ফিচার

আগুন লাগলে কী করবেন?

প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে আগুনে। এসব মৃত্যুর জন্য যতটা না আগুন দায়ী, তার চেয়ে অসচেতনতা বড় ভূমিকা রাখে। গত ৪ এপ্রিল ভোর ৬টায় বঙ্গবাজার মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লাগে। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের সব দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যা পরে ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গমার্কেটের সঙ্গে লাগোয়া মহানগর শপিং মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, ইসলামিয়া ও এনেক্সকো টাওয়ারে। হাতিরঝিল থেকে হেলিকপ্টার পানি নিয়ে রাজধানীর বঙ্গবাজারসংলগ্ন এনেক্সকো টাওয়ারসহ আশপাশের ভবনগুলোর আগুন নেভাতে দেখা যায়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর নিজস্ব গাড়িতে নেওয়া পানির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলসংলগ্ন পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করে। ঢাকা ওয়াসার কর্মীরা গাড়িভর্তি পানি নিয়ে ছুটে যায়। উৎসুক জনতা, পানির স্বল্পতা ও বাতাসের কারণেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়। ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রচেষ্টায় প্রায় সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়। অগ্নিকাণ্ডের সময় সার্বক্ষণিকভাবে পুরো পরিস্থিতি মনিটরিং ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ঘটনায় তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সহমর্মিতা জানান। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের মাধ্যমে তাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

Advertisement

এমনিতেই আমাদের দেশে শুষ্ক মৌসুমে বেশি বেশি আগুন লাগার ঘটনা ঘটে থাকে। এ সময়ে চারপাশের আবওহাওয়া থাকে শুষ্ক। এছাড়া যেসব দাহ্য বন্তু রয়েছে সবগুলোতেই এ সময় জলীয়বাষ্পের পরিমাণ থাকে কম ও শুষ্ক। তাই বাসাবাড়িতে আগুন লাগলে আসবাবপত্র শুষ্ক থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। তবে চলতি বছরে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। খবরে জানা যায়, বিভিন্ন জায়গায় আগুন লেগে বাড়িসহ পুড়ছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শুধু আগুনে পুড়েই শেষ নয়। দুর্ঘটনায় মারা গেছে বহু মানুষ। এছাড়া এ সময়ে ঝড়ের কারণে বিভিন্ন দুর্ঘটনা থেকেও আগুন লাগে। সাধারণ চুলার আগুন, উত্তপ্ত ছাই, বিড়ি বা সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো, ভুল বৈদ্যুতিক সংযোগের ফলে সৃষ্টি হওয়া গোলযোগ, খোলা বাতির ব্যবহার, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা ইত্যাদি থেকেও আগুন লেগে থাকে। শিশুরা যেন আগুন নিয়ে খেলা না করে, সে বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। এ তো গেলো অনিচ্ছাকৃত আগুন লাগার কারণ। কখনো কখনো মানুষের ইচ্ছায়ও আগুন লাগে। শত্রুতার জের ধরে একে অন্যের ঘরে আগুন দেওয়ার সংখ্যা গ্রামে কম ঘটে না।

অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষই মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন না। তাড়াহুড়া করে পদদলিত হয়ে মারা যান অনেকেই। আগুনে পুড়ে মরার চেয়ে অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়েই বেশি মারা যায়। অগ্নিকাণ্ডের সময় অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, তার এখন কী করা উচিত। আগুন যার ঘরে লাগে, তার মাথায় তখন কোনো বুদ্ধি কাজ করে না। আগুন লাগার পর তৎক্ষণাৎ কী করবেন বুঝতে পারেন না। কারণ আগুন জীবন ও সম্পদের অনেক ক্ষতি করে। তাই অস্থিরতায় মৃতের সংখ্যাই শুধু বাড়ে। যদি পূর্বপরিকল্পনা থাকে, তবে সহজেই নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে জীবন বাঁচানো যায়। সুতরাং আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ঘরে রাখা উচিত। আগুন লাগলে শুধু সাহায্যের জন্য চিৎকার না করে করণীয়গুলো জেনে নেওয়া দরকার।

আরও পড়ুন: কফি পান করতে ভালো লাগে কেন?

Advertisement

আজকাল নিয়মিত বিরতিতে ঘটা এসব অগ্নিকাণ্ডের মুখে রাজধানী যেন এক অরক্ষিত নগরীতে পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত যেসব ঘটনা ঘটছে, বিপদের হুমকি তার চেয়েও বেশি। গত পাঁচ বছরে এ ধরনের দুর্ঘটনা জ্যামিতিক হারে বেড়েছে। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে অগ্নিনিরাপত্তা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন সরবরাহে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। তা না করা গেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বন্ধ করা যাবে না। গ্যাসের ব্যবহার নাগরিক জীবনযাত্রার অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। স্থায়ী গ্যাস লাইনের পাশাপাশি বেড়েছে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহারও। কিন্তু গ্যাসের ব্যবহার নিয়ে আমাদের অসতর্কতা আর অসচেতনতার যেন কোনো শেষ নেই। সেই সঙ্গে গ্যাসের ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবহার নিয়েও কেউ কিছু মনে করছেন না। এ কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনাও ঘটছে অনেক। তাই বাসাবাড়িতে গ্যাস ব্যবহারে সচেতন হোন। সেই সঙ্গে কোনো ধরনের অসঙ্গতি দেখা দিলে (বিশেষ করে পাইপ লাইন লিকেজ হওয়ার বুদবুদ শব্দ বা গ্যাসের গন্ধ) কর্তৃপক্ষকে জানান। এতে দুর্ঘটনা অনেকখানি এড়িয়ে চলা যায়।

বিড়ি-সিগারেট খাওয়া শেষে ভালোভাবে নিভিয়ে ফেলুন। রান্নার পর গ্যাসের চুলা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ বা ছিদ্র থাকা সিলিন্ডার ব্যবহার করবেন না। এছাড়া লিকেজ থাকলে সারিয়ে নিন। উত্তপ্ত ছাই শুষ্ক যেখানে-সেখানে ফেলবেন না। গ্যাসের বা মাটির চুলা জ্বালিয়ে কাপড় শুকাবেন না। কমদামি বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করবেন না। শিশু থেকে প্রবীণ পরিবারের সবাইকে আগুন লাগার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক সুইচবোর্ড বা মাল্টিপ্লাগের আশপাশে কাগজপত্র বা বাক্সপ্যাটরা মাল্টিপ্লাগে টিভি, ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, মোবাইল চার্জার ইত্যাদি নিরাপদ জায়গায় রাখুন। প্রতিটি প্লাগের জন্য পৃথক সুইচ সম্বলিত মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার করা উচিত। কাজ শেষ হলে বৈদ্যুতিক প্লাগ লাগিয়ে রাখবেন না। বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে আগুন লাগলে প্রথমেই মেইন সুইচ বন্ধ করে দিন। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য টেলিফোন ও মোবাইল ফোনের নম্বর সংরক্ষণ করুন।

প্রতিদিনের রান্নার পর চুলার আগুন নেভানো হয়েছে কি না ভালোভাবে খেয়াল করুন। বিড়ি বা সিগারেটের আগুন যেখানে সেখানে ফেলবেন না। ছোট ছেলে মেয়েরা যাতে আগুন নিয়ে না খেলে সেদিকে খেয়াল রাখুন। বাজি পটকা ফোটানো থেকে ছোটদের বিরত রাখুন। ঘরের ভেতরে দাহ্য তরল না রাখাই ভালো। যদি থাকেও তাহলে তার আশপাশে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। দাহ্য তরল যেন চুলা বা মশার কয়েল থেকে দূরে থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মশারির ভেতর খোলা বাতি কখনো নেবেন না। সব সময় পানি ও বালতি ভরতি দুটো বালতি হাতের নাগালের মধ্যে রাখুন। বিদ্যুতের মেইন সুইচ যাতে সহজে বন্ধ করা যায় এমন জায়গায় রাখুন। বিদ্যুতের ওয়ারিং মাঝে মাঝে পরীক্ষা করান। প্রয়োজন হলে বদলে নিন। বিদ্যুতের যথাযথ আর্থিং নিশ্চিত করুন।

আরও পড়ুন: নারীকে আকৃষ্ট করতেই সুগন্ধি ব্যবহার শুরু করেন পুরুষরা

Advertisement

আর হ্যাঁ, আগুন লাগলে প্রথমেই উত্তেজিত বা বিচলিত হবেন না। মাথা ঠান্ডা রাখুন। আসলেই আগুন লেগেছে কি না সেটা নিশ্চিত হোন। ধোঁয়া দেখলেই চিৎকার করে ব্যতিব্যস্ত হবেন না। আগুন কোথায় লেগেছে বোঝার চেষ্টা করুন। সাধারণ চুলা বা সিগারেট বা লাকড়ি ইত্যাদি থেকে লাগা আগুন হলে হাতের কাছে রাখা পানি আগুনে ঢেলে দিতে থাকুন। তেল বা বিদ্যুৎ থেকে লাগা আগুনে কখনো পানি দেবেন না। বালি বা ভেজা মোটা কাপড় দিয়ে চাপা দিন। বিদ্যুৎ থেকে আগুন লাগলে দ্রুত মেইন সুইচ বন্ধ করে দিন। আগুন গ্রামের কাঁচা ঘর বাড়িতে দ্রুত ছড়িয়ে যায়। তাই আগুনের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে আশপাশের দু’একটি কাঁচা ঘর ভেঙে দিন। ঘরের ভেতরে দাহ্য তরল না রাখাই ভালো। যদি থাকেও তাহলে তার আশপাশে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। দাহ্য তরল যেন চুলা বা মশার কয়েল থেকে দূরে থাকে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। রান্না করার সময় সতর্ক থাকতে হবে। গ্যাসের চুলা অযথা জ্বালিয়ে রাখা উচিত নয়।

যে কোনো সময় বিপদ হতে পারে। দেশলাই বা ম্যাচ বাক্স যথাসম্ভব ওপরে এবং বাচ্চাদের নাগালের বাইরে রাখা উচিত। ড্রয়ারে তালাবদ্ধ করে রাখা বেশি নিরাপদ। দেশলাই কখনো চুলা বা মশার কয়েলের আশপাশে রাখা উচিত নয়। ঘুম ঘুম অবস্থায় ধূমপান না করাই ভালো। কারণ মাঝেমধ্যে তন্দ্রাভাব থেকে যে কোনো সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে পারেন। ধূমপান করলে অবশ্যই সিগারেটের অবশেষ নিভিয়ে ফেলা উচিত। যেখানে-সেখানে জ্বলন্ত সিগারেট ফেলা উচিত নয়। বসতবাড়িতে বা অফিসে স্বয়ংক্রিয় ফায়ার অ্যালার্মের ব্যবস্থা রাখা উচিত, যেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যালার্ম বেজে ওঠে এবং সবাই সতর্ক হতে পারেন। অগ্নিনির্বাপক অ্যালার্ম মাঝেমধ্যে বাজিয়ে দেখতে হবে, পরিবারের সবাই অ্যালার্ম শুনে সতর্ক হচ্ছেন কি না। সতর্ক না হলে তাঁদের বারবার অনুশীলন করাতে হবে। কারো পরনের কাপড়ে আগুন লাগলে কখনো ভয়ে যেন দৌড় না দেয়। এতে আগুন আরও বেশি তেজ নিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলবে। পোশাকে আগুন ধরে গেলে দৌড়ানোর চেষ্টা না করে শুয়ে গড়াগড়ি দিতে হবে। দৌড়ালে আগুন বেড়ে যাবে, আরও বেশি করে জ্বলে উঠবে। গড়াগড়ি করলে আগুন অক্সিজেনের অভাবে নিভে যাবে। তাই তাকে মাটিতে গড়াগড়ি দেওয়াতে হবে অথবা ভেজা মোটা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে ধরুন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, একটু সচেতন হলেই এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া যায়। সেই সঙ্গে দরকার আগুন থেকে সাবধান থাকা। কথায় বলে, রোগ হওয়ার পর সারানোর চেয়ে রোগ যাতে না হয় সে চেষ্টা করা ভালো। আর তাই আগুন যেন না লাগে সে বিষয়ে সদা সতর্ক থাকুন। আগুন থেকে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। আগুন সাবধানতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। যাতে সেটি বিপজ্জনক অবস্থায় না যায়। যেসব দাহ্য পদার্থ আছে, সেগুলোতে যাতে আগুন না লাগে সে জন্য পানি হাতের কাছেই রাখতে হবে। পানির রিজার্ভারগুলো বাড়াতে হবে। যাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সহজে পানি পান এবং তাদের গাড়িগুলো সহজে সেই এলাকায় ঢুকতে পারে, সেই ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। পাশাপাশি নিজেকে যেমন এ বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে, তেমনই অন্যকেও সতর্ক করতে হবে। নগরবাসীরা ফায়ার সার্ভিসের সাহায্যের জন্য ফোন করুন। এজন্য নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিসের ফোন নম্বর মুখস্থ রাখুন। কিংবা যেখানে সবার চোখ সব সময় যায়, এমন স্থানে লিখে রাখুন। আর হ্যাঁ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকেও এ বিষয়ে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। সবার সতর্কতা এবং জ্ঞানই পারে যে কোনো দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এমফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস