মতামত

প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে

দেশে ফের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) ঢাকার বঙ্গবাজারে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বঙ্গবাজারের চারটি মার্কেটসহ আশপাশের সব দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবিসহ ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুন লাগার কারণ এখনও জানা যায়নি। কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তাও জানা যায়নি। অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়-ক্ষতি নিরুপণে ইতিমধ্যে কমিটি গঠিত হয়েছে।

Advertisement

দেশে প্রতি বছরই অনাকাঙ্ক্ষিত অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। আর এই অগ্নি দুর্ঘটনা কেড়ে নেয় বহু প্রাণ। অসংখ্য মানুষ আহত হয়। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ। অপ্রত্যাশিত এই আগুন দুর্ঘটনা থামবে বলে মনে হয় না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় বঙ্গবাজারে এটাই প্রথম অগ্নি দুর্ঘটনা নয়। এর আগেও এ বাজারে একাধিকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের পর সতর্কবার্তা জারি করা হলেও কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি।

১৯৯৫ সালে একবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় বঙ্গবাজার। পরে নতুন মডেলে বাজারটি নির্মাণ করা হয়। এর পরিধিও বেড়েছে অপরিকল্পিতভাবে। বঙ্গবাজারকে চারটি ইউনিটে ভাগ করা হয়েছে- বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট এবং আদর্শ ইউনিট। জানুয়ারি ২০১৭ সালে, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের একটি পরিদর্শন কমিটি বঙ্গবাজারের চারটি ইউনিটকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। এ ব্যাপারে বাজার কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সতর্কও করা হয়।

একই বছরের মে মাসে বঙ্গবাজারের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে বাজার কর্তৃপক্ষকে আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সুপারিশ বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতে নোটিশ দেয়। তবে নোটিশের আট মাস পর ডিসেম্বরে দ্বিতীয় দফায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিট পুনঃতদন্তে আবারও বাজারের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

Advertisement

এরপর, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০০৬ এবং ফায়ার প্রিভেনশন অ্যান্ড এক্সটিংগুইশিং অ্যাক্ট-২০০৩ অনুযায়ী, বাজার কর্তৃপক্ষকে আবারও অবহিত করা হয় এবং বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, গুলিস্তান ইউনিট, মহানগর ইউনিট এবং আদর্শ ইউনিটে অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

২০১৮ সালের ২৪ জুলাই বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের গুলিস্তান ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস মার্কেট কর্তৃপক্ষকে দুটি নোটিশ দেয়।

বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও ২০১৮ সালে গুলিস্তান ইউনিটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ২০১৯ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে, বঙ্গবাজার কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিদর্শন কমিটির নির্দেশনা মানেনি। ইট, সিমেন্টের পিলার থাকলেও পুরো বাজার টিন ও কাঠের তৈরি। মার্কেটের বিভিন্ন স্পটে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকলেও ধোঁয়া বা তাপ শনাক্তকারী যন্ত্র, ফায়ার হোজ রেল, পাম্প, ফায়ার অ্যালার্ম বা অন্য কোনো ব্যবস্থা ছিল না।

রাজধানীর ১ হাজার ৩০৫টি অগ্নিপ্রবণ দোকানের মধ্যে গুলিস্তানের বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি ইউনিট বেশি অগ্নিপ্রবণ বলে বিবেচিত হয়। তবে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেট কর্তৃপক্ষের দাবি ছিল, বঙ্গবাজারে আগুনের কোনো ঝুঁকি নেই।

Advertisement

যে কোনো দুর্ঘটনার পর আমরা দুটি কাজ দ্রুত করি। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা এবং দ্বিতীয়টি হতাহতদের সহায়তা করা। কিন্তু কিছু দিন পর আমরা সব ভুলে যাই। অনেক তদন্ত প্রতিবেদন কখনো প্রকাশিতও হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আসল কারণ বেরিয়ে আসে না। আর বিভিন্ন কারণে ভালো তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হয় না। সরকার চাইলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যবস্থা নিতে পারে না। বঙ্গবাজারের উন্নয়নে আইনি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে। রাজধানীতে প্রায়ই গ্যাসের চুলা, খোলা চুলা, শর্ট সার্কিট, বিড়ি, সিগারেটের আগুন, গ্যাস লাইনে ছিদ্র, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক স্থাপনা বা যন্ত্রাংশ, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের দোকান ইত্যাদি কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও আগুন লাগার কারণ হিসেবে দেখা যায় অসাবধানতা, দুর্বল বৈদ্যুতিক সংযোগ, বৈদ্যুতিক ভোল্টেজের ওঠানামা, যন্ত্রপাতির ঘর্ষণ এবং গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ।

যেকোনো অগ্নিকাণ্ডের পর তা নেভানো ও উদ্ধারকাজ চালানো জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সরু রাস্তা দিয়ে উদ্ধারকারী সরঞ্জাম পৌঁছানোর সমস্যা এবং রাজধানীর খালগুলোতে পানির অভাবের কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হয়। ফলে আগুনে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভবনে অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা না থাকায়ও অগ্নি নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়।

তবে আমরা একটু সচেতন হলে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো যেত, নয়তো ক্ষয়ক্ষতির হার কমানো যেত। অগ্নি প্রতিরোধক উপকরণ খুব ব্যয়বহুল নয়। অনেক সময় অবহেলার কারণে পুরোনো সামগ্রী পরিবর্তন করা হয় না। আবার ভালো মানের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা গেলে দুর্ঘটনাও কমে যেত। কিছু টাকা বাঁচাতে আমরা প্রায়ই নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করি।

বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কীভাবে ঘটলো তা এখনও সঠিকভাবে জানা যায়নি। দেশে বছরে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে শর্ট সার্কিটের কারণে। রাস্তাঘাট থেকে বাড়ি বা আধুনিক শপিং মলে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা অনেকাংশে উপেক্ষিত। আর এতেই প্রাণহানি ঘটছে বলে ফায়ার সার্ভিস সংশ্লিষ্টরা বলছেন।

শুধু বাড়িতেই নয়, এর আগেও বহুবার মার্কেট বা শপিংমলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। শর্ট সার্কিট এসব ঘটনার প্রধান কারণ ছিল। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বেশির ভাগ অগ্নিকাণ্ডই শর্ট সার্কিটের কারণে হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শর্ট সার্কিটের কারণে বেশিরভাগ অগ্নিদুর্ঘটনা প্রতিরোধযোগ্য। ভালো মানের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা এবং প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ ইলেকট্রিশিয়ান দ্বারা তারের কাজ করা নিঃসন্দেহে শর্ট সার্কিটের কারণে দুর্ঘটনার হার হ্রাস করবে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্মাণে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা জোরদার, নিয়মিত তদারকি ও সচেতনতার মাধ্যমে অগ্নিদুর্ঘটনা ও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা রোধ করা সম্ভব। সরকারের উচিত স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করা। অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে সচেতনতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। স্কুল, কলেজ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত প্রচারণা চালাতে হবে।

অগ্নিকাণ্ডের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। এজন্য ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নগরবিদদের নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা করতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার ও সিটি করপোরেশনকে কঠোর হতে হবে। আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের দোকানের অনুমতি দেওয়া যাবে না। হাসপাতাল বা বিভিন্ন ভবনে সক্রিয় অগ্নিসুরক্ষা সরঞ্জাম স্থাপন/রক্ষণাবেক্ষণ কঠোর হওয়া উচিত। অনেক সময় বস্তিতে আগুন দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এটাও নজরদারি করা উচিত।

অগ্নিকাণ্ডের প্রধান কারণ অবহেলা। আর সেই সাথে আসে অজ্ঞতা। তাই প্রত্যেকেরই তাদের অবস্থান সম্পর্কে সর্বাধিক সচেতন হওয়া উচিত। জনসচেতনতার বিকল্প নেই। গণমাধ্যমকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আগুন প্রতিরোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারের সঙ্গে আমাদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে অগ্নিদুর্ঘটনার হার নিঃসন্দেহে কমবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস