মতামত

এ পৃথিবী একবার পায় তাঁরে…

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক সিনেমা বানানো হয়েছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরো অনেক সিনেমা বানানো হবে। সিনেমা বানাতে গেলেই আমরা একজন হিরো খুঁজি, একজন বর্ণাঢ্য চরিত্রের মানুষ খুঁজি। কিন্তু চোখের সামনে থাকা অনেক বীরকে আমরা চিনতেই পারি না।

Advertisement

সদ্য প্রয়াত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন তেমনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন নিরেট দেশপ্রেমিক। বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ এসেছে, আরো কোটি কোটি মানুষ আসবে। আমরা বেশিরভাগ মানুষই সাধারণ, স্রোতের অনুকূলে চলা মানুষ। কিছু মানুষ থাকেন ব্যতিক্রম। বিপদ জেনেও তারা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটেন। ডা. জাফরুল্লাহ তেমনই একজন ব্যতিক্রমী মানুষ।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিলাতে মানে লন্ডনে গিয়েছিলেন এফআরসিএস পড়তে। চার বছরের পড়া শেষে এক সপ্তাহ পর যখন চূড়ান্ত পরীক্ষা, তখন শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। বেশির ভাগ মানুষই আগে পরীক্ষাটা দিতেন। কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন অন্যরকম। এফআরসিএস পরীক্ষা নয়, তাঁর কাছে দেশটাই আগে। উচ্চতর ডিগ্রি, উন্নত জীবনের হাতছানি ছুঁড়ে ফেলে তিনি অবস্থান নিলেন বাংলাদেশের পক্ষে। প্রবাসে যারা বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন, তারা বেশিরভাগই সেখানে থেকেই জনমত গঠন করেছেন। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ব্যতিক্রমেরও ব্যতিক্রম।

পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে জীবনের ঝুঁকি মাথায় করে যেভাবে লন্ডন থেকে দিল্লি পৌঁছেছেন, তা সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। বিলাতি ডিগ্রি, নিশ্চিত ক্যারিয়ার সব পেছনে ফেলে আগরতলার মেলাঘরে প্রতিষ্ঠা করেন ফিল্ড হাসপাতাল, যে হাসপাতাল বাঁচিয়েছে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার জীবন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একাত্তরেই মুক্তিযুদ্ধ শেষ করেননি। মুক্তিযুদ্ধ শেষে শুরু করেছেন নতুন যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতালটিকেই পরে ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামে স্থাপন করেন স্বাধীন বাংলাদেশে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি উন্নত, গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লড়াই তিনি চালিয়ে গেছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

Advertisement

বর্তমান সরকার ছাড়া আর সব সরকারের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। ‘গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র’ নামটি বঙ্গবন্ধুর দেওয়া, আর সাভারে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জমিও দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের দুই সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এইচ এম এরশাদের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। এ ধরনের মানুষকে সবাই সুবিধাবাদী বলেন। কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরী সুবিধাবাদী ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। সব সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও তিনি কারো কাছ থেকে ব্যক্তিগত কোনো সুবিধা নেননি। মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ বারবার প্রত্যাখ্যান করেছেন। কাজ করেছেন দেশের জন্য। এরশাদ আমলে তাঁর চেষ্টায় প্রণীত ঔষধ নীতি বাংলাদেশের ঔষধ শিল্পের ভিত্তি। বাংলাদেশ যে আজ ঔষধ রপ্তানিও করে সেটার কৃতিত্ব জাফরুল্লাহ চৌধুরীর।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তাঁর প্রতিষ্ঠিত হলেও মালিকানা তাঁর ছিল না। দৃশ্যমান কোনো পেশা ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক মানুষ বিলাসী জীবনযাপন করেন। আর সব সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জাফরুল্লাহ চৌধুরী যাপন করে গেছেন অতি সাধারণ এক জীবন। ছেড়া শার্ট, পুরোনো স্যান্ডেল পায়ের জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের কিংবদন্তী। লন্ডনে পড়ার সময় তিনি ব্র্যান্ডের পোশাক পরতেন, দামী গাড়ি চালাতেন। মুক্তিযুদ্ধ তার জীবন ভাবনাকে বদলে দিয়েছিল চিরতরে। শুধু নিজেকে বদলে বসে থাকেননি। পুরোপুরি না পারলেও দেশটাকে বদলানোর চেষ্টা করে গেছেন নিরন্তর।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী আসলে একের ভেতরে অনেক। তিনি একজন ডাক্তার। শুধু ডাক্তারি করলে তিনি হতে পারতেন দেশের সেরা ডাক্তারদের একজন। তিনি একজন উদ্যমী সংগঠক, যিনি দাঁড় করিয়েছেন গণস্বাস্থ্যের মতো একটি প্রতিষ্ঠান। তার হাসপাতালে অল্প পয়সায় চিকিৎসা হয়। মাত্র দুই হাজার টাকায় ডায়ালাইসিস হয়।

তিনি একজন অ্যাকাডেমিশিয়ান, তার লেখা বই বিশ্বের অনেক দেশে এমবিবিএস শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। তিনি একজন গবেষক, তার গবেষণাকর্ম ছাপা হয়েছে বিশ্বের অনেক নামি জার্নালে। নোবেল ছাড়া বিশ্বের প্রায় সব সম্মানজনক পুরস্কার রয়েছে তার ঝুলিতে। কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে কাছ থেকে দেখলে আপনি বিশ্বাসই করবেন না, এই সাদাসিধা, ভোলাভালা, ‘আনস্মার্ট’ লোকটিরই এত গুণ।

Advertisement

ডা. জাফরুল্লাহ সবচেয়ে বড় গুণ আমি মানি তাঁর অকপটতা। কঠিন কঠিন ন্যায্য কথাও বলে ফেলতেন অবলীলায়, নির্ভয়ে। যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন। দুটি অকেজো কিডনি নিয়ে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ দিনগুলো। সুযোগ ছিল কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের। কিন্তু দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে রাজি ছিলেন না তিনি। এমনকি নিজের প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতেও যাননি।

তার মত ছিল, নিজের হাসপাতালে, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় যদি তিনি নিজেই আস্থা রাখতে না পারেন, তাহলে সাধারণ মানুষ তাতে ভরসা পাবে কীভাবে। গোঁয়ারের মত দেশকে ভালো না বাসলে আরো কিছু বেশি দিন বাঁচতে পারতেন। কিন্তু আরো বেশি দিন বাঁচা নয়, তাঁর লক্ষ্য ছিল বাঁচার মত বাঁচা। জীবনে কখনো এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাসের সাথে আপস করেননি।

একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। একজন ডাক্তার হিসেবে তিনি অনুকরণীয়। একজন উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি অসংখ্য মানুষের অনুপ্ররেণা। একাডেমিশিয়ান হিসেবেও তিনি বেঁচে থাকবেন। কিন্তু ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে আমার বেশি পছন্দ ছিল তাঁর রাজনীতি সচেতনতার কারণে। এ বয়সে তার মতো গুণের অধিকারী অধিকাংশই রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। কোনও বিতর্কে জড়াতে চান না। দেশটাকে রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে থাকেন।

আমাদের গুণী মানুষেরা দেশের প্রয়োজনে, দেশের বিপদে কখনও সামনে আসেন না, কথা বলেন না। অথচ শেষ পর্যন্ত রাজনীতিবিদরাই দেশ চালান। তাই দেশকে ভালোবাসলে, দেশের উন্নতি চাইলে রাজনীতিকে ঠিক পথে রাখতে হলে সবাইকে কথা বলতে হবে। গুণী মানুষদের রাজনৈতিক নির্লিপ্ততার এই জোয়ারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।

রাজনীতি সচেতন অন্য সুশীল বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনি দূরে থেকে বিবৃতি দিয়ে, কলাম লিখে, টকশো করেই দায়িত্ব শেষ করেন না। বরং রাজনীতির মাঠে দারুণ সক্রিয় ছিলেন তিনি। এমনকি হুইল চেয়ারে বসেও যোগ দিয়েছেন সভা-সমাবেশে। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টে রাজি না হওয়ায় সপ্তাহে ৩/৪ দিন ডায়ালিসিস করতে হতো তাঁকে। ডায়ালিসিসের সময়ও সময়ও পড়াশোনা, কথাবার্তা চালিয়ে গেছেন। ডায়ালিসিস সেরেই ছুটেছেন টক শো বা মানববন্ধনে। এমনকি রাজনৈতিক কারণে ডায়ালিসিসের সময় পিছিয়ে দিয়েছেন।

শেষ জীবনে ছিলেন সরকারের কঠোর সমালোচক। আর এই সমালোচনার বেশিরভাগই যৌক্তিক। রাজনীতি সচেতন এবং সরকারের কট্টর সমালোচক হলেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। বর্তমান সরকারের কট্টর সমালোচক বলে অনেকেই তাকে বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী বলে অভিহিত করতেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে। সেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মূল কারিগরদের একজন ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত; হয় আওয়ামী লীগ, নয় বিএনপি। বেশিরভাগেরই বিবেক বন্ধক থাকে কোনো না কোনো দলের কাছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন এই দলীয় বিভক্তির ঊর্ধ্বে। তিনি চলতেন তাঁর বিবেক দিয়ে। তাঁর মত এমন সাহসী মানুষ আমি খুব বেশি দেখিনি। টানা ক্ষমতায় থাকায় শেষ সময়ে তার সমালোচনার তীর বেশি সইতে হয়েছে আওয়ামী লীগকে। কিন্তু বিএনপিকেও তিনি ছাড়তেন না। যৌক্তিক সমালোচনার কঠিন তীর ছুটে গেছে বিএনপির দিকেও। বিশেষ করে লন্ডনে থেকে তারেক রহমানের রাজনীতি করার কট্টর সমালোচক ছিলেন।

আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচক হয়েও বিএনপির বন্ধু হতে পারেননি, আসলে চানওনি। এমনকি মির্জা ফখরুলকে বিবৃতি দিয়ে বলতে হয়েছে, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিএনপির কেউ নন। ডা. জাফরুল্লাহ আসলে নিজে যা ভালো বুঝতেন, কাউকে পাত্তা না দিয়ে তাই করতেন, বলতেন। তাই একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগেরও অপছন্দের, বিএনপিরও অপছন্দের ছিলেন। শেষ জীবনে, আওয়ামী লীগ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বিএনপি বানাতে মরিয়া ছিল। আবার বিএনপিও তাকে ঝেড়ে ফেলতে ব্যাকুল ছিল।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শূন্যতা আসলেই কখনো পূরণ হবে না। কারণ স্বার্থ চিন্তা বাদ দিয়ে নির্ভয়ে সত্য কথা বলার মত মানুষ আর নেই। আমরা হারালাম একজন অসমসাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে, একজন নিরেট দেশপ্রেমিককে, একজন সত্যিকারের কিংবদন্তিকে। আমরা ভাগ্যবান, তাঁর সময়ে আমরা বেঁচেছিলাম, তাঁকে আমরা দেখেছি।১২ এপ্রিল, ২০২৩

লেখক: বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/এএসএম