রক্তদূষণজনিত সেপসিস রোগে বছরে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। এ সংখ্যা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যার চেয়েও বেশি। এর কারণ সেপসিসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন দরিদ্র এবং মধ্যম-আয়ের দেশের মানুষ। শতাংশের হিসাবে যা প্রায় ৮৫ শতাংশ।
Advertisement
এ রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের ঝুঁকিতে শিশুরা। পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে চারজনের সেপসিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। রক্তদূষণজনিত এ রোগে আক্রান্তদের প্রতি পাঁচজনে একজনের মৃত্যু হয়।
রোববার (৯ এপ্রিল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ব্লক অডিটোরিয়ামে মাসিক সেমিনারের অংশ হিসেবে সেন্ট্রাল সেমিনার সাব কমিটির উদ্যোগে রক্তদূষণ বা সেপ্টিসেমিয়া নিয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ তথ্য জানানো হয়।
সেমিনারে বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএসএমএমইউয়ের জেনারেল সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালাম চৌধুরী, আইসিইউ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সজীব, প্যাথলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজী ফারহানা খানম।
Advertisement
তারা জানান, জীবাণুদূষণ বা ইংরেজিতে সেপসিস হলো খুব মারাত্মক অসুস্থতা যা ব্যাকটেরিয়া (জীবাণু) দ্বারা রক্তের কার্যক্ষমতাকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে। সংক্রমণ প্রতিরোধে শরীর অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠলে সেপসিস হয়। এটি রক্তের বিষ হিসেবেও পরিচিত।
আরও পড়ুন>> দেশে ৭.০২ শতাংশ শিশু ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়
সেপ্টিসেমিয়া খুবই মারাত্মক অসুস্থতা। যার মাধ্যমে জীবাণু রক্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং রক্ত কোষগুলোর কার্যক্ষমতা সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয়। এটি দেহের প্রধান অঙ্গসমূহ যেমন- যকৃত, বৃক্ক (কিডনি), হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, অন্ত্র, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থিকে সংক্রমিত করে। বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা আছে বা মালটি ড্রাগ রেজিস্ট্রান্স জীবাণুর দ্বারা সংক্রমিত রোগীর দ্রুত অবস্থার অবনতি ঘটে।
এর কার্যক্রম তুলে ধরে বলা হয়, জীবাণু রক্তে প্রবেশের পর মানবদেহে অনেক পরিবর্তন দেখা দেয়। জীবাণুর কোষপ্রাচীরের অংশ মানবদেহের রক্তনালীর কোষ, মনোসাইট এবং নিউট্রোফিলকে সক্রিয় করে এবং বিক্ষত প্রদাহপূর্ব সাইটোকাইন নিঃসরণ করে। এর ফলে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত ও রক্তচাপ কমে যায়। টিস্যু ওডিমা হয়। ক্ষুদ্র রক্তনালিতে থ্রম্বোসিস হয়। ফলাফল হিসেবে অঙ্গ ও অন্ত্রসমূহে অর্গান ফেইলর হয়। শেষ পর্যন্ত রোগীর সেপটিপসিম ডেভেলপ করে। রোগীকে আইনিইউতে ভর্তি করাতে হয় এবং শতকরা প্রায় ৫০ শতাংশ মৃত্যুবরণ করে।
Advertisement
এতে আরও বলা হয়, সেপসিস ‘গুপ্ত ঘাতক’ হিসেবেও পরিচিত, কারণ এটি শনাক্ত করা কঠিন হতে পারে। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অতিরিক্ত কাজ করার ফলে সেপসিস হতে পারে। এ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেবল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরিবর্তে শরীরের অন্যান্য অংশগুলোতেও আক্রমণ শুরু করে। এক পর্যায়ে মানুষের অঙ্গ অকেজো হয়ে যায়। এমনকি বেঁচে থাকা মানুষদেরও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ও অক্ষমতা নিয়ে চলতে হতে পারে। যেসব ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া সংক্রমণ বা ফুসফুসের রোগ হয়ে থাকে সেগুলোই সেপসিস হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। সেপসিসে আক্রান্ত ব্যক্তির হার্ট রেট স্বাভাবিকের চাইতে বেশি হয়।
বক্তারা বলেন, সেপসিসের চিকিৎসার বিষয়ে জানানো হয়, রোগের চিকিৎসা হলো রোগীকে সাধারণত হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা বিভাগে ভর্তি করা হয়। ব্যাকটেরিয়া (জীবাণু) প্রতিরোধক ওষুধ ও তরল একটি শিরার মধ্যদিয়ে দেওয়া হয়। অক্সিজেন দেওয়া হয় এবং যে ওষুধ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, প্রয়োজনে তাও দেওয়া হয়। বিকল বৃক্ক বা কিডনির জন্য ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়। অকৃতকার্য ফুসফুসের জন্য একটি যান্ত্রিক শ্বাসযন্ত্র (mechanical ventilation) প্রয়োজন হয়। কিছু রোগীর জন্য ক্ষমতাশালী প্রদাহনিরোধক (anti-inflammatory) ওষুধ যেমন- করটিকোস্টেরয়েডস (corticosteroids) অথবা সহায়ক মানব-সক্রিয় প্রোটিন সি (human activated protein C) দ্বারা চিকিৎসা করলে উপকার হতে পারে।
সেমিনারে রোগের প্রতিরোধ হিসেবে নির্ধারিত সুপারিশ ও সতর্ক অনুসরণ করে সেপসিসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমানো যেতে পারে বলেও জানান বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে হাসপাতালে শিশুদের জন্য চিকিৎসা-শাস্ত্রগত পদ্ধতি সতর্কতা ও যত্ন সহকারে অনুসরণ করলে এ রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে বলে জানান তারা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেক দেশের ক্ষেত্রে সেপসিস প্রতিরোধের উপায় হলো সুষ্ঠু পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানি এবং সঠিক সময় সঠিক টিকার জোগান। অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি হলো দেরি হওয়ার আগেই সেপসিস আক্রান্ত রোগীদের ভালোভাবে চিহ্নিত করা এবং দ্রুত তাদের চিকিৎসা শুরু করা। অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টি-ভাইরাসের মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব। নবজাতকের মধ্যে সেপসিস প্রতিরোধে আমাদের নতুন করে চিন্তাভাবনা দরকার এবং এ রোগের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্দীপক অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল রেজিস্টেন্স মোকাবিলায় প্রয়োজন আরও বেশি সতর্কতা।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ এ রোগের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ও গবেষণার ওপর গুরত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, সেপসিস আক্রান্ত রোগীর ফুসফুস, কিডনিসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অকার্যকর করে দেয়। সেপসিসে মৃত্যুর হার প্রায় ৫০ শতাংশ এবং এ রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা আইসিইউতে ভর্তি হন সেক্ষেত্রে মৃত্যুহার আরও বেশি। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশু ও বয়স্করা অধিক মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকে। তবে সেপসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত ও যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারলে অনেককে বাঁচানো সম্ভব। রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
আরও পড়ুন>> স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের বিকল্প নেই
রক্তদূষণ বা সেপ্টিসেমিয়া নিয়ে আয়োজিত এ সেমিনার এ রোগে আক্রান্ত রোগীর যথাযথ উন্নত কার্যকরী চিকিৎসা নিশ্চিত করতে বিরাট অবদান রাখবে, যা মৃত্যুহার হ্রাসে ভূমিকা রাখবে বলেও আশা প্রকাশ করেন অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ।
বিশ্ববিদ্যালয় সেন্ট্রাল সাব কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সেমিনারে অন্যদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদসহ বিভিন্ন অনুষদের ডিন, বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান, বিভিন্ন স্তরের শিক্ষক, কনসালটেন্ট, চিকিৎসক ও রেসিডেন্টরা উপস্থিত ছিলেন।
এএএম/ইএ/জিকেএস