ধর্ম

ইতেকাফ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

মোহাম্মদ হাসিব উল্লাহ

Advertisement

রমজান মাস, মুসলিম জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এই মাসে মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যেক মুমিনের জন্য ক্ষমা, রহমত লাভ প্রভৃতির ঘোষণা করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় এই মাসের শেষ দশক ‘নাজাতের দশ দিন’ হিসেবে স্বীকৃত। এই শেষ দশকে ফরজ ইবাদত ছাড়া অন্যান্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত রয়েছে, তন্মধ্যে ইতেকাফ অন্যতম। ইতেকাফ আরবি ভাষার শব্দ। আরবি ‘আকফুন’ মূল ধাতু থেকে ইতেকাফ শব্দটি গঠিত হয়েছে। যার অর্থ: বিচ্ছিন্নতা, কোন স্থানে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা প্রভৃতি। শরিয়তের পরিভাষায়, ‘বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মসজিদে অবস্থান ও আল্লাহর ইবাদতে নিজেকে ব্যস্ত রাখাই হচ্ছে ইতেকাফ।’

পবিত্র কোরআনেও ইতেকাফ শব্দটির ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَعَهدۡنَاۤ اِلٰی اِبۡرٰهمَ وَاِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَهرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَالۡعٰکِفِیۡنَ وَالرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ

Advertisement

অর্থাৎ আমি ইবরাহিম ও ইসমাঈলের কাছে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আমার ঘরকে তাওয়াফকারী ও ইতেকাফকারী এবং রুকু ও সেজদাহকারীদের জন্য পবিত্র রেখো। (সুরা বাকারা: আয়াত ১২৫)

এছাড়াও আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে ইতেকাফকারীদের উদ্দেশ্যে আরও ঘোষণা করে বলেন-

وَلَا تُبَاشِرُوۡهنَّ وَاَنۡتُمۡ عٰکِفُوۡنَ ۙ فِی الۡمَسٰجِدِ ؕ تِلۡك حُدُوۡدُ اللّٰه

‘আর তোমরা স্ত্রীদের শরীর স্পর্শ করবে না, যখন তোমরা মসজিদতে ইতেকাফরত থাকো।’ (সূরা বাকারা: ১৮৭)

Advertisement

তবে এই ইতেকাফের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। যা নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসে স্বীকৃত-

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন-

أَنَّ النَّبِيَّ (صلى الله) كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ

‘নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন। তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল।’ (বুখারি ২০২৬)

এছাড়া রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক ইন্তেকালের বছরে বিশ দিন রোজা রাখার ব্যাপারটিও হাদিসে পাকে ওঠে এসেছে-

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন-

كَانَ يَعْرِضُ عَلَى النَّبِيِّ (صلى الله) الْقُرْآنَ كُلَّ عَامٍ مَرَّةً فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرَّتَيْنِ فِي الْعَامِ الَّذِيْ قُبِضَ فِيْهِ وَكَانَ يَعْتَكِفُ كُلَّ عَامٍ عَشْرًا فَاعْتَكَفَ عِشْرِيْنَ فِي الْعَام الَّذِيْ قُبِضَ فِيْهِ،

অর্থাৎ প্রতি বছর জিবরিল আলাইহিস সালাম নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে একবার কোরআন মাজিদ শোনাতেন ও শুনতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দুবার শুনিয়েছেন। প্রতি বছর নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানে দশ দিন ইতেকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর তিনি বিশ দিন ইতেকাফ করেন।’ (বুখারি ৪৯৯৮)

ইতেকাফের বিধিসম্মত সময় হচ্ছে, বিশ রমজান তারিখে সূর্যাস্ত যাওয়ার কিছু আগে থেকে শুরু করে ২৯ অথবা ৩০ রমজান তারিখে অর্থাৎ ঈদের চাঁদ আকাশে উদিত হওয়ার সময় পর্যন্ত নির্ধারিত। এজন্য ইতেকাফকারী বিশ রমজান তারিখে সূর্যাস্তের আগেই মসজিদে পৌঁছাবে এবং মসজিদের কোণে অবস্থান নেবেন। ইতেকাফকারী কোরআন তেলাওয়াত থেকে শুরু করে তাসবিহ পাঠসহ যাবতীয় জিকির-আজকার পাঠ করতে পারেন।

তবে ইতেকাফে পূর্ণাঙ্গরূপে মনোনিবেশ করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। তন্মধ্যে রোজা রাখা, মসজিদে অবস্থান করা প্রভৃতি অন্যতম। যা একজন ইতেকাফকারীর জন্য অবশ্যই পালনীয়। হাদিসে পাকে এসেছে-

عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّهَا قَالَتِ السُّنَّةُ عَلَى الْمُعْتَكِفِ أَنْ لاَ يَعُودَ مَرِيضًا وَلاَ يَشْهَدَ جَنَازَةً وَلاَ يَمَسَّ امْرَأَةً وَلاَ يُبَاشِرَهَا وَلاَ يَخْرُجَ لِحَاجَةٍ إِلاَّ لِمَا لاَ بُدَّ مِنْهُ وَلاَ اعْتِكَافَ إِلاَّ بِصَوْمٍ وَلاَ اعْتِكَافَ إِلاَّ فِي مَسْجِدٍ جَامِعٍ،

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন, ইতেকাফকারীর জন্য সুন্নত হলো, ‘সে কোনো রোগী দেখতে যাবে না, জানাজায় অংশগ্রহণ করবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না, তার সঙ্গে সহবাস করবে না এবং অধিক প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাবে না, রোজা না রেখে ইতেকাফ করবে না এবং জামে মাসজিদে ইতেকাফ করবে।’ (আবু দাউদ ২৪৭৩)

শুধু তাই নয়, পুরুষদের পাশাপশি নারীরাও ইতেকাফে বসতে পারবে। এক্ষেত্রে তাদের জন্য উত্তম হচ্ছে, নিজ ঘরে নামাজের নির্দিষ্ট স্থানে অথবা ঘরের যেকোন পবিত্র স্থানে ইতেকাফ করা। যেমন হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন-

ثُمَّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ‏

‘এরপর তাঁর সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) ইতেকাফ করতেন।’ (বুখারি ৪৯৯৮)

তবে বিবাহিত নারীর জন্য ইতেকাফে মনোনিবেশ করতে হলে অবশ্যই স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। অন্যথায়, নারীর জন্য ইতেকাফ বৈধ হবে না। এক্ষেত্রে প্রত্যেক স্বামীর উচিত, তাঁর স্ত্রীকে ইতেকাফের অনুমতি প্রদান করা।

পাশাপাশি ইতেকাফের বহুবিধ ফজিলত তাৎপর্য রয়েছে। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আল্লাহর ঘরের মেহমান হিসেবে অবস্থান এবং ইবাদতে মগ্ন থাকতে পারে। এমনকি গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভের পাশাপাশি অসংখ্য নেকি অর্জনেরও সুযোগ রয়েছে। হাদিসে পাকে এসেছে-

عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ (صلى الله) قَالَ فِي الْمُعْتَكِفِ هُوَ يَعْكِفُ الذُّنُوبَ وَيُجْرَى لَهُ مِنْ الْحَسَنَاتِ كَعَامِلِ الْحَسَنَاتِ كُلِّهَا،

হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতেকাফকারী সম্পর্কে বলেন, ‘সে নিজেকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সব নেকি তার জন্য লেখা হয়।’ (ইবনে মাজাহ ১৭৮১)

অনুরূপভাবে, ভিন্ন আরেকটি হাদিসে ইতেকাফের মাধ্যমে মহান রবের সন্তুষ্টি পাওয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

ﻭَﻣَﻦِ ﺍﻋْﺘَﻜَﻒَ ﻳَﻮْﻣًﺎ ﺍﺑْﺘِﻐَﺎﺀَ ﻭَﺟْﻪِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﺟَﻌَﻞَ ﺍﻟﻠَّﻪُ ﺑَﻴْﻨَﻪُ ﻭَﺑَﻴْﻦَ ﺍﻟﻨَّﺎﺭِ ﺛَﻠَﺎﺙَ ﺧَﻨَﺎﺩِﻕَ، ﻛُﻞُّ ﺧَﻨْﺪَﻕٍ ﺃَﺑَﻌْﺪُ ﻣِﻤَّﺎ ﺑَﻴْﻦَ ﺍﻟْﺨﺎﻓِﻘَﻴْﻦِ

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার আশায় মাত্র একদিনের জন্য ইতেকাফে থাকবে, আল্লাহ পাক তার এবং জাহান্নামের মধ্যে তিন খন্দক পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করে দেন। এক একটি খন্দকের গভীরতা হলো আসমান ও জমিনের মধ্যকার দূরত্বের অধিক।’ (তারগিব ওয়াত তারহিব ৪/৩৪৪)

এছাড়াও, ইতেকাফের মাধ্যমে আরেকটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদর বা শবে কদরের রাত অনুসন্ধান করা। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস দ্বারা স্বীকৃত যে, লাইলাতুল কদরের রাত রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতের যে কোনো একটি হবে। যেমন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-

فَالْتَمِسُوهَا فِي الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ، وَالْتَمِسُوهَا فِي كُلِّ وِتْرٍ

‘তোমরা উহা (লাইলাতুল কদর) শেষ দশকে তালাশ কর এবং প্রত্যেক বেজোড় রাতে তালাশ কর।’ (বুখারি ২০২৭)

এজন্য ইতেকাফকারী রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাতে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকার মাধ্যমে, সহজেই কদরের রাত পেতে পারে। কেননা এই রাতকে উত্তম রাত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

لَیۡلَة الۡقَدۡرِ خَیۡرٌ مِّنۡ اَلۡفِ شَهرٍ

‘কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।’ (সুরা কদর: আয়াত ৩)

তবে ইতেকাফের হুকুম কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। যেমন ওয়াজিব, সুন্নত, নফল প্রভৃতি। এক্ষেত্রে রমজান মাসের ইতেকাফের হুকুম হচ্ছে সুন্নতে মুয়াক্কাদায়ে কেফায়া। শরিয়তের আলোকে এর বিধান হচ্ছে, এই জাতীয় বিধান এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে যে কোনো একজনকে অবশ্যই আদায় করতে হবে। সবাই আদায় করা জরুরি নয়।

তবে কেউ যদি আদায় না করে, তাহলে সবাই গুনাহগার হবে। এজন্য নির্ধারিত সময়ের আগেই, অন্যদের ইতেকাফে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যেন এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে একজন হলেও ইতেকাফে মনোনিবেশ করেন।

জেনে রাখা আবশ্যক যে, অর্থ বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতেকাফ করা জায়েজ নেই। ইসলামি শরিয়তে কঠোরভাবে ইহার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে এবং এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামও একমত পোষণ করেছেন। তাই, এহেন কার্যাবলী হতে সবার বিরত থাকা আবশ্যক। অন্যথায়, গুনাহগার হতে হবে।

আল্লাহ তাআলা সবার সৎ কর্মকে কবুল করুন। আমিন।

লেখক: তরুণ গবেষক।

এমএমএস/এএসএম