গোলাম কিবরিয়া পিনুর (১৯৫৬) জন্ম গাইবান্ধায়। তার গ্রন্থ ২৯টি। কবিতা, ছড়া ও প্রবন্ধ লিখে চলেছেন অবিরাম। শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেছেন। ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন অংশ অনেক কবিতায় উঠে এসেছে। সাংবাদিকতা, সম্পাদনা, কর্মকর্তা প্রভৃতির বিভিন্ন ধাপে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো—এখন সাইরেন বাজানোর সময় (১৯৮৪); সোনামুখ স্বাধীনতা (১৯৮৯); পোট্রেট কবিতা (১৯৯১); সুধাসমুদ্র (২০০৮); আমি আমার পতাকাবাহী (২০০৯); ফসিলগুয়েল হয়ে জ্বলি (২০১১); মুক্তিযুদ্ধের কবিতা (২০১২); উদরপূর্তিতে নদীও মরে যাচ্ছে (২০১৪); কবন্ধ পুতুল (২০১৬), ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো (২০১৯)।
Advertisement
পিনুর কবিতা আমাদের কোথায় পৌঁছে দিতে চায়, কোথায় নিয়ে যেতে চায়? তার কবিতার প্রাণভোমরা কী? এই ত্রিবিধ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। স্বাধীনতার অক্ষুণ্নতা ও অখণ্ডতা, মানবতাবোধ, কবিতায় বলে যাওয়ার স্বাধীনতা হচ্ছে পিনুর কবিতার প্রাণভোমরা। পাঠককে আনন্দ দেওয়ার পাশাপাশি প্রজ্ঞাবান বা কিছু বার্তা দেয়—যে বার্তা মানবের জন্য কল্যাণকর, স্বাধীনতা ও দেশের জন্য শুভকর, ব্রেইনস্ট্রমিং করার বিপুল সুযোগ। তার কবিতার শব্দরা রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতো মগজে বিশ্লেষিত হয়। ভিন্নতর কল্যাণকর একটা পরিবেশ তৈরির খোরাক দেয়। তার কাব্যভাষায় চমৎকারিত্ব রয়েছে। চরিত্রের উপলব্ধির সক্ষমতা কাব্যভাষাকে গাঢ়ত্ব দিয়েছে। মিথ, ইতিহাস-ঐতিহ্য মিলেমিশে একাকার হয়েছে তার কবিতায়। ‘সৌন্দর্য পকেটভারী হয়ে কারও পকেটে থাকে না’ (সৌন্দর্য), ‘তুমি আমাদের মূলভূমির বিদ্রোহ ও চেতনার রাজ্য’ (অগ্নিবীণার গান), ‘পঞ্চমুখী জবা, ওকে যমে টানলে/তোমাকেও যেতে হবে লাশকাটা ঘরে’ (সুন্দরবনকে একা থাকতে দাও), ‘কলগ্রাসে পড়ে কালসমুদ্রে হারিয়ে যায় কত নদী’ (হৃদয়গ্রন্থি), ‘মোড়ে মোড়ে যেতে যেতে মোচড়ায় না মধ্যযুগীয় ব্যথা’ (আকাশনীলিমা), ‘তাজ্জব হলেই তাবৎ বিপদ কাটবে না আজ’ (তামাদি) ইত্যাদির মতো শব্দশৈলী ব্যবহার পাঠককে মুগ্ধ করছে।
আরও পড়ুন: এখানে কয়েকটি জীবন: গল্পজুড়ে জীবনের বিস্তার
বহুরৈখিতা রয়েছে পিনুর কবিতায়। রং ছড়িয়ে যায় পাঠকের মননে। চিন্তার খোরাক দেয়। ইতিবাচক কিছু করার নতুন কিছু ভাবনার জন্ম দেয়। যেমন- ১. তাতানো উষ্ণতা ঠোঁটেমাতানো ভালোবাসাঅগ্নিপ্রভা,শীতকালে হিমঘরে থেকে থেকেহাত ও পা জমে গিয়েছিল,হিমায়ন প্রক্রিয়ায়(অগ্নিপ্রভা, সুধাসমুদ্র)
Advertisement
২. তোমার অন্তর—অন্তরা হয়ে বাজে প্রাণে—গানে—ঐকতানে।(অগ্নিবীণার গান, ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো)
মুখ ও মুখোশ চিরকালেরই প্রবঞ্চনার একটি বিষয়। প্রযুক্তির যুগে আসল-নকল বুঝে নিতে কষ্ট হয়। পারস্পরিক বিশ্বাস, সহমর্মিতা, স্নেহ, সহযোগিতা ইত্যাদি ইতিবাচক বিষয়ে সন্দেহ প্রবল হচ্ছে। মানুষ স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। এসব বিষয় উঠে এসেছে পিনুর কবিতায়। কখনো প্রতীকীর আশ্রয় নিয়েছেন। কখনো অনন্য শব্দশৈলী ব্যবহার করেছেন। অতি সহজ-সরল বাক্য, চিত্রকল্প ব্যবহারে অনেকেই তার কবিতার গাঢ়ত্ব বুঝতে পারেন না। এ সহজ-সরল শব্দ বা শব্দশ্রেণি পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছতে সক্ষম। ভবিষ্যতে হয়তো বিপরীত পাঠকের কথা বিবেচনা করে স্টাইলে নতুনত্ব আনবেন আশা করি। প্রকৃতিকে ভালোবাসেন তিনি। বাংলাদেশের ফুসফুস বা আমাজান সুন্দরবন নিয়েও চিন্তিত তিনি। বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবিতায়। নদী, বন আর পাহাড় প্রকৃতি তার কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ। ‘সুন্দরবনকে একা থাকতে দাওওর নিঝুমতা নিয়ে একা থাকতে দাওওর পাখির কিচিরমিচির নিয়েওর ডেঁয়োপিঁপড়ে নিয়েওর ঝুলনপূর্ণিমা নিয়েওর নদীর জলশব্দ নিয়ে একা থাকতে দাও।’(সুন্দরবনকে নিয়ে একা থাকতে দাও, ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো)
সাহসিক শব্দ ও চিত্রের ব্যবহার দেখা যায়। বিনয় আর প্রতিরোধ পাশাপাশি চলে তার কবিতায়। বিনয়বোধ দেখাতে গিয়ে নীতি-নৈতিকতার কথা ভুলে যাননি। ‘পোট্রেট কবিতা’ গ্রন্থের বেশিরভাগ কবিতাই সাহসের কথা বলে। সাহসী হতে শেখায়। দুর্দিনে কাছে দাঁড়ায় শহীদ মিলন, নূর হোসেন, শহীদ তাজুল, নেলসন ম্যান্ডেলা, মণি সিং, ইলা মিত্র, কমরেড তছির উদ্দীন কবিতাগুলির অনুপ্রেরণা আর উদ্দীপনার নাম—১. মিলন, আপনি মুহূর্তেই গুলিবিদ্ধ হলেন, তখনগুলিবিদ্ধ হলো যেন বহুজনআর সেইসাথেমানুষেরা ব্যথা জাগানর রোষ নিয়েফেটে পড়লো দগ্ধ ক্ষোভে...মিলন, আপনি মিলনের পথে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন দৃঢ়ভাবে সবাইকেফোটালেন চোরাস্রোতের বিরুদ্ধে স্বচ্ছ জলধারা(শহীদ মিলন)
২. এতটা রোদের আলো দেখেনি কখনো—এতটা বাতাসে প্রাণ দেখেনি কখনো—এতটা আবেগ ছায়া দেখেনি কখনো—এতটা ক্ষিপ্রতা হায় দেখেনি কখনো—এতটা ব্যঞ্জনা মাখা দেখেনি কখনো—এতটা প্রতিকী ছবি দেখেনি কখনোঅতঃপর টার্গেট ফায়ার...(নূর হোসেন)
Advertisement
৩. নাচোলে আঁচল বিছিয়েছিল কে? তাঁরসবুজ আঁচলে অবুঝ পাখিরা বসতে পেয়েছিল,ছায়ায় ছায়ায়সম্মুখ উত্থানে (ইলা মিত্র)
স্টাইল, বিন্যাস ও শব্দচিত্রে খুব বেশি বৈচিত্র্য না-থাকলেও তার কবিতার শব্দেরা খেলা করে নীল আকাশে। কখনো রঙিন ঘুড়ি হয়, কখনো বা মেঘ হয়। কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পাঠকের মনে দোলা দেওয়া বা আনন্দ দেওয়া। এই আনন্দের সঙ্গে পাঠককে ভিন্ন কিছু বার্তা দেওয়া পিনুর কবিতার বৈশিষ্ট্য। অনাহার, বৈষম্য, অত্যাচার নেতিবাচক দিকগুলো উঠে এসেছে কোনো কোনো কবিতায়।১. দাসু আলীনিজের জমিতে স্পর্শ রাখতে পারে নাপদাক্ষগুলির ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে নাচাষী হয়ে—শিকড়হীন উদ্ভিদ যেন।(দাসু আলী, এখন সাইরেন বাজানোর সময়)
২. মারণাস্ত্রের সময়কালআগামীর মুহূর্তগুলো কীভাবে কাটাবো?...অক্সিজেন পুড়ে অবশেষে নিঃশেষ হতে পারেআমাদের এই অস্তিত্ব কোথায় লুকাবে তখন?(বিপন্ন অস্তিত্ব, এখন সাইরেন বাজানোর সময়)
৩. এই তল্লাটের সবাইকে আমি চিনিএর অলিগলিএর বাসাবাড়ি আমি চিনি।(তল্লাটের সবাইকে চিনি, ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো)
আরও পড়ুন: প্রকাশনা জগতের একজন পথিকৃৎ মহিউদ্দীন আহমদ
স্বদেশপ্রেম, বোধ আর সৌন্দর্য পিনুর কবিতার অন্যতম তিনটি প্রবণতা। কবিতায় এ প্রবণতাগুলো চেতনা, মন ও বিবেককে জোরালো করে। পিনুর কবিতার এ সক্ষমতা তার কবিতা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে ভবিষ্যতেও। আরও একটু বৈচিত্র্য, আরও একটু নতুন চিত্র বা চিত্রকল্প তাকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে ভবিষ্যতে আরও উজ্জ্বল করে দিতে পারে। ঋজু লেখায় বহুমাত্রিকবোধ জন্ম নেয়। জীবনানন্দ দাশের কোনো এক বোধ জন্ম নেয়। দিনাজপুরে নিহত ইয়াসমিনকে ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে লেখা—১. কে কাকে পৌঁছে দেবে দিনাজপুরেভরসা করা ফরসা আকাশ কই?(কে কাকে পৌঁছে দেবে দিনাজপুরে)
২. ‘বোধ’ জন্ম নেয় আরও—‘সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষতাকে আবারও সুড়ঙ্গে ঢোকানো হচ্ছে কেন?গুহা থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষতাকে আবারও গুহার ভেতর ঢোকানো হচ্ছে কেন?’(আকাশপ্রান্ত নিয়ে বাঁচা, ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো)
৩. শামুকের মতহাঁড়ি-কলসীর ভেতর না ঢুকেদাঁড়াও মানুষ,উঁচু দাঁত নিয়ে নয়নীল স্পর্শী করতে আকাশস্পর্শী হও।(মানুষ, কে কাকে পৌঁছে দেবে দিনাজপুরে)—কবিতা হচ্ছে আনন্দ ও বাস্ততবতার মেলবন্ধনের কারুকার্জ। শব্দ দিয়েই সেই কাজ করেন কবিরা।
মানসিক বা সামাজিক বা ইতিহাসের চরিত্র ব্যবহার (ম্যান্ডেলা, ইলা মিত্র, নূর হোসেন, শহীদ মিলন, মণি সিং, দাসু আলী, শহীদ তাজুল প্রভৃতি) বক্তব্যকে স্পষ্ট করেছে, তেজস্বী করেছে। কবিতার বক্তব্য বা বার্তাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার এ প্রচেষ্টা পিনুকে আলাদা করেছে। একই শব্দ বা শব্দশ্রেণি বা অব্যয়ের পুনঃপুন ব্যবহার ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। অনেক কবিতায় এ ধারা লক্ষ্য করা যায়—‘সাইরেন বাজানোর সময় এখনকোনো শিথিল শৈথিল্য থাকতে পারে নাজাগরণ যাকে বলে, তাই দরকারউন্মোচন যাকে বলে, তাই দরকারউন্মীলন যাকে বলে, তাই দরকার।’(সাইরেন)
কবিতায় নতুন ফর্ম নির্মাণ করা জিনিয়াস কবিদের বৈশিষ্ট্য। আশা করি পিনু কবিতায় নির্মাণ-বিনির্মাণ, আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উন্নতর (নবতর) কবিতায় একটা নিজস্ব ফর্ম, স্টাইল বা ভাষা তৈরি করবেন। পাঠককে নতুন নতুন রুচির ব্যবস্থা করে সর্বদা সতেজ রাখার ব্যবস্থা করবেন। কবিতায় বহুবিধ এসব প্রচেষ্টার মাধ্যমে কবিতাসাহিত্যে নিজের অবস্থান নির্ধারণ করে সুদৃঢ় করবেন। কবির কাছে আমার এ আশা আকাশকুসুম ভাবনা নয়। হয়তো দেখব তার কবিতারা জানালা দিয়ে হাতছানি দিচ্ছে পাঠককে এই বলে ‘বেরিয়ে যাও অবারিত সাগরে’। বাংলা কবিতার জগতে আলোকপ্রভা নেচে উঠুক। গোলাম কিবরিয়া পিনু কবিতার মাধ্যমে সে পথেই হাঁটছেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কবিতার জয় হোক। এই আশাবাদের পূর্ণতা পাক—‘কাকতাড়ুয়া কাক তাড়াতে পারেআমাকে তাড়াতে পারবে না কেউকবিতার জমি থেকে।...কবি ও কবিতা অনিবার ও অনিবার্য। আর্য ও অনার্য বলে কোনো ভেদাভেদ নেই!’(কবিতা, ঝুলনপূর্ণিমা থেকে নেমে এলো)
এসইউ/জেআইএম