ধর্ম

মুমিন রোজাদারের ইতেকাফ

একটি মহান ইবাদত ইতেকাফ। এতে ঈমানদার রোজাদারের ঈমান বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ইতেকাফে রোজাদার বান্দা নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য দুনিয়ার অন্যান্য সব বিষয় থেকে আলাদা করে নেয়। সব রোজাদারের উচিত, রমজানের শেষ দশকের এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের ঈমানি চেতনাকে প্রাণবন্ত করে তোলা।

Advertisement

ইতেকাফ এমন এক ইবাদত। যার ফলে ইতেকাফকারীর অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। দুনিয়া গর্হিত ও প্রতিটি খারাপ কাজের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। ইতেকাফের কারণে প্রবৃত্তির চাহিদা লোপ পায়। ফলে কোরআন তেলাওয়াত ও দ্বীনি কথাবার্তা নিজের কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠে। অন্তর হয় কলুষমুক্ত। এভাবে ইতেকাফ একজন মুমিনের ঈমানকে সতেজরূপে গড়ে তোলে।

ইতেকাফ কী?

ইতেকাফ অর্থ—কোনো স্থানে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। শরিয়তের পরিভাষায়—বিশেষ নিয়তে বিশেষ অবস্থায় আল্লাহ তাআলার আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করাকে ইতেকাফ বলা হয়।

Advertisement

ইতেকাফের প্রকার

১. ওয়াজিব

ইতেকাফ করার জন্য মানত করা হলে তা পূর্ণ করা ওয়াজিব। এই ইতেকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। রোজাবিহীন ওয়াজিব ইতেকাফ আদায় হবে না।

২. সুন্নতে মুয়াক্কাদা কেফায়া

Advertisement

রমজানের শেষ দশ দিন ইতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা কেফায়া। অর্থাৎ মসজিদের অধিবাসীদের মধ্যে কোনো একজন ইতেকাফ করলে, অন্য লোকেরা গুনাহ থেকে বেঁচে যাবে। আর যদি কেউ না করে, তখন সবাই গুনাহগার হবে। এই ইতেকাফের জন্যও রোজা শর্ত। এটি বিশ রমজানের সূর্যাস্ত থেকে উনত্রিশ বা ত্রিশ রমজানে ঈদুল ফিতরের চাঁদ উদয় হওয়া পর্যন্ত বাকি থাকে।

৩. মুস্তাহাব

ওয়াজিব ও সুন্নত ইতেকাফ ছাড়া অপর ইতেকাফ মুস্তাহাব। এর জন্য রোজা শর্ত নয়। আর এ ইতেকাফের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়ও নেই। (হেদায়া : ১/২২৯, ফতোয়ায়ে শামি : ২/১৭৮)।

কোরআনে ইতেকাফের গুরুত্ব

পবিত্র কোরআন মানবজাতির সব বিষয়ের পথপ্রদর্শক। কোরআন ছাড়া মুমিনের জীবন অচল। সে হিসেবে ইতেকাফের আলোচনাও মহাগ্রন্থ আল কোরআনে উল্লেখিত হয়েছে। যা একজন মুমিনের অন্তরে ইতেকাফ করার প্রতি অধিক আগ্রহ সৃষ্টি করবে। ঈমানকে বলবান করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ عَهِدۡنَاۤ اِلٰۤی اِبۡرٰهٖمَ وَ اِسۡمٰعِیۡلَ اَنۡ طَهِّرَا بَیۡتِیَ لِلطَّآئِفِیۡنَ وَ الۡعٰکِفِیۡنَ وَ الرُّکَّعِ السُّجُوۡدِ

‌‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলের কাছে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী ও ইতেকাফকারী এবং রুকু ও সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।’ (সুরা বাকারা : ১২৫)।

ইতেকাফের ফজিলত

হাদিসে পাকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা দেন-

‘যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যে এক দিন ইতেকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন পরিখা (খন্দক) দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। অর্থাৎ আসমান ও জমিনের মাঝে যত দূরত্ব আছে তার চেয়েও বেশি দূরত্ব সৃষ্টি করে দেবেন।’ সুবহানাল্লাহ! (বায়হাকি, কানযুল উম্মাল: ২৪০১৯)

ইতেকাফ পালনকারী দুই কবুল হজ ও দুই ওমরার সাওয়াব পাবেন। ইতেকাফের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা দেন-

‘যে ব্যক্তি রমজানে দশ দিন ইতেকাফ করবে তার আমল নামায় দুইটি কবুল হজ ও দুইটি ওমরার সমতুল্য সওয়াব লিখা হবে।’ (শুআবুল ইমান ৩৬৮১, কানযুল উম্মাল ২৪০০৬)

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন, ‘ইতেকাফকারী ইতেকাফের কারণে গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং সব নেকির সওয়াব অর্জন করে।’ (আল মুগনি ৩/৪৫৫)

অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে জামাত প্রতিষ্ঠিত হয় এমন মসজিদে ইতেকাফে থাকবে, নামাজ এবং কোরআন তেলাওয়াত ছাড়া কোনো কথা বলবে না, তার জন্য বেহেশতে মহল তৈরি করা আল্লাহর দায়িত্ব হয়ে যাবে।’ (কাশফুল গুম্মাহ ১/২১২)

একজন মুসলমান ইতেকাফ পালন করার কারণে দুনিয়ার যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্ত থাকে। সাধারণত লোকেরা চোখের কুদৃষ্টির কারণেই ছোট-বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ইতেকাফের দরুণ চোখের দৃষ্টি হেফাজত হয়। সেই সঙ্গে অন্তরও পরিশুদ্ধ হয়ে যায়। আর ইতেকাফকারীর সওয়াব বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেন, ‘সে গুনাহগুলো থেকে বেঁচে থাকে এবং তার জন্য সওয়াব লেখা হয় ওই ব্যক্তির মতো, যে বাইরে অবস্থান করে যাবতীয় ভালো কাজ করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১৮৫৩)

নারীর ইতেকাফ

ইসলাম মুমিন নারীদের পুরুষের মতো ইতেকাফ পালন করার অনুমতি দিয়েছে। তবে পুরুষরা মসজিদে ইতেকাফ পালন করবে। আর নারীরা আপন ঘরের নির্জন স্থানে ইতেকাফ করবে। যাতে একজন মুমিন নারী রমজান মাসে ইতেকাফ করার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করতে পারে। মেয়েদের ইতেকাফের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে-

হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকাল পর্যন্ত রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। অতঃপর তার স্ত্রীরাও ইতেকাফ করেছেন।’ (বুখারি ২০৬৫, মুসলিম ২৮৪১)

ইতেকাফের আমল

সাধারণত একজন মুসলমান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার লক্ষ্যে ইতেকাফ করে। ইতেকাফকারী সবসময় ইবাদতে লিপ্ত থাকে। দুনিয়ার সমুদয় ব্যস্ততাকে বাদ দিয়ে শুধু আল্লাহর নৈকট্য লাভের সাধনায় থাকে। তাই ইতেকাফকারীকে কোরআন তেলাওয়াত, জিকির, দুরুদ পাঠে মশগুল থাকা চাই। এ ছাড়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পাশাপাশি তাহাজ্জুদ, আওয়াবিন, এশরাক, চাশত ইত্যাদি সুন্নত নামাজও বেশি পরিমাণে নিয়মিত আদায় করতে পারে। ইতেকাফ অবস্থায় রাসুল (সা.) বেশি পরিমাণে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। হাদিসে পাকে এসেছে-

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উদার মনের। আর তার এ উদারতা রমজান মাসে অধিক পরিমাণে বেড়ে যেত। রমজান মাসে প্রত্যেক রাতেই জিবরিল আলাইহিস সালাম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কোরআন শোনাতেন।’ (বুখারি ১৯৩৬)

এমএমএস/জেআইএম