উদ্যোম আর সাহস অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে মৌলভীবাজারের রাধাবতীকে (৬৬)। তিনি এখন দেশের আলোচিত বুনন শিল্পী। দেশে প্রথম কলা গাছের আঁশের সুতা দিয়ে তৈরি করেছেন শাড়ি। তার এ সাফল্যে দেশীয় তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হলো নতুন এক শিল্প। বুননশিল্পী রাধাবতীর নামের সঙ্গে মিল রেখে শাড়ির নামকরণ করা হয়েছে ‘কলাবতী শাড়ি’।
Advertisement
জানা গেছে, বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি নারীদের নিয়ে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটানোর টার্গেটে কাজ করে যাচ্ছেন। কলাগাছের আঁশ দিয়ে বান্দরবান জেলায় বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি হয়ে আসছে। সেই চিন্তা থেকেই ‘কলাবতী’ শাড়ির উদ্ভাবন।
কলার ফলন শেষে গাছগুলো আর কাজে লাগে না। সেই গাছের আঁশ থেকে সুতা তৈরি করে পর্যটন জেলা বান্দরবান এলাকায় নৃ-জাতিরা বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরি করেন। এক সময় ওই সুতা বিদেশে রপ্তানি করা হতো। খরচ বেশি হওয়ায় এখন রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তাই এই শিল্পকে কাজে লাগানো যায় কিভাবে এমন চিন্তা থেকেই শাড়ি তৈরির উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়।
স্থানীয়রা জানান, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাঝেরগাঁও গ্রামের ব্রজ ভল্লব সিংহের মেয়ে রাধাবতী। প্রাপ্ত বয়সে বিয়ে হলেও মনের মিল না হওয়ায় স্বামীকে ছেড়ে দেন তিনি। এরপর ভাই রঞ্জিত সিংহের সংসারে ঠাঁই হয় নিঃসন্তান রাধাবতীর। ভানুবিল মাঝেরগাঁও গ্রামে বসবাস করেন তিনি।
Advertisement
এক সময় রাধাবতী সিলেটে গিয়ে মনিপুরি তাঁত শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। কাজ শিখে চলে আসেন নিজ এলাকায়। ১৯৯২ সাল থেকে শুরু করেন মনিপুরি শাড়ি তৈরির কাজ। বিভিন্ন এনজিও সংস্থার প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন এলাকায়।
মৌলভীবাজারের মনিপুরি তাঁত শিল্পের সেই নিপুন কারিগর রাধাবতীর হাতে ১২ দিনে তৈরি হয়েছে দেশে প্রথম কলাগাছের আঁশের সুতা থেকে শাড়ি।
জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় রাধাবতীর। তিনি বলেন, আমার ফুফুতো ভাই গুণমনি বান্দারবানে ব্যবসা করেন। তার স্ত্রী বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সাই সাই উ নিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করে বান্দারেবান যাওয়ার জন্য। আমি সেখানে যাওয়ার পর জেলা প্রশাসক আমাকে বলেন কলাগাছের আঁশের সুতা দিয়ে শাড়ি তৈরির কথা। আমি প্রথমে ভয় পাই। তারা আমাকে উৎসাহ দিলেন। আমি তাঁতের মেশিনসহ অনেক উপকরণ নিয়ে অনেক কষ্ট করে ১২ মার্চ চলে যাই বান্দরবান। এলাকার হেমন্তকে নিয়ে ১২ দিনে শাড়ি তৈরি করে আমার ভয় কেটেছে। আমি অনেক উৎসাহ পেয়েছি।
তিনি বলেন, যদি ওই সুতা আরও মিহি করা যায় তাহলে উন্নত মানের শাড়ি তৈরি সম্ভব।
Advertisement
কথা হলে ভানুবিল এলাকার কমিউনিটি ব্যাজ পর্যটনের পরিচালক নারায়ণ সিংহ জাগো নিউজকে বলেন, রাধাবতীকে নিয়ে আমরা গর্বিত। মনিপুরি তাঁত শিল্পকে তিনি অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমাদের তাঁত শিল্পের প্রক্রিয়াতেই কলা গাছের আঁশের সুতা দিয়ে শাড়ি তৈরি করে দেশে নতুন আরেক শিল্পের আবির্ভাব ঘটেছে। আমরা তাকে সম্মানিত করেছি।
রাধাবতীর ভাবি বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সাই সাই উ নিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি জয় একতা মহিলা কল্যাণ সমিতি বান্দরবান ও বান্দরবান ওমেন চেম্বার অব কর্মাসসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে কাজ করি। জেলা প্রশাসকের শাড়ি তৈরির উদ্যোগের সঙ্গে আমি নিজে যুক্ত হই। আমার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করে রাধাবতীর সন্ধান পাই এবং তার এক স্বজন হেমন্তকে দিয়ে সব ব্যবস্থা করা হয়।
বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি জাগো নিউজকে বলেন, জেলা প্রশাসক হিসেবে বান্দরবানে যোগদানের পর থেকে এখানে দেখি অফিস আদালত বা সভা সেমিনারে ব্যবহারের জন্য কলা গাছের তন্তু দিয়ে তৈরি ফোল্ডার, কলমদানি, ঝুড়ি, পাপশ, শতরঞ্জিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি হচ্ছে। এই থেকে চিন্তা আসে কলাগাছের তন্তু দিয়ে শাড়ি তৈরি করা যায় কিনা। আমরা সফল হয়েছি। নারীদের সংস্পৃক্ত করে আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ঘটানোর টার্গেটেই কাজ করে যাচ্ছি। কলাবতী শাড়ির মান আরও উন্নত করার জন্য বস্ত্র তাঁত মন্ত্রণালয়ে চিটি দিয়েছি। দেশে প্রথম কলাগাছের আঁশের সুতা দিয়ে তৈরি শাড়ি প্রস্তুত করতে ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বান্দরবানে এসে কলার তন্তু দিয়ে কাজ করার সময় আমি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপপরিচালক আতিয়া চৌধুরী ও বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক সাই সাই উ নিনিকে কাছে পেয়েছি। তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা।
এফএ/জেআইএম