পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপ্রগতিশীল শক্তির অবদান থাকলেও অসাম্প্রদায়িক ধারার প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মূলত আওয়ামী লীগই মানুষের কাছে বেশি পরিচিতি পেয়েছে।
Advertisement
আওয়ামী লীগের এই পরিচিতি একদিনে হয়নি। ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই হয়েছে। মানুষের আস্থা যে আওয়ামী লীগের ওপরই, সেটা স্পষ্ট হয়েছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করেছিল। জনগণের ওই ম্যান্ডেটই বঙ্গবন্ধুকে আইনগত ভিত্তি দিয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িক ধারার অপসারণ ঘটলেও তা আবার ফিরে আসে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কী ঘটেছিল তা বোধ হয় কাউকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না। ওই দিন যদি শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হতো, ক্ষমতা দখল করা হতো, তাহলে ১৫ আগস্টের তাৎপর্য হতো এক রকম। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে দেশকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা যেদিকে যাত্রা করেছিলাম, তার ঠিক বিপরীত দিকে দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল, সেটা খুবই পরিষ্কার।
পঁচাত্তরের ঘাতকরা তাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনার কথা পরবর্তীকালে ঘোষণা দিয়েই বলেছে। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে, তারাও সবাই ব্যতিক্রমহীনভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটা প্রজন্মও তারা গড়তে চেয়েছেন, যাতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হয়ে পড়ে বিভ্রান্ত এবং দেশের মানুষ হয়ে পড়ে ইতিহাসবোধহীন ও আত্মগৌরবহীন। চিরকালের বঞ্চিত, নিগৃহীত এ অঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বঙ্গবন্ধু যে গৌরবের আসনে বসিয়েছিলেন, সে আসন থেকে জাতিকে বিচ্যুত করার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে কোনো ভুল করেননি, দেশশাসন করতে গিয়ে কোথাও ভ্রান্তির শিকার হননি বা ব্যর্থ হননি, এমন কথা নিশ্চয়ই আমি বলব না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল তার ভুল বা ব্যর্থতার জন্য নয়-বরং তার সাফল্যের জন্য। একাত্তরের পরাজিত শক্তি পরিস্থিতি তৈরি করেছিল বিজয়ী জাতির ওপর প্রতিশোধ নিতে; সে লক্ষ্যেই তারা আঘাত হেনেছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির শক্তির প্রতীক, বিজয়ের প্রতীক। তাকে হত্যা করা গেলে জনগণকে স্তম্ভিত ও হতবিহ্বল করে দেয়া যাবে- এটাই ছিল তাদের রণকৌশল। এতে তারা সফল হয়েছিল বৈকি। পরবর্তীকালে একই উদ্দেশ্যে তারা জেলখানার ভেতর ঢুকে সভ্যজগতের সব রীতিনীতি লঙ্ঘন করে হত্যা করে চার জাতীয় নেতাকে, যারা বঙ্গবন্ধুর দৈহিক অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাতিকে নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথমে জিয়ার ও পরে এরশাদের সেনাশাসন আমলে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক-প্রগতিশীল দল ও গোষ্ঠীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর দেশজুড়ে তীব্র দমনপীড়ন নেমে এসেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘ একুশ বছর লেগেছে তার হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফিরে আসতে। ১৫ আগস্টের পর দেশে পাকিস্তানি ধারার ষড়যন্ত্রের রাজনীতি পুরোদমে চালু হলেও আওয়ামী লীগ তাতে কোনোভাবে অংশ না নিয়ে গণতান্ত্রিক-নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাকে শক্তিশালী করারই প্রয়াস নিয়েছে। তাতে ধীরে ধীরে সাড়া দিয়েছে জনগণ।
Advertisement
এই প্রক্রিয়াতেই নব্বইয়ে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, এরশাদ স্বৈরাচারের পতনের পর দেশে নতুন করে শুরু হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। কিন্তু দেখা গেল ১৯৯১ সালে যারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলো, তাদের রাজনৈতিক আদর্শ, মন-মানসিকতাও সামরিক ছাঁচে গড়া। গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের কোনো ছাপ তাদের ওপর পড়েনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধু প্রশ্নে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অবস্থান প্রায় ঘাতকচক্রের মতোই প্রতিক্রিয়াশীল।
ইতিহাস সাক্ষী, আওয়ামী লীগ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধেও লড়েছে। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা, ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার অনুষ্ঠানের দাবি থেকে পিছু হটেনি আওয়ামী লীগ। এই দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়েছে দেশের মানুষ। একুশ বছর পর ক্ষমতায় ফিরে এসেছে আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়ী হয়ে।
এই ফিরে আসাটা ছিল ঐতিহাসিক এবং গৌরবজনক। জাতির জনককে হত্যা করে দেশকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে দলকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে, সেই দল ক্ষমতায় ফিরে এলো অপশাসন ও ষড়যন্ত্র ভেদ করে, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে করতে, জনগণের আশীর্বাদ ও দোয়া নিয়ে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তাকে মুছে ফেলার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও প্রয়াস যারা চালিয়েছিলো, তারা বুঝতে পারেনি যে ইতিহাস ও সত্যকে মুছে ফেলা যায় না। বঙ্গবন্ধু কোনো ভুঁইফোড় নেতা ছিলেন না। তিনি ফাঁকিবাজি বা চালাকি করেও নেতা হননি। তাকে হত্যা করে দেশ ও জাতির মুখে যারা চপেটাঘাত করেছিল, দম্ভ করে নিজেদের অপকীর্তির কথা ঘোষণা করেছিল, তারা ও তাদের দোসরদের দেরিতে হলেও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কোনোদিন সম্ভব হবে না বলে যারা দম্ভোক্তি করতেন, তারা মাথানত করে দেখেছেন যে, এদেশের রক্তে ভেজা মাটিতেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু এটাও তো বেদনাদায়ক যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের মতো ন্যায্য কাজটি সম্পন্ন করতেও এতগুলো বছর লেগে গেল এবং সত্য যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসার আগে কোনো সরকারই ওই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের কোনোরকম উদ্যোগ নেয়নি! পঁচাত্তর-পরবর্তীকালের সরকারগুলোকে যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ‘সুফলভোগী’ বলা হয় তা নিশ্চয়ই অন্যায্য কিছু নয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সূত্রে ক্ষমতায় আসা সেনাশাসকদের হাতে তৈরি রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে বিকশিত করার ক্ষেত্রেও কোনো সহায়ক ভূমিকা রাখেনি বলেই দেশে এখনো রাজনৈতিক স্থিতি আসেনি, গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা সুদৃঢ় ভিত্তি পায়নি। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগকে ‘সমঝোতা’য় উপনীত হয়ে রাজনীতি করার উপদেশ যারা দেন, তারা এ কথাটি একবারও ভেবে দেখেন না যে, একাত্তর ও পঁচাত্তর প্রশ্নে ওইসব দলের অবস্থান কী।
একাত্তরে জনগণ যে চেতনা নিয়ে লড়েছিল, সেই চেতনা ও পঁচাত্তরে যে উদ্দেশ্যে রক্তপাত ঘটানো হলো, সেই ঘৃণ্য উদ্দেশ্যের ব্যাপারে তাদের বক্তব্য ও অবস্থান যদি গণতন্ত্রবিরোধী হয়, তাহলে তাদের সঙ্গে রাজনীতিতে ‘সমঝোতা’য় উপনীত হওয়া কি কঠিন নয়? আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে ন্যায়সংগত পদক্ষেপ নেয়ার পরও কি সবাই স্বাগত জানিয়েছে? তার বদলে ঘাতকদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটানোর ঘোষণা দিয়ে কি রাজনৈতিক মঞ্চ থেকেই বক্তব্য রাখা হয়নি?
ঘাতকদের মুক্ত করে ষড়যন্ত্র ও প্রতিক্রিয়ার রাজনীতিকে বেগবান করার অপচেষ্টা কি দেশে নেই? ক্ষমতায় বসে আকস্মিকভাবে ১৫ আগস্টে বেগম জিয়ার জন্মদিন আবিষ্কার ও উৎসব করে কেক কাটার উৎসাহেও এখন পর্যন্ত ভাটা পড়েনি। এদেশের জনগণ ও রাজনীতির ট্র্যাজেডি এই যে, গণতান্ত্রিক বাতাবরণেও এ ধরনের শক্তি দেশে সরব রয়েছে এবং তাদের সঙ্গেই প্রতিযোগিতা করে রাজনীতি করতে হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া সংগঠন আওয়ামী লীগকে।
এই প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণেই সংবিধানে ও আওয়ামী লীগ সরকারের করে যাওয়া আইনে বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা হলেও তাকে নিয়ে সৃষ্টি করা কৃত্রিম বিতর্ক শেষ হচ্ছে না। এটা ঠিক, সব রকম প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশ নানা দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু অগণতান্ত্রিক শক্তির ভূমিকার কারণে একাত্তর ও পঁচাত্তর প্রশ্নের নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এই দুটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ মিথ্যার সঙ্গে ‘সমঝোতা’ করবে কীভাবে?
মুক্তিযুদ্ধে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পরাজয়কে ওই ধারার রাজনৈতিক শক্তিগুলো কখনোই মেনে নেয়নি। ’৭২-’৭৫ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য কর্মকাণ্ড এবং কোনো কোনো অতিবিপ্লবী বাম রাজনৈতিক দলের ভেক ধরে এই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাদের তৎপরতা চালিয়ে যায়- যার প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশে পুনরায় সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধারার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এই শক্তিগুলো ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখতে সক্ষম হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো কোনো বাম রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব সাম্প্রদায়িক শক্তির এই তৎপরতার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এদের সম্মিলিত তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তদানীন্তন আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু ব্যর্থতাও ।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও মানবিকতার স্বার্থটা সার্বক্ষণিক লড়াইয়ের, এটা ভুলে গেলে চলবে না। পাকিস্তানি ধারার সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান যে শেষ হয়ে যায়নি তা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাই প্রমাণ করছে। কিন্তু ট্র্যাজেডিটা হলো আমরা অনেকেই এটা ভুলে বসে আছি এবং মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিষয়টি বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুখে কেউ কেউ অসম্প্রদায়িকতার কথা বললেও সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনে উৎসাহী দেখা যায় না তেমন কাউকেই। এই লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের যেমন দুর্বলতা আছে, তেমনি এই আন্দোলনের মিত্ররাও এখন হীনবল।
লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।
এইচআর/জেআইএম