রায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।# বঙ্গবাজারসহ আশপাশের মার্কেটে ২৮৮ কোটি টাকার মালামাল আগুনে পুড়ে গেছে।

Advertisement

রাজধানীর বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) গঠিত কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ীর নাম চূড়ান্ত করা হয়েছে। এছাড়া বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের আগুনে আশপাশের পাঁচটি মার্কেট ও মালামালের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু আগুনের সূত্রপাত ও এ ঘটনা নাশকতা ছিল কি না তা নিশ্চিত করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।

গত ৪ এপ্রিল সকালে বঙ্গবাজারে (বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট) অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। সেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গবাজারের পাশের এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেট, মহানগর শপিং কমপ্লেক্স, বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও মার্কেট পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ঘটনায় ওই দিনই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন, অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান ও ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে অঞ্চল-১ এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীনকে আহ্বায়ক ও প্রধান সমাজকল্যাণ এবং বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা আকন্দ মোহাম্মদ ফয়সাল উদ্দীনকে সদস্য সচিব করে আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএসসিসি।

আরও পড়ুন>> বঙ্গবাজারে চৌকি বসিয়ে ব্যবসা শুরু

Advertisement

ঘটনার এক সপ্তাহ পর মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর নামের তালিকাসহ বিস্তর তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, অগ্নিকাণ্ডের সময় চৈত্রের খরতাপ ও বাতাসের প্রবাহ বেশি থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও ডিএসসিসির মালিকানাধীন টিন, কাঠ ও লোহার কাঠামো দ্বারা তৈরি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেট ও মহানগর শপিং কমপ্লেক্স সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়। সাততলা বিশিষ্ট এনেক্সকো টাওয়ারের বহু দোকান এবং একই সঙ্গে রাস্তার পশ্চিম পাশের বঙ্গ ইসলামিয়া সুপার মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সের বহু দোকান পুড়ে গেছে।

আগুনে মার্কেটগুলোর কাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ

প্রতিবেদন অনুযায়ী অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটের মধ্যে ডিএসসিসির মালিকানাধীন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সটি ১ দশমিক ৭৯ একর জমির ওপর অবস্থিত। এ জায়গায় ২ হাজার ৯৬১টি দোকান সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। কাঠামোগত দিক বিবেচনায় মার্কেটটির প্রায় ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। বঙ্গবাজারের আগুন আশপাশের কয়েকটি মার্কেটে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেট, মহানগর মার্কেট এবং বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও মার্কেট রয়েছে। এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেটটি সাততলা বিশিষ্ট। যার মধ্যে চার থেকে সাততলা পর্যন্ত আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মার্কেটটিতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন>> আর্থিক সহায়তা চান বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত দর্জিরা

Advertisement

মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের অধিকাংশই পুড়ে গেছে। এতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড় কোটি টাকা। এছাড়া বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও মার্কেটটি চারতলা বিশিষ্ট ছিল। যার বড় অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এভাবে সব মিলে মার্কেটের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

মার্কেটগুলোর মালামালের ক্ষতির পরিমাণ

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে দুই হাজার ৯৬১টি দোকান ছিল, যার প্রতিটি দোকান প্রায় ১৭ দশমিক ৫-২০ বর্গফুট বিশিষ্ট ছিল। এ মার্কেটে বেশিরভাগ গেঞ্জির কাপড়, শার্ট, প্যান্ট ও গার্মেন্টস সামগ্রীর দোকান ছিল। মার্কেটের বেশিরভাগ দোকান ছোট সাইজের হলেও কিছু দোকান একসঙ্গে সংযুক্ত করে নির্মাণ করা হয়েছিল, যা গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

আরও পড়ুন>> অগ্নিনির্বাপক না থাকায় একাধিক প্রতিষ্ঠানকে পুলিশের জরিমানা

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত কমিটি জানতে পারে— আকার ভেদে প্রতিটি দোকানে প্রায় চার থেকে ১৫ লাখ টাকার মালামাল ছিল। সেই হিসাবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের প্রায় ২২২ কোটি ৭ লাখ টাকার মালামাল আগুনে পুড়ে গেছে। এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেটের বেশিরভাগ দোকান গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মহানগর শপিং কমপ্লেক্স মার্কেটটির ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের আর্থিক মূল্য প্রায় ৫৯ কোটি ৩ লাখ টাকা এবং বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ১১ কোটি ও বঙ্গ হোমিও মার্কেটের আনুমানিক ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের আর্থিক মূল্য প্রায় ৬ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। সব মিলে ২৮৮ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মালামাল আগুনে পুড়েছে। এছাড়া এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেটের প্রতিটি দোকান বিমা করা আছে বিদায়, তাদের ক্ষতির পরিমাণ এ হিসাবে ধরা হয়নি।

অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা ছিল না, অগ্নিকাণ্ডের কারণ অজানা

গত ৫ এপ্রিল দুপুরে অগ্নিকাণ্ডের স্থান পরিদর্শন করেন তদন্ত কমিটির সদস্যরা। মার্কেটের ভেতর অবকাঠামো ও অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটনের বিষয়ে মার্কেট সমিতির নেতা, সাধারণ ব্যবসায়ী, দারোয়ান, নাইটগার্ড, ইলেকট্রিশিয়ান, সমিতির পিয়নসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বঙ্গবাজারে (বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট ও আদর্শ ইউনিট) এবং মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের ভেতর অবকাঠামো টিন, লোহার এঙ্গেল ও কাঠ দ্বারা নির্মিত। আদর্শ ইউনিট ও মহানগরী ইউনিটের মাঝখানে উত্তর দক্ষিণ বরাবর দশ ফুট প্রশস্ত একটি গলি আছে। এছাড়া অন্য ইউনিট বা মার্কেটের দোকানের মধ্যে সরু পথ ছিল। সবগুলো মার্কেটই তিনতলা বিশিষ্ট। তবে আদর্শ ইউনিটের তিনতলার ওপরে নিরাপত্তা প্রহরী ও বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিদের থাকার জন্য চারতলা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটগুলোতে প্যান্ট, গেঞ্জি, লুঙ্গি, শাড়ি, জ্যাকেট, শীতের পোশাকসহ তৈরি পোশাক বিক্রয় করা হতো এবং এসব পোশাক রাখার জন্য অনেকগুলো গোডাউন ছিল। মার্কেটের সব আইটেমই ছিল অগ্নিদাহ্য। মার্কেটগুলো অগ্নিকাণ্ডের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও সেখানে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যব্যবস্থা ছিল না। তবে, ঠিক কোন জায়গা থেকে আগুনের সূত্রপাত তা সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।

আরও পড়ুন>> ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা চূড়ান্ত, মোট ব্যবসায়ী ৩ হাজার ৮৪৫

তবে, এ অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা তা জানার চেষ্টা করছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদন বলা হয়, ঘটনার রাতে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটের সব প্রধান ফটক বন্ধ ছিল এবং নিরাপত্তা প্রহরীরা সবাই দায়িত্বরত অবস্থায় ছিল। ঘটনার সময় বাইরের কোনো লোক মার্কেটের ভেতরে অবস্থান করেনি। বঙ্গবাজার আদর্শ ইউনিটের তৃতীয় তলার যে এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে আগুনের সূত্রপাত বলা হচ্ছে, সেটি মার্কেটের বেশ ভেতরে উত্তর-পূর্ব দিকে পুলিশ হেড কোয়ার্টার সংলগ্ন। নাশকতার উদ্দেশ্যে কেউ এরকম একটি জায়গায় আগুন লাগানোর পরিকল্পনা করা অযৌক্তিক।

তদন্ত কমিটির সুপারিশ

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে বেশকিছু সুপারিশ করেছে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে ডিএসসিসি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকেও অনুরোধ জানিয়েছে কমিটি।

সুপারিশগুলো হলো— ডিএসসিসির আওতাধীন কোনো এলাকায় কাঠের বা টিনের মার্কেট থাকা সমীচীন নয়। যদি থেকে থাকে তা দ্রুত কংক্রিট বা পাকা করার ব্যবস্থা করতে হবে। ডিএসসিসির মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশারসহ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এগুলো ব্যবহারে কর্মরত কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়মিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিদর্শন করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা সচল আছে কি না যাচাই করে সনদ দেওয়া। সেই সনদ দৃশ্যমান স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে ওয়াটার রিজার্ভার থাকতে হবে এবং এটা থেকে পাইপের মাধ্যমে যুক্ত করে মার্কেটের চারটি স্থানে ওয়াটার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মার্কেটগুলোর ভেতরের চলাচলের গলি বা রাস্তাগুলো পর্যাপ্ত জায়গা রেখে করা দরকার।

আরও পড়ুন>> চৌকি বসিয়ে ব্যবসার সুযোগ দিতে প্রস্তুত হচ্ছে বঙ্গবাজার

এছাড়া মার্কেটগুলোতে বৈদ্যুতিক সংযোগ, ভোল্ট ক্যাপাসিটি ও ব্যবহারের মধ্যে সামঞ্জস্য সঠিক বা পর্যাপ্ত রয়েছে কি না তা সর্বদা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা, খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট, মসজিদ, থাকার কারণে এগুলো মার্কেটের বাইরে বা এক পাশে রাখা, মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী, বিদ্যুৎকর্মী, সচেতনতা ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা থাকা, বৈদ্যুতিক সংযোগের জন্য মানসম্মত তার (ক্যাবল) ব্যবহার করা ও সিটি করপোরেশন অধিভুক্ত সব জলাধার সংরক্ষণ করার সুপারিশ করা হয়।

এমএমএ/এমএএইচ/জেআইএম