জাতীয়

শুধু দোকান নয়, পুড়েছে হাজারো পরিবারের স্বপ্ন

আগুন লাগার খবর পেয়েই তড়িঘড়ি করে বঙ্গবাজারে ছুটে আসেন ব্যবসায়ী মো. ওমর ফারুক। এসে দেখেন মার্কেটে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। এ আগুনে শুধু দোকান নয়, পুড়ছিল হাজারো পরিবারের স্বপ্ন আর ঘাম ঝরানো রক্ত। আগুনের এ ভয়াবহতা আর নিজের পরিবারের ভবিষ্যতের চিন্তায় দুই হাত তুলে মোনাজাত করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন ওমর ফারুক।

Advertisement

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, বঙ্গবাজার মার্কটে তার চারটি দোকান ছিল। আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে চারটি দোকানে গত সপ্তাহে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মালামাল তুলেছেন। কিছুদিনের মধ্যে বিক্রি শুরু হলে দোকানের সব মালামাল ভালো লাভে বিক্রি করতে পারতেন বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন: এখনো নেভেনি এনেক্সকো ভবনের আগুন

কিন্তু আগুন সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, করোনার সময় ব্যবসা ভালো হয়নি। এজন্য এবার ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ও গ্রামে কিছু জমি বন্ধক রেখে মালামাল তুলেছিলাম। এখনতো আমার কিছুই রইলো না। না আছে দোকান, না আছে মালামাল। আমি কোথায় যাবো, কী করবো?

Advertisement

ঈদের বাকি আর ১৭/১৮ দিন। মুসলমানদের বৃহত্তম এই ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে বঙ্গবাজারের সব দোকানেই বিপুল পরিমাণ কাপড় মজুত করেছিলেন ব্যবসায়ীরা।

মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) সকালে হঠাৎ এই মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লাগে। যা পরে ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গমার্কেটের সঙ্গে লাগোয়া মহানগর শপিং মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, ইসলামিয়া ও এনেক্সকো টাওয়ারে। এসব মার্কেটে আগুন লেগে তছনছ হয়ে যায় কয়েক হাজার ব্যবসায়ীর দোকান। এ আগুনে শুধু দোকান নয়, পুড়েছে হাজারো পরিবারের স্বপ্ন আর ঘাম ঝরানো রক্ত।

আরও পড়ুন: পোড়া কাপড়ের স্তূপে ভালো কাপড় খুঁজছে ছিন্নমূল মানুষ

ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডে নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চোখের সামনে পুড়ে ছাই হতে দেখেন মুক্তা গার্মেন্টসের মালিক মনির হোসেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জাগো নিউজকে তিনি বলেন, খবর শুনেই এসে দেখি আগুন আর আগুন, আমার এক কোটি টাকার পাঞ্জাবি পুড়ে ছাই।

Advertisement

ঈদ টার্গেট করে ৪৮ লাখ টাকার শাড়ি বঙ্গবাজার মার্কেটের দোকানে তুলেছিলেন তিনি। এছাড়া এনেক্সকো টাওয়ারে শাড়ির গুদামে ৬৭ লাখ টাকার মালামাল ছিল। এ বিষয়ে মনির হোসেন বলেন, কয়েকদিন আগে নারায়ণগঞ্জে নিজ এলাকা থেকে জমি বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে ঈদ উপলক্ষে মালামাল তুলেছি। সব শেষ।

শুধু ওমর ফারুক কিংবা মনির হোসেন নয়, তাদের মতো পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীর এখন একই অবস্থা।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, বঙ্গবাজারসহ আশপাশের ৬টি মার্কেটের ৫ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঈদ উপলক্ষে তারা অনেক মালামাল ক্রয় করেছিলেন। সেগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও পুলিশ প্রশাসনের সদস্যদের চেষ্টায় অনেকে মালপত্র উদ্ধার করে সরিয়ে নিতে পেরেছেন, তারপরও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

আরও পড়ুন: বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে যাওয়া কাপড় কিনছে বিদ্যানন্দ

ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাসান গার্মেন্টসের মালিক ইয়াসিন আহমেদ জাগো নিউজে বলেন, ‘ও ভাই, কিছু নাই, সব পুইড়া শ্যাষ। কয়েকদিন আগে গোডাউনে ৭৫ লাখ টাকার মাল তুলছি। আমার দুই কোটি টাকার মালামাল পুইড়া ছাই হয়ে যাচ্ছে। গোডাউন, দোকান সব শেষ। আমি কী করবো?’

রিয়াজুল গার্মেন্টস, খান ফ্যাশন, এস এ গার্মেন্টস, খান শাড়ি বিতানসহ বঙ্গমার্কেটে ৫টি দোকান ছিল ব্যবসায়ী মো. মামুনের। ঈদকে সামনে রেখে ৫টি দোকানে ১০ কোটি টাকার মালামাল তুলেছিলেন তিনি। কিন্তু আগুনে এক নিমিষেই সব শেষ হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়া এ ব্যবসায়ী কাঁদছিলেন আগুন থেকে বাঁচাতে পারা অল্পকিছু মালামালের বস্তার ওপর বসে।

ব্যবসায়ী মামুন বলেন, আমার জীবনের সব উপার্জন যে আগুনে পুড়ে গেলো, এই ক্ষতির দায় নেবে কে? কে আমার ঋণ পরিশোধ করবে? আমার তো কিছুই নেই। সব শেষ হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন: দোকান থেকে বের করে আনা শেষ সম্বলটুকুও হচ্ছে চুরি

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থলের পাশে ফুটপাতে কথা হয় নিউ ফ্যাশন নামে একটি দোকানের কর্মচারী জামিল হাসানের সঙ্গে। জাগো নিউজকে জামিল বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া মার্কেটগুলোতে ৫০ হাজারের বেশি কর্মচারী রয়েছে। অধিকাংশ দোকানের কর্মচারী গত মাসের বেতনও পায়নি। এর মধ্যে আগুনে সব পুড়ে গেছে। এখন দোকান মালিক কবে গত মাসের বেতন দেবেন সেটাও জানি না। এছাড়া ঈদের আগে মার্কেট ঠিক করা সম্ভব হবে কি না, দোকান আবার খুলবে কি না সেটাও জানি না। এই অবস্থায় আমরা কীভাবে ঈদ করবো বলেন ভাই? কীভাবে ঘর ভাড়া দেবো, কীভাবে ছেলে-মেয়ে, মা-বাবাকে টাকা পাঠাবো?

দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প করে জমানো টাকা ১৭ বছর আগে একমাত্র ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাজুন্নেসা বেগম। ওই টাকা দিয়ে ছেলে কামরুজ্জামান রনি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে একটি ছোট্ট দোকানে শুরু করেছিলেন পাইকারি পোশাক ব্যবসা। মায়ের জীবনের সঞ্চয়ের মূলধনে ব্যবসা শুরু করা রনি দোকানের নাম দিয়েছিলেন তাজ ফ্যাশন। ১৭ বছর ধরে এই দোকানটিই রনির পরিবারের একমাত্র আর্থিক অবলম্বন। অসুস্থ বাবার চিকিৎসাও চলছিল এর আয় থেকে।

আগুনে এই একটিমাত্র দোকান হারিয়ে রনি হতবিহ্বল। খবর পেয়ে পথে বসা ছেলের কাছে ছুটে আসেন মা তাজুন্নেসা। খোলা আকাশের নিচে বসে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বিলাপ করতে করতে কিছুক্ষণ পর পর চোখ মুছছিলেন তিনি, তা দেখে ডুকরে কেঁদে চলছিলেন রনি।

আরও পড়ুন: জাগো নিউজের সংবাদ দেখিয়ে যা বললেন ফায়ারের ডিজি

জাগো নিউজকে রনি বলেন, ‘রোজার এই কয়দিন (গত ১১ দিন) বেচা-বিক্রি নাই। সোমবারই ১৬ লাখ টাকার মাল তুলছি। সব নগদ টাকায়। ভেবেছিলাম ১৮-২০ রোজা থেইক্কা মার্কেট জমবো। কিন্তু আমার এ কী সর্বনাশ হইলো। আমার মায়ের জমানো টাকা দিয়া ব্যবসা শুরু করছিলাম। আমার বাপটা বিছানায় পড়া। আর কোনো ইনকাম নাই আমাগো। কে দেখবো এখন আমার ঘর?’

রনি জানান, আশপাশের দোকানিদের সহযোগিতায় ২০ শতাংশ মতো মালামাল উদ্ধার করতে পেরেছেন। বাকি সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ফায়ার সার্ভিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী হোসাইন বলেন, ‘৬টা বাজে যখন তথন আগুন লাগছে। সেসময় তাদের ডাক দিলে তারা বোতল (আগুন নির্বাপক) নিয়া আসছে আগুন নিভাইতে। কিন্তু আগুন নেভে না। তাদের বলছি পানির গাড়ি নিয়া আসেন। পরে গিয়ে তারা পানি নিয়ে আসছে, সেটারও স্পিড নাই। সারা দেশের ফায়ার সার্ভিসের মেইন অফিস এইখানে, আর এইখানে বলে তাদের পাম্পে পানি নাই।’

আরও পড়ুন: জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মালামাল রক্ষা হলো না

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘যেইখানে আগুন লাগছে তার উল্টা পাশে ফায়ার সার্ভিসের হেড অফিস, কিন্তু আগুন নিভলো না কেন? পুরাটা পুইড়া ছাই হইয়া গেছে, বিশ্বাস হয়!’

যা বলছে ফায়ার সার্ভিসতিন কারণে বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হয়েছে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, পানি সংকট, উৎসুক জনতা ও বাতাসের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের চেষ্টায় দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এছাড়া সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, ওয়াসাসহ অন্যান্য বাহিনী ও সংস্থা আমাদের সঙ্গে কাজ করেছে।

আরও পড়ুন: কালও দুই লাখ টাকার মাল উঠাইছি, সব শেষ

নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করা একটি ভিডিও দেখিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ডিজি বলেন, এখানকার উৎসুক জনতার ভিড়ে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে। এখানে এত বেশি ভিড় ছিল যে কোনো জায়গায় গিয়ে আমাদের সদস্যরা কাজ করবেন সেই জায়গাও ছিল না। দ্বিতীয় সমস্যা ছিল পানির স্বল্পতা, আর তৃতীয় সমস্যা হলো বাতাস। বাতাসের কারণে এক জায়গার আগুন আরেক জায়গায় ছড়িয়ে যায়।

ফায়ার সার্ভিসের অফিসে হামলা করলো কারা ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. মাইন উদ্দিন বলেন, আগুন লাগা মার্কেটটি ও ফায়ার সার্ভিসের অফিস রাস্তার এপাশ-ওপাশ। আমি ফায়ার সার্ভিসের ডিজি হিসেবে বলতে চাই, আমাদের ওপর কেন হামলা হলো? কারা করেছে? এ ঘটনার তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বঙ্গবাজার মার্কেটকে ১০ বার নোটিশ দেয় ফায়ার সার্ভিস‘বঙ্গবাজার মার্কেটকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা’ করা হয়েছিল। এরপর সংশ্লিষ্টদের ১০ বার নোটিশ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কথা শোনেননি বলে জানিয়েছেন, ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।

আরও পড়ুন: যে ৩ কারণে আগুন নেভাতে দেরি

তিনি বলেন, ২০১৯ সালে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বঙ্গমার্কেটটি ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করা হয়েছিল। এছাড়া আমরা ব্যানার টানিয়ে ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ১০ বার নোটিশ দিয়েছি। আমাদের যা যা করণীয় ছিল সব করেছি। তারপরও এখানে ব্যবসা চলেছে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত কমিটিবঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এ কমিটিকে আগামী তিনদিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

বারবার আগুনের কারণ অনুসন্ধানের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীররাজধানীর বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উঠে এসেছে মঙ্গলবারের একনেক সভার আলোচনায়। এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বারবার আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি এর সমাধানে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনার বিষয়টি সভা শেষে ব্রিফিংয়ে তুলে ধরেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

আরও পড়ুন: আমার ৮০ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে, নিঃস্ব হয়ে গেছি

একনেক সভার বরাত দিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, সভায় বঙ্গবাজারে আগুনের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন, অনেক আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। এতগুলো পরিবার ঈদ সামনে রেখে কী করবে, এই ভেবেও প্রধানমন্ত্রী অনেক কষ্ট অনুভব করেন।

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সরকার কোনো সহায়তা দেবে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, বিষয়টি আমার পরিষ্কার জানা নেই। তবে আমার মনে হয় কিছু একটা করা হবে।

টিটি/কেএসআর/এমএস