গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার হিয়াতপুর গ্রাম। ইফতারের আগে রেললাইনের পাশে একটি বাড়ির আঙিনায় কিছু মানুষের জটলা। বয়স্ক নারী-পুরুষ ও শিশু রয়েছে সেখানে। এগিয়ে যেতেই দেখা গেল, কিছু তরুণ একটি বিশাল পাত্রে রান্না করছেন। তাদের ঘিরেই এ জটলা। রোজার দিনে ইফতারের আগে নিয়মিত ঘটনা এটি। উপস্থিত এক বৃদ্ধ জানালেন, প্রতিদিন এখানে কিছু মানুষকে ইফতার ও রাতের খাবার দেওয়া হয়। তারা সেই খাবার নিতে এসেছেন।
Advertisement
বিস্তারিত জানার জন্য কথা হয় রান্নার কাজে যুক্ত এক যুবকের সঙ্গে। তার পরনে ‘হিয়াতপুর সোসাইটি’র জার্সি। তাতে নাম লেখা ‘আলভি’। নিজেকে হিয়াতপুর সোসাইটির সদস্য পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘এখানে ৭০ জন অসহায়, বিধবা ও নিঃসঙ্গ মানুষকে প্রতিদিন ইফতার ও রাতের খাবার দেওয়া হয়। এ কাজ চলবে রমজান মাসজুড়ে।’
প্রত্যেকের সঙ্গে আনা বাটিতে তাদের খাবার অতি যত্নের সঙ্গে দেওয়া হচ্ছে। ইফতার আইটেমে আছে ছোলা সেদ্ধ, বুরিন্দা, খেজুর, শসা, মাল্টা, আপেল, তরমুজ ও কলা। রাতের খাবার হিসেবে আছে গরুর মাংস দিয়ে আলু ঘাটি। এখানে পর্যায়ক্রমে মুরগি, মাছ, ডিমের তরকারি দিয়ে খাবার দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন: শিশুদের নিয়ে আলোকিত স্নানঘাটার গণিত উৎসব
Advertisement
কথা হয় ৭০ বছর বয়সী নিঃসঙ্গ মকবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে। দুজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। বউ অনেক আগেই মারা গেছে। এখন একলা আছি। তারা যে খাবার দেয়, তাই দিয়ে রোজার মাসটা ভালোভাবে খেতে পারবো। গত দুই বছর হলো খাবার নিয়ে রমজান মাসে আর চিন্তা করতে হয় না। রাতের খাবার দিয়েই আমার সেহরির খাবার হয়ে যায়। এদের খাবারই আমার ভরসা।’
হিয়াতপুর সোসাইটি গত দুই বছর ধরে এ কর্মসূচি পালন করছে। এর সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন রাশেদুজ্জামান রণ। ইফতার শেষে কথা হয় তার সঙ্গে। রণ বলেন, ‘আমরা গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের হিয়াতপুর সোসাইটি এবং বগুড়ার সোনাতলার ইচ্ছাশক্তি ফাউন্ডেশন নামে দুটি সামাজিক সংগঠনের লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে প্রতিদিন দুই স্থানে একই মেন্যু রেখে মোট ১০৫ জনকে খাবার দিয়ে থাকি।’
কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রায় চার বছর ধরে ‘প্রজেক্ট রমজান’ নামে এ প্রোগ্রাম চালিয়ে আসছি। করোনার সময় প্রথম ছোট পরিসরে শুরু করেছিলাম। লকডাউনে মানুষ তখন অসহায় হয়ে পড়েছিল। তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্যই এমন উদ্যোগ। প্রতি বছর রমজান শুরুর মাসখানেক আগেই এলাকার সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমে জরিপ করে সুবিধাভোগী খুঁজে বের করে সুশৃঙ্খলভাবে মাসব্যাপী খাবার বিতরণ করা হয়।’
আরও পড়ুন: দক্ষিণে আলো ছড়াচ্ছে উপকূল পাঠাগার
Advertisement
অর্থের জোগান সম্পর্কে রণ বলেন, ‘আমরা মূলত বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ সংগ্রহ করে প্রোগ্রামটা চালানোর চেষ্টা করি। বেশিরভাগ জোগানদাতা ও শুভাকাঙ্ক্ষীই আমাদের পরিচিত। অপরিচিত লোক বা কোনো শর্তযুক্ত সাহায্য আমরা গ্রহণ করি না। পরিচিত জনদের কাছে স্বচ্ছতা বা জবাবদিহি করা সহজ হলেও অচেনা মানুষদের কাছে জবাবদিহি করা সহজ নয়।’
এ প্রজেক্ট কতদিন চলবে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা তো আছে আমৃত্যু চালানোর। তারপরও শুভাকাঙ্ক্ষীরা যতদিন সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। যতদিন এ কাজে প্রশান্তি খুঁজে পাবো; ততদিন চলবে নিশ্চয়ই। তবে আমাদের কার্যক্রম দেখে সমাজের নানা শ্রেণিপেশার মানুষ এ কাজে সহায়তা করেন। শুধু অর্থ দিয়ে নয়। তারা চাউল, জ্বালানি ও শ্রম দেন। এছাড়াও নানাভাবে সহায়তা করেন।’
পরদিন ইফতারের আগে বগুড়ার সোনাতলায় ইচ্ছাশক্তি ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম দেখা গেল। সেখানেও একই পদ্ধতি মেনে কাজ করছেন তারা। কথা হয় খাবার নিতে আসা ৬০ বছর বয়সী জরিনা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের ভরসা বয়স্ক ভাতা। এই দিয়েই চলি। রোজার মধ্যে সেই ভাতায় চলতে কষ্ট হয়। তবে এনারা যে খাবার দিচ্ছে, তাতে আর কষ্ট হয় না। নিয়মিত আমরা দুজন (স্বামী-স্ত্রী) খাবার পাচ্ছি।’
আরও পড়ুন: শেষ হলো আলোকিত স্নানঘাটার গণিত উৎসব
ইচ্ছাশক্তি ফাউন্ডেশনের সদস্য ফজলে রাব্বী বলেন, ‘এবারই প্রথম এ কাজ করছি। প্রথমবার হিসেবে এলাকায় বেশ সাড়া পড়েছে। সুবিধাবঞ্চিতরা খুব আনন্দের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করছেন এবং প্রশংসা করছেন। আমাদের মূল টার্গেট বিধবা। এরপর নিঃসঙ্গ মানুষ। স্বামী পরিত্যক্তা বা বউ মারা গেছে এমন। চেষ্টা করেছি সিঙ্গেল ডিজিট খোঁজার। স্বামী-স্ত্রী দুজনের দেখার কেউ নেই, এমন কয়েকজনকেও সিলেক্ট করেছি।’
এরই মধ্যে এলাকার মানুষের মাঝে এ কাজ ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। তাদের খাবারের পরিমাণ এবং মান নিয়েও বেশ সন্তুষ্ট সবাই।
এসইউ/জেআইএম