দেশজুড়ে

ঈদে ৩০০ কোটি টাকার লাচ্ছা বিক্রির আশা

আসন্ন ঈদুল ফিতর সামনে রেখে বগুড়ায় সেমাই তৈরির ধুম পড়েছে। ছোট-বড় ২০০ কারখানায় তৈরি হচ্ছে লাচ্ছা সেমাই। বগুড়ার তৈরি এসব সেমাই যায় উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিভিন্ন কোম্পানি তাদের প্যাকেটে বগুড়া থেকে লাচ্ছা সেমাই তৈরি করে সারাদেশে নিজ ব্র্যান্ডিংয়ে বিক্রি করে।

Advertisement

ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদন হবে প্রায় ২০ হাজার টন (নরমাল ও ঘি ভাজা মিলে) লাচ্ছা সেমাই। যার বাজারমূল্য ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

বগুড়ার তৈরি সাদা চিকন সেমাইয়ের কদর রয়েছে দেশজুড়ে। সেমাই তৈরির জন্য জেলার আশপাশে বিভিন্ন উপজেলায় গড়ে উঠেছে সেমাই গ্রাম। এখন সাদা সেমাইয়ের পাশাপাশি লাচ্ছা সেমাইও পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে। আধুনিক মেশিনে মানসম্মত উপায়ে তৈরি হয় এসব লাচ্ছা সেমাই। তবে কিছু মৌসুমি ব্যবসায়ী শ্রমিক দিয়ে ম্যানুয়ালি লাচ্ছা সেমাই তৈরি করেন।

আরও পড়ুন: মাংস খাওয়া কমিয়েছে ৯৬ শতাংশ নিম্নবিত্ত, মাছ ৮৮

Advertisement

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এবার কাঁচামালের দাম অনেক বেশি। তারা চাহিদামতো লাচ্ছা সেমাই তৈরি ও সরবরাহ করতে পারছেন না। অন্য বছরের তুলনায় এবার মানভেদে দামও কিছুটা বেশি। ব্যয়ের সামঞ্জস্যতা রাখতে তারা বাধ্য হয়েছেন দাম বাড়াতে।বগুড়ার বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট অ্যান্ড কনফেকশনারি দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি উত্তরবঙ্গ পরিষদ সূত্রে জানা গেছে, বগুড়ায় ব্র্যান্ড (প্যাকেটজাত সেমাই) ও নন-ব্র্যান্ড (খোলা সেমাই) মিলে রমজানে দুই শতাধিক কারখানা বিভিন্ন ধরনের লাচ্ছা সেমাই তৈরি করছে। এসব কারখানায় জেলার প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক কর্মরত। বগুড়ায় তৈরি লাচ্ছা সেমাই স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে।

গত বছর নন-ব্র্যান্ডের খোলা লাচ্ছা সেমাই প্রতি কেজি ৮০-৯০ টাকা পাইকারি দরে বিক্রি হয়েছিল। এবার সেই লাচ্ছার মূল্য ধরা হয়েছে ১২০-১৪০ টাকা। ব্র্যান্ডের বক্স লাচ্ছা ২০০-২৪০ টাকার জায়গায় এবার পাইকারি বিক্রি হবে ২৮০-৩০০ টাকায়। গত বছর ঘিয়ে ভাজা যে লাচ্ছা মানভেদে ৪০০ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, এবার সেই একই লাচ্ছা ৮০০-১৬০০ টাকায় বিক্রি করতে হবে ব্যবসায়ীদের।

আরও পড়ুন: কমছে দুধের দাম, পথে বসছেন খামারিরা

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লাচ্ছা সেমাই তৈরি কাঁচামাল হিসেবে অপরিহার্য সব উপাদানের দাম বেড়েছে। আগের বছর পাম অয়েলের দাম ছিল প্রতি ড্রাম ১৭ হাজার টাকা। এখন সেই পাম অয়েলের ড্রাম ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে ৩০ হাজার টাকায়। ডালডার অবস্থাও ঠিক একই। লাচ্ছা তৈরিতে ডালডা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়। গত বছর ডালডার ১৬ কেজির প্রতিটি কার্টনের দাম ছিল ১ হাজার ৬০০ টাকা। দাম বেড়ে বর্তমানে প্রতি কার্টনের দাম হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা।

Advertisement

আটার মূল্যবৃদ্ধিও থেমে নেই। গত বছর ৭৪ কেজির প্রতি বস্তা ময়দার দাম ছিল দুই হাজার টাকা। সেই ময়দার বস্তার এবার ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। অর্থাৎ বস্তাপ্রতি ময়দার দাম বেড়েছে ১০০০-১১০০ টাকা।

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার লাচ্ছা সেমাই কারখানা মালিক আব্দুল মোতালেব জাগো নিউজকে জানান, কাঁচামালের দাম বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শ্রমিকের মজুরির মূল্য। লাচ্ছা সেমাই তৈরিতে শ্রমিকরা বস্তাপ্রতি পারিশ্রমিক নেন। এক বস্তা লাচ্ছা সেমাই কাজের জন্য শ্রমিকেরা গত বছর খরচ নিয়েছিলেন ৪৫০ টাকা। ১০০ টাকা বেড়ে শ্রমিক খরচ এবার দাঁড়িয়েছে ৫৫০-৬৫০ টাকায়।

আরও পড়ুন: সুলভমূল্যের দুধ-ডিম-মাংসের চাহিদা বাড়ছে

বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কুট অ্যান্ড কনফেকশনারির দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি উত্তরবঙ্গ পরিষদের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও খাজা কনফেকশনারির এমডি বায়েজিদ শেখ বলেন, বিশ্ববাজারসহ সবখানেই দাম বাড়ছে। কাঁচামাল কিনতে গিয়েও আমাদের এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কারণ জানতে চাইলেই আমাদের ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের অজুহাত দেওয়া হচ্ছে। যদিও আটার জন্য গম আসে কানাডা থেকে। তবু বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়েছে।

তিনি বলেন, এসব কারণে এবার লাচ্ছা সেমাইয়ের দাম বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এবার প্রায় দ্বিগুণ দামে সেমাই বিক্রি করতে হবে ব্যবসায়ীদের।

কথা হয় বগুড়ার প্রসিদ্ধ রাজা লাচ্ছা সেমাই কারখানার মালিক রাজা মিয়ার সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে জানান, লাচ্ছা সেমাইয়ের প্রসার ঘটে চল্লিশের দশকে। শুরুর দিকে কলকাতা ও হুগলি থেকে এনে বিক্রি করা হতো। ষাটের দশকে বগুড়ার চিকন ও লাচ্ছা সেমাইয়ের সুনাম দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আশির দশকের পর বৈচিত্র্যময় স্বাদ ও মানের লাচ্ছা সেমাই তৈরিতে খ্যাতি ছড়ায় আকবরিয়া হোটেল ও এশিয়া সুইটস।

আরও পড়ুন: আমরা অনেকের চেয়ে ভালো আছি: ওবায়দুল কাদের

এশিয়া সুইটসের কারখানায় দুই দশক ধরে লাচ্ছা সেমাই তৈরির প্রধান কারিগর হিসেবে কাজ করছেন আবদুল কাদের। তিনি বলেন, বর্তমানে এশিয়া ডালডা লাচ্ছা ও ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই তৈরি করছে। এ কাজ করে তিনি দৈনিক পারিশ্রমিক পান ১ হাজার ২০০ টাকা।

অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সেমাই তৈরি

বগুড়া শহর ও শহরতলি ছাড়াও শাহজাহানপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে চিকন সেমাই কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি হচ্ছে সেমাই ও লাচ্ছা।

সরেজমিন দেখা গেছে, কারখানায় সেমাই তৈরি হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা ও নোংরা পরিবেশে। সেমাই তৈরির আগে তৈরি করা হয় ময়দার খামির বা মণ্ড। ঈদে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত বাজারজাত করতে খামির তৈরি হচ্ছে পায়ে দলে। খামির তৈরিতে শ্রমিকের শরীরের ঘাম ময়দার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এ খামির মেশিনে ফেলে তৈরি করা হচ্ছে চিকন ও লাচ্ছা সেমাই। তৈরি সেমাই শুকানো হচ্ছে উন্মুক্ত উঠানে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে।

আরও পড়ুন: মুড়ি-বুট আর পানিতে হয় বস্তিবাসীর ইফতার

শাজাহানপুর উপজেলার মাদলা ইউনিয়নের কয়েকজন কারখানার মালিক জানান, চিকন সেমাই ও লাচ্ছা তৈরির উপকরণ ময়দা, ডালডা ও সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় স্বল্প পুঁজির ছোট কারখানার বেশিরভাগই বন্ধ হয়ে গেছে। আগের মতো আর সেমাই তৈরি হচ্ছে না। চিকন সেমাই ও লাচ্ছা সেমাইয়ের দামও গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। ঈদের বাজারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকরা পায়ে দলে খামির তৈরি করছেন।

স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রং মিশিয়ে ভেজাল তেল দিয়ে লাচ্ছা সেমাই তৈরি করে অবাধে বিক্রি করছেন। পরিত্যক্ত কক্ষ বা ভাড়া করা ঘরে লাচ্ছা সেমাই তৈরি করা হচ্ছে। লাচ্ছা সেমাই তৈরির অনেক দোকানের লাইসেন্স নেই। অনেকে আবার নিম্নমানের আটা ব্যবহার করছেন। এসব দোকানের মালিকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ঈদ পর্যন্ত লাচ্ছা সেমাই তৈরির কাজ চলবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বগুড়া কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ইফতেখারুল আলম রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, ঈদকে সামনে বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাচ্ছা সেমাই জব্দ করে তা ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ধরনের অভিযান চলবে।

এসআর/জিকেএস