জাতীয়

‘একটি অরাজক চক্র গোটা রাজধানীকে অগ্নিগর্ভে পরিণত করছে’

‘বঙ্গবাজার ঘিরে পুরান ঢাকায় পাঁচটি জীবন্ত খাল হত্যা করা হয়েছে। ধোলাই খাল, সেগুনবাগিচা খাল, গোপীবাগ খাল তো বঙ্গবাজারের আশপাশেই ছিল। অথচ আগুন নেভাতে পানির জন্য হাহাকার করতে হলো।’

Advertisement

বলছিলেন, নগর পরিকল্পনা ও পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব। অগ্নিকাণ্ড এবং রাজধানীর জনজীবন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে।

বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আসলে সমাধানভিত্তিক মানসিকতায় যেতে পারি না। ক্ষতিপূরণের মানসিকতাই আমাদের এ অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী বলে মনে করি। ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য আমরা প্রকল্পভিত্তিক উদ্যোগ নেই। সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে আমরা সমাধানের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ নই।’

আরও পড়ুন>> বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ড আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত দুই মার্কেট খুলতে তোড়জোড় 

Advertisement

‘ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাষ্ট্র সবারই যা যখন খুশি সেই আচরণ প্রকাশ করছি। আপনি কোনো সমন্বয় পাবেন না। ১৯৯৫ সালে এই বঙ্গবাজারেই ভয়াবহ আগুন লাগে। এরপর থেকেই পরিবেশবাদী, সচেতন জনগণসহ বিভিন্ন পক্ষ উদ্যোগ ও সতর্কতা অবলম্বন করতে বলে। বঙ্গবাজার দোকান মালিকরা কানে তোলেননি। এমনকি সরকারিভাবে নেওয়া প্রকল্পেও তারা বাধা দিয়েছেন। যারা আজ এ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের আপনি এককভাবেও দায়ী করতে পারেন। কী পরিবেশে তারা ব্যবসা করেছেন, তা সবারই জানা। দায় তাদের নিতেই হবে।’

দায় প্রসঙ্গে এই নগরবিদ বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের বাইরের গোষ্ঠীকেও দায় নিতে হবে। রাজনৈতিক মাস্তান বা গোষ্ঠীও এমন ঘটনার জন্য দায়ী। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসনের জন্য সোনার বাংলা নামে একটি মার্কেট করা হয়েছে। সেটা রাজনৈতিকভাবে বরাদ্দ, দখল করে আবার এই বঙ্গবাজারেই ব্যবসা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। একটি অরাজক চক্র গোটা রাজধানীকে অগ্নিগর্ভে পরিণত করছে।’

আরও পড়ুন: তালিকায় নাম লেখাতে ক্ষতিগ্রস্তদের উপচেপড়া ভিড় 

রাষ্ট্র কী করছে? জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন হচ্ছে, এই অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয় কেন? রাষ্ট্র-প্রশাসনের নির্বিকারে অগ্নিকাণ্ডের এই অরাজকতা। রাজউক কী করছে? ভবনগুলো কীভাবে হচ্ছে? দুর্ঘটনা ঘটলে রাজউক কর্তৃপক্ষ দাঁত কেলিয়ে বলে বেড়ায় ৯৯ শতাংশ ভবনই অননুমোদিত। তাহলে অনুমোদন দিচ্ছে কে? ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন?’

Advertisement

‘রাজধানীজুড়ে জলাশয় ছিল। পুকুর, খাল, বিল আর নদী দ্বারাই রাজধানী ঢাকা আচ্ছাদিত ছিল। এখন কী পরিস্থিতি! সরকার উপর্যুপরি জলাশয়গুলো ধ্বংস করলো। আবার ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেও নির্বিকারভাবে এই ধ্বংসকাণ্ডে সুযোগ করে দিলো। কোনো বাধা নেই, প্রতিক্রিয়া নেই। আর আজ আগুন নেভাতে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘এই বঙ্গবাজার ঘিরে পুরান ঢাকায় পাঁচটি জীবন্ত খালকে হত্যা করা হয়েছে। ধোলাই খাল, সেগুনবাগিচা খাল, গোপিবাগ খাল তো বঙ্গবাজারের আশপাশেই ছিল। অথচ আগুন নেভাতে পানির জন্য হাহাকার করতে হলো। বঙ্গবাজার থেকে মাত্র একশ গজ দূরে ওসমানী উদ্যানে বিরাট পুকুর ছিল। উন্নয়নের নামে এই পুকুর শুকিয়ে কাদামাটি করে রেখেছে। এই দোষ কাকে দেবেন?’

আরও পড়ুন>> ‘মালিক তো নিঃস্ব, ঈদে বেতন-বোনাস চাইবো কোন মুখে’ 

পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সারাদেশের পানি রক্ষা নিয়ে কাজ করার কথা। সেই পানি ভবন একটি খালের ওপর দাঁড়িয়ে গেলো। কল্যাণপুরের প্রাণ যে খালটি ছিল সেটি ভরাট করে বহুতল ভবন করছে বিএডিসি। এটি এখনকার ঘটনা। এই খালের প্রকল্প নিয়ে প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে গিয়ে কথা বলেছেন। এমন প্রকল্প থাকার পরেও রাষ্ট্রেরই আরেক প্রতিষ্ঠান বিএডিসি খালটি ভরাট করে ফেললো। বলছিলেন স্থপতি ইকবাল হাবিব।

রাজধানীকে রক্ষার উপায় প্রসঙ্গে বলেন, ‘গত ২০ বছরে ঢাকায় সাড়ে ৬শ পুকুর হারিয়েছি। প্রতিবার পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করেছেন, চিৎকার করেছেন। পরিণাম হচ্ছে, আমরা একটিও রক্ষা করতে পারিনি। কারণ সরকার নিজেই ধ্বংস করে চলছে। খালগুলোর পানি রক্ষা করা ছিল খুবই মামুলি বিষয়। কেউ দায়িত্ব নিলো না। সিটি করপোরেশন দোষ দেয় ওয়াসাকে, ওয়াসা দোষ দেয় সিটি করপোরেশনকে। দায়িত্বশীল আচরণ কেউ প্রকাশ করছে না।’

তাহলে ভবিষ্যৎ? এই স্থপতি বলেন, আমি এখনো মনে করি, সিটি করপোরেশনকে এ ব্যাপারে একচ্ছত্র দায়িত্ব দেওয়া হোক। তারা প্রতি বছর ভবনগুলোতে ভিজিট করে বসবাসযোগ্য সনদ দেবে। যেটা অযোগ্য সেটা বাতিল বলে ঘোষণা করবে। এখানে সব সেবা সংস্থা যুক্ত থাকবে। আজ থেকেই সেটা করা দরকার। রানা প্লাজা ধসের পর গার্মেন্ট সেক্টর যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এখানেও ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব বলে আমি মনে করি।’

এএসএস/এএসএ/জিকেএস