মতামত

শিশুমঙ্গল

বনশ্রীতে দুই শিশুর হত্যা ঘটনা এখন অনেক আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। সন্তান বড় করা, যোগ্য করে তোলার পদ্ধতি নিয়ে কথা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, এক অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক সমাজে সন্তানদের ঘিরে অভিভাবকদের প্রত্যাশার মাত্রা কতটুকু হতে পারে? অসংবেদনশীল বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়ে বড় করার নামে তাদের ওপর অত্যাচার চালান, শাসনের নামে নির্যাতন চালান, একদম ঠিক। কিন্তু খুন করে ফেলা, তাও মা নিজেই নাকি খুনি, (যদিও তা এখনো প্রমাণিত নয়) একেবারে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে শিশুদের নিয়ে আমাদের সামগ্রিক ভাবনায়। দেশ এগুচ্ছে, অর্থনীতি গতিশীল হচ্ছে, নগরায়ণ বাড়ছে। বিশ্বায়িত অর্থনীতির বাজারে নগরায়ণের গতি শুধু আকস্মিক ভাবে বেড়েই চলেনি, তা গ্রাম ও শহরের চরিত্র দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তার মাপকাঠিতে ধনবান এবং ধনহীন, উভয়েরই অবস্থান খুব ভঙ্গুর এখন। এবং শিশুদের বেলায় এই সমাজকে যেন আরো বেশি অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে নানা আয়োজনে। পরিবার কিংবা পরিবারের বাইরে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, দরিদ্র শিশু হলে তার কর্মস্থলে, সবখানেই হত্যা নির্যাতন খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেছে আমাদের কাছে। এই এগুতে থাকা বাংলাদেশ যেন শিশু পাচার, অপহরণ, যৌন নিগ্রহ, ধর্ষণ ও হত্যার লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। তীব্র বৈষম্য এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ভূমিকা এই ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। অথচ এ দেশে গ্রামসমাজ তো বটেই, এমনকি বহু দিন পর্যন্ত শহরেও সামাজিকতার বন্ধনের দৃঢ়তা ছিল। এখন আমরা সবাই সবার থেকে বিছিন্ন। পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে মানবিক আদানপ্রদান, সামাজিক নিরাপত্তার আচ্ছাদন শহরবাসীদের মাঝে আর নেই। এই বাংলাদেশে শ্রেণিবৈষম্য ছিল সবসময়ই, কিন্তু শ্রেণিগত দূরত্ব সদাসর্বদা এত প্রকট, এত দুর্লঙ্ঘ্য ছিল কী? স্কুলে,  খেলার মাঠে, সামাজিক উৎসবে মেলামেশার পরিসরটি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। উত্তুঙ্গ অট্টালিকায় সার্বক্ষণিক পাহারাদার পরিবেষ্টিত, কিন্তু এত আয়োজন কোনো নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করছে না। বীভৎস  সব ঘটনার নানাবিধ প্রদর্শনী এমনই নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে যে, কোনও কিছুতেই নগরবাসী আর শিহরিত হয় না। হয়তো নাগরিক অভিধানে এমন কোনও বিশেষণ অবশিষ্ট নেই যা মানুষকে হতবাক করে দেয়। কিন্তু তবুও এই বনশ্রীর ঘটনা কিছুটা অবাক করেছে আমাদের। কারণ ঘটনার জন্য দায়ী করা হচ্ছে মা’কেই। ফলে গণমাধ্যমের জন্য রসালো সব কাহিনী ছাপার খোড়াক হয়েছেন এই ভদ্র মহিলা যিনি তার সন্তানদের হারিয়েছেন, আবার এ জন্য আইনী জটিলতায়ও পড়েছেন। আমরা অর্থনৈতিকভাবে এগুতে থাকলেও আমাদের মজ্জাগত পরিবর্তন হয়েছে খুব কমই। যতই উন্নত দেশ হই, যতই মুখে থাক বহু-সংস্কৃতির মহতী বাণী আমরা ক্রমেই সহিষ্ণুতার বাইরে চলে যাচ্ছি।  আমাদের এই অসংবেদনশীলতার মূলে আছে সাংস্কৃতিকভাবে বেড়ে না উঠার ইতিহাস। পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি এ দেশে এখনও আদ্যোন্ত পুরুষতান্ত্রিক, ক্ষমতাতান্ত্রিক, যেখানে নারী ও শিশু নামক সংখ্যালঘু সদস্যরা কেবলই প্রান্তিক ও অনুল্লেখযোগ্য। শিশু-শাসন ও শিশু-নির্যাতনের পার্থক্য কী, বাংলাদেশের বাবা-মা’র মাথা ঘামানোর সময় নেই। বাবা-মা সংবেদনশীল নন, তাদের মানুষ করার নামে অত্যাচার করেন, শাসনের নামে নির্যাতন চালান, শারীরিক ও মানসিক ভাবে নিপীড়ন করেন, এগুলো আমাদের সমাজে ছিল এবং এখনো আছে। সংস্কৃতির কথা এজন্যই বলেছি যে, শিশু ও কিশোররা যে দেশে এমন পরিবেশে থাকে সেদেশেই আবার আমরা বাবা মায়েরা আবার আশা করেন তাদের সন্তানেরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বলভাবে এগিয়ে যাবে। বাইরেতো বটেই, আমাদের শিশুরা এখন আর বাড়িতেও নিরাপদ নয়। বড় একটি কারণ মা-বাবার, মারের ভয়। আমাদের পরিবারগুলোয় নানা কারণে বাচ্চাদের প্রতি সহানুভূতির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। প্রত্যাশার মাত্রা বাড়তে বাড়তে অনেক মা বাবাই মনে করছেন প্রহার না-করলে বাচ্চার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। আমাদের ঘরে-বাইরে সর্বত্র সুরক্ষিত শৈশব উপহার দিতে আইনের অভাব নেই। শুধু বিধি প্রণয়ন করে শিশুর গায়ে হাত তোলা বন্ধ অন্তত এদেশে সম্ভব নয়। ঝগড়া-মনোমালিন্য দাম্পত্য জীবনের খুব সাধারণ একটি ঘটনা। আলাদা চিন্তার আলাদা দর্শনের দুজন মানুষ একসাথে থাকতে গেলে খুঁটিনাটি বিষয়ে মত-ভিন্নতা আসবেই। কিন্তু তা যদি এমন স্তরে যায় যা প্রভাব শিশু-সন্তানের উপর পড়ে একদম ছোট বেলা থেকে তাহলে বলতে হবে এই সম্পর্ক আর না এগিয়ে নেয়াই ভালো। বাবা মা’র সম্পর্কের তিক্ততা সন্তানের মনকেও তিক্ত করে ফেলে। তার বেড়ে ওঠার বয়সে বাবা-মা’র অস্থির সম্পর্কের কারণে সে অনিরাপত্তায় ভুগতে শুরু করে। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সে ভয় ও অনিশ্চয়তায় থাকে- উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকে যার কারণে চাইলেও লেখাপড়ায় মনোযোগী হতে পারে না। এবং তখন অবধারিতভাবে অতি প্রত্যাশায় থাকা বাবা কিংবা মা আরো বাড়িয়ে দেন নির্যাতনের মাত্রা। সববিষয়ে একমত হওয়া কখনই কারো পক্ষে সম্ভব হয় না, হবে না। সংসারে নতুন অতিথি যে এলো নজরটা দিতে হবে তার দিকেই। বাবা-মা’র সুসম্পর্ক শিশুর বিকাশের অন্যতম প্রভাবক। শিশুসন্তান কেবল মা-বাবার নিজস্ব সম্পত্তি নয়, শিশু নিজেই এক জলজ্যান্ত নাগরিক। আমাদের বাবা মায়েরা কখনো ভাবেন না যে, আকারে ক্ষুদ্র হলেও তার অধিকার সম্পূর্ণ ও অনতিক্রম্য। আমাদের রাষ্ট্রও কখনো ভাবেনা যে, নাগরিকের মতো তারও সেই নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কোথাও সেই শিশুর অধিকার যদি লঙ্ঘিত হয়, তবে তার প্রতিকার করা রাষ্ট্রেরই গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। শিশু-অধিকার বিষয়ে এই সংবেদনশীলতা দেশের সংস্কৃতিতে অত্যন্ত গভীরপ্রসারী। তাই বনশ্রীর শিশুদের নিয়ে গল্প জমানোর চেষ্টা করা বাহিনী বা গণমাধ্যমের ভাবতে হবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি স্তরে স্তরে আগামী প্রজন্মকে ভঙ্গুর করে দিচ্ছে। এইচআর/এমএস

Advertisement