নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ভুল-ত্রুটি যুক্ত পাঠ্যবই রিভিউয়ের কাজ শেষ হয়েছে। পাঠ্যবই প্রণয়ন কমিটি পাঁচদিন দিনরাত কাজ করে রিভিউ শেষ করেছে বলে জানিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। রোজার মধ্যে সংশোধনীসহ দেশের সব স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তবে সংশোধনী নিয়েও উঠেছে নতুন বিতর্ক। একটি পক্ষ বলছে, রিভিউ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংশোধন হয়নি পাঠ্যবইগুলো।
Advertisement
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিভিউ কমিটির একজন সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, আরও চিন্তা-ভাবনা ও প্ল্যান করে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বইগুলো তৈরি করলে ভালো এবং উপযোগী হতো। বর্তমানে এগুলো রিভিউ করা হয়েছে। তারা কী পরিবর্তন করেন, আমরা সে অপেক্ষা করছি। নতুন শিক্ষাক্রমের বই নিয়ে সমালোচনা উঠলেও আগামী বছরের জন্য অষ্টম থেকে দশম শ্রেণির বই প্রণয়নে একই ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটির কিছু সদস্য পরিবর্তন করার সুযোগ ছিল।
আরও পড়ুন>> পাঠ্যবইয়ে ভুল: সংশোধনী ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশ
এই সদস্য বলেন, ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বয়সের সঙ্গে সমন্বয় করে কাভার পেজ নির্ধারণ করা হয়নি। ১১-১২ বছরের শিক্ষার্থীদের বই প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের মতো করা হয়েছে। এতে বিষয়বস্তু সঠিকভাবে নির্বাচন করা হয়নি। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যেসব বিষয় পড়তে পছন্দ করে সে ধরনের বিষয় যদি নির্বাচন করা হতো তবে তাদের কাছে বইগুলো বেশি উপভোগ্য হতো। বর্তমানে সেগুলো রিভাইস করতে চাইলে সেভাবে করা সম্ভব হবে না। রিভিউ কমিটি সুপারিশ দিলেও সেটিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পাঠ্যবই প্রণয়ন কমিটির ইচ্ছা অনুযায়ী রিভিউ করা হয়েছে।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, পাঠ্যবইয়ের বিষয়গুলোর যে সব অ্যাক্টিভিটিজ থাকবে, সেগুলোর আবার নানা ধরনের পরিকল্পনার বিষয় রয়েছে। যেমন কোন কোন জিনিসগুলো কাভার করবে তার ওপর ভিত্তি করে শব্দ ভান্ডার নির্ধারণ করতে হবে। গ্রেডের ম্যানারে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত কী ধরনের শব্দ ভান্ডার শেখাবে তার একটি সংখ্যা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। সেখানে যেমন দুই হাজার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত শব্দ শেখানোর পরিকল্পনা করা যেত। ক্লাস অনুযায়ী শব্দ ভান্ডার নির্বাচন করা দরকার।
আরও পড়ুন>> ‘নতুন পাঠ্যবইয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা হয়েছে’
‘প্রথম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত গ্রামারে কোন ধরনের বিষয়গুলো দেওয়া হবে তার একটি পরিকল্পনা থাকতে হবে। ইংরেজি বইয়ের মধ্যে পড়া-লেখা, বলা ও শোনার বিষয়টি ভালোভাবে দেওয়া হয়নি। সে কারণে পরবর্তী ক্লাসের পাঠ্যবই প্রণয়ন কমিটিতে পরিবর্তন প্রয়োজন। রিভিউ কমিটির পক্ষ থেকে এ ধরনের সুপারিশ করা হয়েছিল।’
এদিকে নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ওই দুটি বইয়ের নাম একই। এনসিটিবি জানিয়েছিল, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়েরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে। তিনটি বইয়ের সংশোধনী ‘শিগগির’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জানানো হবে। কিন্তু মার্চ শেষ হলেও সংশোধনী দিতে পারেনি এনসিটিবি।
Advertisement
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করতে গেলে পৃথিবীর সব দেশে এ ধরনের কথাবার্তা ওঠে। নতুন বই যখন হয় তখন সেটি পরীক্ষামূলক এডিশন হিসেবে যায়। আমাদের এখানে ২০১২ সালে যে বই প্রণয়ন করা হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে গেছে। সেখানেও এমন অনেক ছবি, তথ্য, তত্ত্ব নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক ছিল। পরে সেগুলো সংশোধন করা হয়েছে। এটা লেখক সমাজের দোষ নয়।
‘ভুল কোনো তথ্য দিয়ে বই তৈরি করা হয়েছে- এ ধরনের কথা কেউ বলেনি। তত্ত্বের, তথ্যের ভুল হলে লেখকের ভুল হতো। এই বইটি ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার জন্য উপযোগী নয়, এমন অনেকে অনেক কিছু ভাবতে পারেন। এটা এভাবে না ওভাবে হতে পারতো- এমনও ভাবতে পারেন। লেখক কমিটির ওই অর্থে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি নেই। আমরা জানতাম যে নতুন বই নিয়ে অনেক অভিযোগ পাওয়া যাবে। ভবিষ্যতেও আসবে। তখন আবারো সংশোধন করা হবে। একেবারে নির্ভুল পাঠ্যপুস্তক কোথাও কেউ করতে পারেনি।’
আরও পড়ুন>> পাঠ্যবইয়ে ভুল: অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা
রিভিউ কমিটির দেওয়া সুপারিশ অনুযায়ী নতুন পাঠ্যপুস্তক সংশোধন হচ্ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, রিভিউ কমিটির পক্ষ থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞানের দুটি বই সংশোধন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাদের সুপারিশগুলো আমলে নেওয়া হয়েছে। তবে তারা যা বলবেন তার সব কিছুই গ্রহণ করতে হবে বিষয়টি এমন নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, রিভিউ করে কমিটির মতামত নেওয়ার জন্য। সেটা মন্ত্রণালয় করেছে। একই সঙ্গে গত ২০ থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ৩০টি বইয়ের মধ্যে প্রতিটি বিষয়ের জন্য ছয়জন করে বিশেষজ্ঞ দিয়ে পুরো বই পড়ে মতামত চাওয়া হয়।
তিনি বলেন, সারাদেশের ২৬টি জেলার ৫৩টি বিভিন্ন ধরনের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মতামত এনেছি। এ পর্যন্ত গণমাধ্যমসহ অন্যভাবে পাওয়া অভিযোগ লেখক প্যানেলের কাছে দেওয়া হয়। তারা গত ২৭ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ৩০টি বই পাঁচদিনের কর্মশালার মাধ্যমে নতুনভাবে রিভিউ কাজ শেষ করেছেন।
‘বর্তমানে সব সংশোধন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেশের বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। রোজার মধ্যে এসব পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ঈদের ছুটির পর স্কুল খুলবে, তখন ক্লাস শিক্ষকরা একসঙ্গে শিক্ষার্থীদের বইয়ের মধ্যে সংশোধন করে দেবেন।’
এনসিটিবি সূত্রে জানা যায়, এই সংশোধনীর জন্য এর আগে যাচাই-বাছাইয়ে (ট্রাই আউট) সারাদেশের প্রায় ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এনসিটিবির কর্মকর্তারা তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর ২০, ২১ ও ২২ মার্চ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে এ নিয়ে কর্মশালা ও মতামত নেওয়া হয়। তার ভিত্তিতে ২৭ থেকে ৩১ মার্চ পরিমার্জনের কাজটি করা হয়। চলতি বছরের পাঠ্যবই নিয়ে অভিযোগ ছিল। বই লেখার কাজটি খুবই কম সময় নিয়ে করা হয়েছিল। শিক্ষাবর্ষের শেষ সময়ে এসে পাণ্ডুলিপি লেখার কাজ করে তা ছাপা হয়। এতে অনেক ভুল-ত্রুটি ধরা পড়ে, যা নিয়ে কড়া সমালোচনার মধ্যে পড়ে এনসিটিবি। কিন্তু বছরের তিন মাস পর আগামী বছর প্রাথমিক স্তরের তৃতীয়-চতুর্থ ও মাধ্যমিকের অষ্টম-নবম শ্রেণির বই লেখার কাজ শুরু করা হয়েছে। এসব বইতেও বড় ধরনের ভুল-ত্রুটি হতে পারে বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আগামী বছরের জন্য প্রাথমিকের দুই স্তরের ও মাধ্যমিকের দুটি শ্রেণির নতুন বইয়ের কাজ শুরু করা হয়েছে। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবই রিভিউ কাজের জন্য আগামী বছরের বইয়ের কাজ স্থাগিত রাখা হয়েছিল। যেহেতু এখন রিভিউ কাজ শেষ, আবারও নতুন বইয়ের কাজ শুরু করা হবে।
এমএইচএম/এএসএ/এমএস