একসময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম ও দেশের বৃহত্তম বিমানবন্দর ছিল শমশেরনগর। কিন্তু বিমানবন্দরটি দীর্ঘদিন ধরে পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। সংশ্লিষ্টরা চালুর উদ্যোগ নিলেও অজানা কারণে আটকে আছে কার্যক্রম। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিমানবন্দরটি চালু হলে মৌলভীবাজার তথা সিলেট বিভাগের মানুষের যোগাযোগের নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে আশা করছেন পর্যটক ও প্রবাসীরা।
Advertisement
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ১৯৪২ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর চা বাগানের জমি অধিগ্রহণ করে একটি বিমানবন্দর গড়ে তুলে। তখন বিমানবন্দরের নাম দেওয়া হয় ‘দিলজান্দ বন্দর’।
মূলত তখন জাপান, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার (বার্মা) ও ইন্দোনেশিয়াকে দখলের উদ্দেশ্যে ৬২২ একর জমির ওপর নির্মাণ হয়েছিল বিমানবন্দরটি। ১৯৬৮ সালে একটি দুর্ঘটনার পর সেখানে বিমান ওঠানামা বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট সিলেট বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে শমশেরনগর বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সে সময় বিমানবন্দরের ভেতরে অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা না থাকায় অবকাঠামোর উল্লেখযোগ্য একটি অংশ পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়।
অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা বিমানবন্দরে ১৯৭৫ সালে বিমান বাহিনীর একটি ইউনিট খোলা হয়। সেখানে বিমান বাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি প্রশিক্ষণ স্কুল চালু করা হয়। সেই থেকে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান ও হেলিকপ্টার ওঠানামা করছে এখানে।
Advertisement
৬০০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭৫ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট এ বিমানবন্দরের বড় একটি অংশ পতিত থাকায় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন মেয়াদে স্থানীয়দের কাছে ইজারা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা ইজারা নিয়ে সেখানে বিভিন্ন সবজি ও ফলের বাগান গড়ে তুলেছেন। তবে প্রশিক্ষণ বিমান চলাচলের সুবিধার্থে রানওয়ে ও সীমানা দেওয়াল সংস্কার করেছে কর্তৃপক্ষ।
১৯৯৫ সালে সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের প্রচেষ্টায় বেসরকারিভাবে অ্যারোবেঙ্গল এয়ার সার্ভিসের ফ্লাইট চালু করেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে এই এয়ার লাইন্স যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি।
২০১৬ সালের ২৪ জুলাই মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় এক বছরের মধ্যে শমশেরনগর বিমানবন্দরটিতে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চালু হবে বলে তৎকালীন বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ঘোষণা দিলেও চোখে পড়ার মতো কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি।
প্রবাসী অধ্যুষিত সম্ভাবনাময় পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারে এ বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ চালুর দাবি জানিয়েছেন প্রবাসীরা। এখন দেশে এলে প্রবাসীরা ঢাকা ও সিলেট থেকে উড়োজাহাজে যাতায়াত করতে হয়। ফলে এত দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন অনেকে। পর্যটকরাও অনেক সময় দূরত্বের কথা চিন্তা করে এ জেলায় ভ্রমণ করতে নিরুৎসাহিত হন।
Advertisement
এছাড়া পার্শ্ববর্তী সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এখন যাত্রীর চাপও বেড়ে গেছে। ফলে বিমানবন্দরটি চালু হলে এ চাপ কমে আসবে।
প্রবাসীরা বলছেন, এ বিমানবন্দর চালু হলে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ তথা সিলেট বিভাগের মানুষ কম সময়ে যাতায়াত করতে পারবেন। পাশাপাশি এ জেলায় পর্যটন খাতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন হবে। ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবেন পর্যটক ও প্রবাসীরা।
যুক্তরাজ্য প্রবাসী মৌলভীবাজার শহরের মোবারক হোসেন বলেন, শমশেরনগর বিমানবন্দর চালু হলে ঢাকা থেকে ট্রানজিট হয়ে আমরা নিরাপদে ও কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো। এটি চালু হবে বলে দীর্ঘদিন আশ্বাসের কথা শুনে আসছি। এ প্রতীক্ষায় আমরাও দিন পার করছি।
আরেক যুক্তরাজ্য প্রবাসী মৌলভীবাজারের আপেল রহমান বলেন, ঢাকায় এসে সেখান থেকে সড়ক পথে যাতায়াত করতে গিয়ে অনেক সময় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ঢাকার যানজট, বায়ুদূষণ ও সড়ক পথের দুর্ঘটনা আমাদের আতঙ্কিত করে। ফলে দেশে আসার ইচ্ছা থাকলেও ভোগান্তির কথা চিন্তা করে অনেক সময় আসা হয় না। বিমানবন্দরটি চালু হলে আধা ঘণ্টায় বাড়ি পৌঁছানো যাবে।
বিমানবন্দরটি চালু হলে শুধু এ জেলার বাসিন্দা নন বরং উপকৃত হবেন হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও সিলেটের অনেক উপজেলার মানুষ।
কুমিল্লা শহরের বাসিন্দা মশিউর রহমান বলেন, যাতায়াতের জন্য সড়ক পথে ঢাকায় গেলে যানজট ও দূরত্ব মিলিয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়। এদিক থেকে শমশেরনগর বিমানবন্দর চালু হলে আমরা সহজে যাতায়াত করতে পারবো।
মৌলভীবাজারে আছে ৯২টি চা বাগান, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, মাধবপুর লেক, বাইক্কা বিল, এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি ও হামহাম জলপ্রপাতসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। এসব দেখতে প্রতি বছর দেশ-বিদেশের হাজার হাজার পর্যটকরা ভিড় করেন। সড়ক যোগাযোগে ভোগান্তি থাকায় মৌসুম ছাড়া বছরের অন্য সময় পর্যটক থাকেন না। ফলে অনেকে পর্যটনকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান করতে চাইলেও পরে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। বিমানবন্দরটি আবারো চালু হলে বদলে যাবে জেলার পর্যটন শিল্প। বিদেশি পর্যটকরাও আকৃষ্ট হবেন ভ্রমণে। এতে বাড়বে রাষ্ট্রীয় আয়। সমৃদ্ধ হবে জেলার অর্থনীতি। পর্যটন ব্যবসায় কর্মসংস্থান হবে হাজারো তরুণের।
মৌলভীবাজারের ওয়ান ওয়ার্ল্ড ট্যুরসের স্বত্বাধিকারী মো. মোতাহির আলম বলেন, পর্যটন জেলা হিসেবে মৌলভীবাজারকে বিকশিত করতে চাই। কিন্তু সরাসরি উড়োজাহাজ যোগাযোগ না থাকায় দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না।
ট্যুর গাইড ও অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব মৌলভীবাজারের সভাপতি খালেদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম সরকারের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পরিকল্পনা আছে। উন্নত যোগাযোগ সুবিধা না থাকায় এ শিল্প পিছিয়ে আছে। বিমানবন্দরটি চালু হলে দ্রুত এগিয়ে যাবে এ খাত।
দি মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্টিজের সভাপতি মো. কামাল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমানে পৃথিবী বৈশ্বিক গ্রামে পরিণত হয়েছে। মানুষ চায় কম সময়ে দ্রুত নিজেদের কাজ করতে। আকাশপথে যোগাযোগকে মানুষ এখন স্বস্তির মনে করছে। ভারতে কিছুদিনের মধ্যে ৩৯টি বিমানবন্দর স্থাপন করছে তাদের যোগাযোগ উন্নত করার জন্য। আমাদের দেশেও সরকার যোগাযোগের আমূল পরিবর্তনে নানা উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বন্ধ বিমানবন্দরগুলোতে আগে থেকেই অবকাঠামো আছে, শুধু একটু সংস্কার করা গেলেই আমরা নতুন কিছু বিমানবন্দর পাবো। তবে এটি যত দ্রুত হবে তত আমরা এগিয়ে যাবো। এ বিমানবন্দরগুলো চালু করা এখন সময়ের দাবি। আমাদের শমসেরনগর বিমানবন্দর চালু হলে কিছুদিন পর এখানে কার্গো আসবে। কার্গো ফ্লাইটের মাধ্যমে আমাদের চা পাতা, মিঠা পানির মাছসহ উৎপাদিত নানা কৃষি ও শিল্পপণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে রপ্তানি করা যাবে।
সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক মো. হাফিজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, শমশেরনগর বিমানবন্দর চালু হলে মৌলভীবাজার জেলাসহ আশেপাশের কয়েকটি জেলার মানুষ উপকৃত হবেন। প্রবাসী ও পর্যটকদের যোগাযোগ সহজ হবে।
মৌলভীবাজার থেকে সদ্য বদলি হওয়া জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জাগো নিউজকে বলেন, এখনো অফিসিয়ালি কোনো কাগজপত্র বা নির্দেশনা আসেনি। যদি বিমানবন্দরটি চালু হয়, তাহলে মৌলভীবাজার জেলা অনেক এগিয়ে যাবে। অর্থনীতির উন্নতি ঘটবে। এছাড়া প্রবাসী অধ্যুষিত এ এলাকায় বিমানবন্দরটি প্রয়োজন।
মৌলভীবাজার-৪ আসনের সংসদ সদস্য ড. আব্দুস শহীদ জাগো নিউজকে বলেন, বিমানবন্দরটি চালুর দাবি জানিয়ে আমি একাধিকবার সংসদে কথা বলেছি। এখানে বিমানবন্দরটি চালু হলে প্রবাসীরা সহজে যাতায়াত করতে পারবেন। এতে জেলায় পর্যটন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের দৃশ্যমান কিছু অগ্রগতি হবে। সব মিলিয়ে কারিগরি দিক খেয়াল রেখে চালু হওয়াটা প্রয়োজন।
এসজে/এএসএম