আন্তর্জাতিক

ত্রিভুজ প্রেমের ফাঁদে আটকা তাইওয়ান

তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন। সেখানে নিউইয়র্কে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। এরপর ক্যালিফোর্নিয়ায় তাকে স্বাগত জানাবেন মার্কিন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভের স্পিকার কেভিন ম্যাকার্থি।

Advertisement

তাইওয়ানিজ প্রেসিডেন্ট যে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন, তাকে মোটেও কাকতালীয় বলা যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বিরুদ্ধে গভীর ও ক্রমবর্ধমান বৈরিতা দেখা যাচ্ছে। আর এ কারণেই তাইওয়ানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি প্রকাশ্যে সমর্থন দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে যেন রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে।

গত গ্রীষ্মে সাবেক হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি যে তাইপে যাওয়ার জন্য অত উদগ্রীব ছিলেন, তার পেছনেও ছিল একই কারণ। চীনের দিক থেকে এর বিরুদ্ধে ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়ার পরেও তিনি সফরে গিয়েছিলেন। স্বায়ত্ত্বশাসিত দ্বীপ তাইওয়ানকে চীন নিজেদের অংশ বলে মনে করে। কিন্তু এই দ্বীপটিকে ঘিরেই এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিরোধ দানা বাঁধছে।

আরও পড়ুন>> যুক্তরাষ্ট্রে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট

Advertisement

তাইওয়ানের আমেরিকান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রফেসর উইলিয়াম স্ট্যান্টন বলেছেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে পেলোসির এই সফরের বিরোধী ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রের এমন একজন উচ্চপদের রাজনীতিক যখন তাইওয়ান সফর করেন, সেটি আসলে চীনকে খোঁচানোর সামিল। এ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কিছু অর্জন করার নেই। আর এর যে পরিণাম হবে, সেটিও কিন্তু বেশ ভীতিকর।

সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর বেইজিংকে ক্ষুব্ধ করেছিল। ছবি সংগৃহীত

এই সফরের জের ধরে তাইওয়ানের আকাশের ওপর দিয়ে ছোঁড়া হতে থাকে চীনা ক্ষেপণাস্ত্র, রক্ত হিম করা নানা হুমকিও দিতে থাকে বেইজিং। ওই অঞ্চলে তখন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল গুঞ্জন, চীন কখন তাইওয়ান দখলের জন্য অভিযান চালাবে।

কিন্তু এরপরও, গত জানুয়ারিতে যখন ম্যাকার্থি যুক্তরাষ্ট্রের হাউস স্পিকার নির্বাচিত হলেন, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পূর্বসূরি ন্যান্সি পেলোসিকে অনুকরণের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তবে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ঠিক করলেন, এবার আর এই কাজ মোটেও ভালো হবে না।

Advertisement

আরও পড়ুন>> তাইওয়ান নিয়ে চীনের পরিকল্পনা ছোট করে দেখা উচিত নয়: সিআইএ পরিচালক

প্রফেসর স্ট্যান্টন বলেন, আমার মনে হয়, এটি স্পষ্ট যে, কেভিন ম্যাকার্থি ন্যান্সি পেলোসির মতো কিছু একটা ঘটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সাই ইং-ওয়েন বলেছেন, ধন্যবাদ, আমিই বরং ক্যালিফোর্নিয়ায় আপনার কাছে আসি চা পান করতে।

তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন নিউইয়র্কে গেছেন একটি লিডারশিপ পুরস্কার নিতে। ছবি সংগৃহীত

প্রেসিডেন্ট সাই হয়তো চাননি আরেকজন মার্কিন নেতা এমন একটি বিতর্কিত সফরে তাইওয়ান আসুক। তবে একই সঙ্গে তার এটিও দেখানো দরকার ছিল যে, চীন যতই চেষ্টা করুক, তারা তাইপের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে শক্তিশালী মিত্র ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে বাধা দিতে পারে না।

আরও পড়ুন>> এশিয়ার ইউক্রেন হবে তাইওয়ান?

সে জন্যই ক্যালিফোর্নিয়ায় এই বৈঠকের আয়োজন। ম্যাকার্থি এই বৈঠকের গুরুত্বকে মোটেও খাটো করে দেখাচ্ছেন না। যদিও চীন হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, তাইওয়ান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ‘আগুন নিয়ে খেলছে’।

তাইওয়ানের জন্য এ ধরনের তথাকথিত ‘ট্রানজিট কূটনীতি’ অবশ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বলছেন অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ওয়েন-টাই সাং।

বিগত বছরগুলোতে চীন তাইওয়ানের অনেক সাবেক মিত্রকে তাদের পক্ষে নিয়ে এসেছে। তাইপের সরকারকে স্বীকৃতি দেয় এমন দেশের সংখ্যা এখন মাত্র ১৩টিতে নেমে এসেছে।

আরও পড়ুন>> তাইওয়ান ছেড়ে চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক যাত্রা শুরু করলো হন্ডুরাস

সাং বলেন, এসব আন্তর্জাতিক সফরের মাধ্যমে মূলত তাইওয়ানের যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজন, সেটিই পূরণ করা হচ্ছে। যখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকে না, তখন তাইওয়ানিজদের কাছে এ ধরনের আন্তর্জাতিক সমর্থনের ছায়া সূচকগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

এদিকে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টিও তাইওয়ানের মন জেতার চেষ্টা শুরু করেছে। তারা প্রেসিডেন্ট সাইয়ের পূর্বসূরি মা ইং-জিও-কে বেইজিংয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

মা চীনের পাঁচটি শহরে এক অভূতপূর্ব সফরে গেছেন। তিনি বলছেন, পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তার এই সফর। চীনের মধ্যাঞ্চলে তাদের সমাধি পরিদর্শন করেছেন তিনি। কিন্তু এটি আসলে একটি রাজনৈতিক সফরও ছিল। সত্যিকার অর্থে, এই প্রথম তাইওয়ানের কোনো সাবেক প্রেসিডেন্ট ১৯৪৯ সালের পর প্রথম চীন সফরে গেলেন।

চীনের মূল ভূখণ্ড সফরের সময় পিতামহের সমাধি পরিদর্শন করেন মা ইং-জিউ ও তার বোনেরা। ছবি সংগৃহীত

সাংয়ের কথায়, বেইজিং চেষ্টা করছে তাইওয়ানের বিষয়ে সুর কিছুটা নরম করতে, যেন তারা আরও বেশি তাইওয়ানিজদের মন জয় করতে পারে এবং ২০২৪ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সেখানে যেন জাতীয়তাবাদ আরও মাথাচাড়া না দেয়।

তার মতে, মা’র সফর এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ছায়া হিসেবে কাজ করেছে। গত সপ্তাহে তিনি যখন নানজিংয়ে নামেন, সেখানে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক ভাষণ দিয়েছেন মা।

তিনি বলেছেন, তাইওয়ান প্রণালীর দুই দিকের মানুষই চীনা। আমরা সবাই ইয়ান এবং পীত সম্রাটদের বংশধর।

আরও পড়ুন>> তাইওয়ানের আকাশে একসঙ্গে চীনের ১৮টি পারমাণবিক যুদ্ধবিমান

প্রফেসর স্ট্যান্টন বলেন, বেইজিং মা ইং-জিউ-কে এত গুরুত্ব দেওয়ার কারণ রয়েছে। তাইওয়ান যে মাথা নত করছে, তিনি হচ্ছেন তার প্রমাণ। তিনি যখন বলেন, আমরা সবাই চীনা, সেটি তো চীনেরও কথা। মানে এ বিষয়ে দু’পক্ষই একমত। কিন্তু এর সঙ্গে আবার সব তাইওয়ানিজ একমত নন।

মা’র এই কৌশলে ঝুঁকি রয়েছে। তাইওয়ানের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ নিজেদের তাইওয়ানিজ বলে ভাবেন, চীনা নয়। তবে পর্দার আড়ালে হয়তো ভালো কিছুও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

জরিপে দেখা যাচ্ছে, তাইওয়ানের অর্ধেকের বেশি মানুষ বিশ্বাস করে, চীনের সঙ্গে যুদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম। মা’র লক্ষ্য, তাইওয়ানের ভোটারদের এই বলে আশ্বস্ত করা যে, কেবল তার দল কুওমিনটাং (কেএমটি) যুদ্ধ এড়াতে পারে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে এখন আর কথা বলছেন না চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ছবি সংগৃহীত

কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং যা নিয়ে আলোচনা সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে তা হলো, তাইওয়ানের পাণিপ্রার্থী দুই বৃহৎ শক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি। ১৯৭৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন যখন পরস্পরকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়, তারপর থেকে আজ পর্যন্ত এই সম্পর্ক এতটা খারাপ কখনো হয়নি, বলছেন যুক্তরাষ্ট্রের জার্মান মার্শাল ফান্ডের এশিয়া কর্মসূচির প্রধান বোনি গ্লেসার।

তার কথায়, বেইজিং এখন আর প্রেসিডেন্ট বাইডেন বা পেন্টাগনের ফোন ধরছে না। কংগ্রেস তো চীনকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্যই হুমকি বলে ঘোষণা করেছে।

তাইওয়ানের বিষয়ে চীনের অবস্থান স্পষ্ট: বিশ্বে একটাই চীনা সরকার, সেটি বেইজিংয়ে। বহু দশক ধরে ওয়াশিংটন এ বিষয়ে একটি ধোঁয়াশার অবস্থান বজায় রেখেছে। তারা বেইজিংয়ের দাবিকে স্বীকার করলেও সেভাবে সমর্থন দেয়নি। ওয়াশিংটন ১৯৭৯ সালের পর থেকে বেইজিংয়ের সঙ্গেই সরকারি সম্পর্ক রেখেছে, তাইওয়ানের সঙ্গে নয়। তবে একইসঙ্গে ওয়াশিংটন আবার তাইপে’র মিত্র। এশীয় দ্বীপটিকে নিজেদের প্রতিরক্ষায় সাহায্য করার নিশ্চয়তা দিয়েছে তারা।

কিন্তু আশংকা হলো, চীন বিশ্বাস করে, যুক্তরাষ্ট্র এখন এতদিনের এই স্থিতাবস্থায় একটা পরিবর্তন ঘটাতে চায়। অথচ এই স্থিতাবস্থার কারণে প্রায় ৪০ বছর ধরে তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে।

গ্লেসার বলেন, প্রেসিডেন্ট বাইডেন শি জিনপিংকে বলেছেন, তিনি তাইওয়ানকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন না। তাইওয়ান চীন থেকে আলাদা থাক, সেটি তিনি সমর্থন করেন না। কিন্তু তাইওয়ানে মার্কিন কর্মকর্তাদের সফর বা তাইওয়ানের নেতাদের সঙ্গে সরকারি বৈঠকের পর এসব নিশ্চয়তায় মনে হচ্ছে না খুব কাজ হবে।

কাজেই মা যখন চীন সফর করছেন এবং সাই যখন চা পান করতে ক্যালিফোর্নিয়ায় যাচ্ছেন, তখন যেটি বেশি দরকার তা হলো, প্রেসিডেন্ট জিনপিং যেন তার ফোনটা ধরেন।

সূত্র: বিবিসি বাংলাকেএএ/