এইচ এম. ইমরান হোসাইন
Advertisement
ভ্রমণ করতে ভালবাসেন না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। প্রায় প্রত্যেকেই চায় প্রকৃতির কাছে নিজেকে শপে দিতে। ভ্রমণের মাধ্যমে নিজের অশান্ত-পরিশ্রান্ত মনকে তৃপ্তি দিতে।
তবে ভ্রমণ অধিক তৃপ্তিদায়ক তখনই হয়, যখন নিজ পরিবার-পরিজনকে নিয়ে কোনো এক প্রাকৃতিক পরিবেশে হারিয়ে যাওয়া যায়। নিজের পরিবারকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসার তৃপ্তি-আনন্দ বলে বোঝানো যায় না। সেটা যদি হয় বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানায় তাহলে তো কথায় নেই।
আরও পড়ুন: যে গ্রামের নারীরা ৭০ বছরেও দেখতে ‘তরুণীর’ মতো
Advertisement
রাজধানী ঢাকার মিরপুরে অবস্থতি জাতীয় চিড়িয়াখানা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্যপ্রাণির এমন এক সংমিশ্রণ যেখানে পরিবারকে নিয়ে কল্পনার বাস্তবজগতে হারিয়ে যাওয়া যায়। উপলব্ধি করা যায় ও দেখা যায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দূর্লভ, বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণি।
এ চিড়িয়াখানায় যে শুধু ভ্রমণপ্রেমীরা ঘুরতে আসেন তেমনটাও নয়। এখানে অনেকেই নিজের বন্ধু-বান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকা নিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যায়। আদান-প্রদান করে মনের অনুভূতি-ভালবাসা।
মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় চিড়িয়াখানা এমন একটি চিড়িয়াখানা, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার চিড়িয়াখানার মধ্যে প্রাণির সংখ্যা ও দর্শনার্থী আগমনের বিচারে সবচেয়ে বড়। এখানে চাইলে পরিবারকে নিয়ে সারাদিন ঘুরতে পারবেন আর দেখতে পারবেন অজানা সব প্রাণী।
আরও পড়ুন: অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটার সহজ নিয়ম
Advertisement
হরিণ খেকে শুরু করে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ময়ূর, হাতি, গণ্ডার, জিরাফ, বানর, সিংহ, অজগর সাপ, জলহস্তি, ভাল্লুক, হাতি, কুমির, জেব্রা, পানকৌড়ি ইত্যাদি প্রাণী। এছাড়া চিড়িয়াখানায় আছে সুন্দর লেক। যেখানে বসে মনের অজান্তেই হারিয়ে যাওয়া যায়।
চিড়িয়াখানায় প্রবেশ করেই দেখতে পাবেন হরিণ। আর এই দৃশ্য আপনাকে প্রথমেই মুগ্ধ করবে। এ দৃশ্য ভুলতে না ভুলতেই একটু সামনে গিয়ে দেখতে পাবেন বানরের খেলা করার দৃশ্য।
যে দৃশ্য ছোট শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ ব্যাক্তিও মুগ্ধতার সহিত অবলোকন করে। এই জায়গার ভেতরে বানরদের গোসল করার জন্য ছোট ২টি পুকুর আছে। যেখানে প্রায় সময়ই বানরের ছোট ছোট বাচ্চাদের গোসল করতে দেখা যায়। আর এ দৃশ্যটি ছোট্ট বাচ্চাদেরকে বেশি আনন্দ দিয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: মালদ্বীপ নাকি আন্দামান, হানিমুনের জন্য সেরা গন্তব্য কোনটি?
এর সামান্য কিছুটা সামনে গেলেই পাবেন গ্রেটার ফ্লেমিংগো পাখি। গ্রেটার ফ্লেমিংগো ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়। এ পাখি আবার দেখতে বেশ লম্বা। এরা চিংড়ি, কাঁকরা ও শামুক খেয়ে বেঁচে থাকে। গ্রেটার ফ্লেমিংগো দেখার দৃশ্য আপনার মনকে পাখির জগতে নিয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যেই।
এখান খেকে আরেকটু এগুলেই দেখতে পাবেন আফ্রিকান সাদা সিংহ। যে সিংহ দক্ষিণ আফ্রিকা, ফ্রান্স, সার্বিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়। এ সিংহ দেখতে সোনালি থেকে সাদা রঙের। এরা মুরগির মাংস, ঘোড়ার মাংস ও গরুর মাংস খেয়ে থাকে। থাকার জায়গায় খাবার হিসেবে সবসময় মাংস রেখে দেওয়া হয়।
চিড়িয়াখানায় সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য হচ্ছে বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। বনের রাজাকে দেখতে সব দর্শনার্থীই ভিড় জমায়। চিড়িয়াখানায় স্বচোখে বাঘকে দেখলেই বুঝতে পারা যায় বাঘ কত হিংস্র।
আরও পড়ুন: সিলেটের ‘সাদা পাথর’ ভ্রমণে কখন ও কীভাবে যাবেন?
অবশ্য এ খাচার মধ্যে হিংস্র হয়েও লাভ নেই। এজন্যই হয়তো বনের রাজা প্রায় সময়ই ঘুমিয়ে থাকেন। বিশেষ করে দুপুর বেলা আপনি চিড়িয়াখানায় গেলে বাঘকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পাবেন।
বাঘের পাশেই আছে এশিয়ান কালো ভাল্লুক। এ ভাল্লুক দেখতে বেশ বড়সড়। গায়ের রং কুচকুচে কালো। এদের সাধারণত ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মায়ানমার, চীন ও জাপানে পাওয়া যায়। ভাল্লুককে দেখতেই আপনার মনে পড়ে শৈশবে বইয়ের পাতায় দেখা ভাল্লুকের ছবি। যেটা আপনি এখন স্বচোক্ষে দেখতে পাচ্ছেন।
এখান থেকে ডানদিকের পথে হেঁটে গেলেই দেখতে পাবেন প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য। যেখানে বসে ক্লান্ত-বিষাদ দূর করা যায়। প্রিয়জনকে নিয়ে হারিয়ে যাওয়া খুনসুটির জগতে। এ গাছপালা প্রকৃতির মধ্যেই খুঁজে পাবেন বিভিন্ন প্রকৃতির বাজপাখি।
আরও পড়ুন: মনের মতো সঙ্গী না পেয়ে একাই ‘হানিমুনে’ তরুণী
ডানদিকের পথ ধরে কিছুদূর গিয়ে পাবেন বড় অজগর সাপের আস্তানা। যেখানে শুধু সাপ আর সাপ। প্রথমে দেখে আপনি অবাক হবেন আবার ভয়ও পাবেন। এত বড় সাপ আপনার চোখ সরাসরি এর আগে কখনো অবলোকন করেনি। দর্শনার্থীদের মধ্যে অনেকেই এই অজগর সাপ দেখে চিৎকার করে ওঠে।
তবে এখান থেকে একটু জিনিস পরিষ্কার-স্বচ্ছভাবে উপলব্ধি করা যায় যে, হিংস্র প্রাণূরা এত ভয়ংকর ও শক্তিশালী হওয়ার পরেও মানুষের কাছে সৃষ্টিকর্তা তাদেরকে দুর্বল করে রেখেছে। এখানে সৃষ্টিকর্তার মহিমা উপলব্ধি করা যায়।
এছাড়া চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখতে পারবেন ময়ূর, খরগোশ, কুমির, জলহস্তিসহ অসংখ্য পাণি। যে প্রাণিগুলো আপনার পরিবারকে নিয়ে খুব আনন্দের সহিত দেখতে পারবেন।
আরও পড়ুন: প্রকৃতির অপার বিস্ময় কাজিরাঙা ন্যাশনাল পার্ক
পাশাপাশি চিড়িয়াখানার মধ্যে আছে শিশুদের জন্য দৃষ্টিনন্দন শিশুপার্ক। এ পার্কে ছোট বাচ্চাদের সঙ্গে বড়দেরকেও শিশুসুলভ আচরণে মেতে উঠতে দেখা যায়। শিশুরা হারিয়ে যায় আনন্দের কোলাহলের আড্ডাখানায়।
শিশুপার্কের পাশ দিয়ে যে পথটি চলে গেছে সেখানে একটি মনোরম লেক দেখতে পাবেন। এখানে বসে অনেকেই বিশ্রাম করেন। কেউ কেউ প্রিয়জনের সঙ্গে অনুভূতি আদান-প্রদান করেন।
তার পাশেই আছে দর্শনার্থীদের খাবার হোটেল। চিড়িয়াখানায় হাটতে হাটতে ক্ষুধা লেগে গেলে খাবার হোটেল থেকে খাবার পরিবেশন করতে পারবেন। নিজেকে রিচার্জ করে নিবে পারবেন।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর ভ্রমণে যে ৫ কাজ করলেই বিপদ
এবাবেই চিড়িয়াখানার ভেতরে ঘুরে ঘুরে দেখবে পারবেন অজানা সব প্রাণী। পরিবার-বন্ধুবান্ধব নিয়ে অর্জন করে আসতে পারবেন নানান সব অভিজ্ঞতা।
চিড়িয়াখানায় গিয়ে যা যা পাবেন-
চিড়িয়াখানায় তথ্য কেন্দ্র আছে। এ তথ্য কেন্দ্র থেকে দর্শনার্থীরা তথ্য বা সেবা নিতে পারবেন।
১. চিড়িয়াখানা সম্পর্কে কিছু জানার প্রয়োজন থাকলে তথ্য কেন্দ্রে জানতে পারবেন।
২. বৃদ্ধ বা অচল মানুষের জন্য হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা।
৩. পিকনিক সম্পর্কে কিছু জানার থাকলে।
৪. বাণিজ্যিকভাবে কোনো ছবি তোলা বা ভিডিও করা যায় কি না সে সম্পর্কে।
এছাড়া চিড়িয়াখানায় আছে টয়লেটের ব্যবস্থাও। প্রধান ফটকের ভেতরে নারীদের জন্য ৭টি ও পুরুষের জন্য ৫টি টয়লেট আছে।
টয়লেট ব্যবহারে খরচ পড়ে জনপ্রতি ৫ টাকা। এছাড়া প্রাণী যাদুঘরের পাশে নারীর জন্য ৩টি, পুরুষের জন্য ৫টি, হাতি বা শিশু পার্কের পাশে নারীর জন্য ৮টি, পুরুষের জন্য ৮টি টয়লেট আছে।
আরও পড়ুন: কলকাতার যেসব স্থানে ঢুঁ মারতে ভুলবেন না
পাশাপাশি নিরাপত্তার জন্য চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিরাপত্তাকর্মী ছাড়াও পুলিশ ও র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন।
দর্শণার্থীদের জন্য আছে যেসব বিশেষ ব্যবস্থা-
চিড়িয়াখানাতে দর্শণার্থীদের পশু-পাখি দেখা ছাড়াও নিঝুম ও উৎসব নামে ২টি পিকনিক স্পট, শিশুদের খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্য একটি শিশুপার্ক, পুরুষ ও নারীদের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এছাড়া এখানে একটি কেন্দ্রীয় মসজিদও আছে।
চিড়িয়াখানায় গিয়ে যেসব বিষয় অবশ্যই মনে রাখবেন-
১. চিড়িয়াখানায় যাওয়ার সময় সম্ভব হলে অবশ্যই সাথে একটা ব্যাগ রাখার চেষ্টা করবেন।
২. চিড়িয়াখানায় বিভিন্ন প্রাণি দেখতে হলে আপনাকে অনেক পথ হাটতে হবে। তাই অবশ্যই পানির তৃষ্ণা পাবে আপনার। এ জন্য চিড়িয়াখানার আশপাশ থেকে পানি কিনে সাথে রাখবেন। সম্ভব হলে খাবারও সাথে রাখতে পারেন। এতে আপনার সুবিধা হবে।
৩. যাওয়ার সময় অবশ্যই ভালো ক্যামেরার স্মার্টফোন অথবা ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে যান। তাহলে সুন্দর মুহূর্তগুলো স্মরণ করে রাখতে ক্যামেরাবন্দী হতে পারবেন।
৪. অবশ্যই সুন্দর মন-মানসিকতা নিয়ে প্রবেশ করবেন। যেহেতু দর্শনার্থীদের ভিড় লক্ষ্য করা যায়, সেহেতু সুশৃঙ্খলভাবে চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করুন।
৫. সূর্যাস্তের পূর্বে চিড়িয়াখানা ত্যাগ করতে হবে।
৬. সঙ্গে আসা বাচ্চাদের নজরে রাখতে হবে।
৭. চিড়িয়াখানার প্রাণিদের কাছ থেকে বাচ্চাদের নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে হবে।
আরও পড়ুন: কলকাতার যেসব স্থানে ঢুঁ মারতে ভুলবেন না
৮. চিড়িয়াখানার কর্মচারীদের প্রতি সহযোগীতামূলক আচরণ করতে হবে।
যেসব কাজ করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকবেন-
১. টিকিট না কেটে চিড়িয়াখানায় প্রবেশ অবশ্যই বিরত থাকবেন।
২. পরিবেরের সঙ্গে গেলে সদস্যদের কাউকে একা ছাড়া থেকে বিরত থাকুন।
৩. চিড়িয়াখানার প্রাণীদের সঙ্গে হিংস্র আচরণ করা থেকে বিরত থাকুন।
৪. প্রাণীদের খাঁচায় বা ঘরে হাত দিবেন না।
৪. চিড়িয়াখানার জায়গা অনেক প্রশস্ত ও দীর্ঘ। তাই পুরো চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করতে তাড়াহুড়ো করা থেকে বিরত থাকুন।
আরও পড়ুন: রাম সেতু বানরবাহিনীর তৈরি নাকি প্রকৃতির বিস্ময়?
কীভাবে যাবেন?
ঢাকার যে কোনো স্থান থেকে মিরপুরগামী লোকাল বাস অথবা সিএনজি করে একদম চিড়িয়াখানা গেইটের কাছে যেতে পারবেন। এছাড়া ব্যাক্তিগত গাড়ি ও নিয়ে যাওয়া যায়। তবে অনেক সময় ডিরেক্ট বাস না পেলে মিরপুর ১ এর যে কোনো বাসে উঠে সনি সিনেমা হলে নেমে সেখান থেকে রিকশায় করে যেতে পারবেন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
জেএমএস/এমএস