পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন পাওয়া জীবন বিমা কোম্পানি ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আবেদন আগামীকাল সোমবার থেকে শুরু হবে। আগ্রহী বিনিয়োগকারীরা ৯ এপ্রিল পর্যন্ত কোম্পানিটির আইপিওতে আবেদন করতে পারবেন।
Advertisement
আইপিওতে ১০ টাকা করে ১ কোটি ৬০ লাখ শেয়ার ইস্যু করবে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ১৬ কোটি টাকা উত্তোলন করবে। এই টাকা ফিক্সড ডিপোজিট, সরকারি সিকিউরিটিজ ও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ এবং আইপিও ব্যয়ে ব্যবহার করা হবে।
এদিকে বছরের পর বছর ধরে বিমা গ্রাহকদের টাকা আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে খরচ করছে নতুন প্রজন্মের এই জীবন বিমা কোম্পানিটি। একই সঙ্গে প্রতি বছর কোম্পানিটি যে নতুন বিমা পলিসি বিক্রি করছে, তার সিংহভাগ তামাদি হয়ে যাচ্ছে। এতে দুর্বল হয়ে পড়ছে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা।
ফলে ভবিষ্যতে এই জীবন বিমা কোম্পানিটি গ্রাহকদের দাবির টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। সম্প্রতি এক তদন্ত করে এমন অভিমত দিয়েছে আইডিআরএর তদন্ত দল।
Advertisement
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই তদন্ত করে আইডিআরএ। ‘মাত্রাতিরিক্ত কমিশন ও প্রশাসনিক ব্যয় এবং অন্যান্য অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ভবিষ্যতে গ্রাহকের বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে’ এমন অভিযোগের ভিত্তিতে গত বছরের ২৪ জুলাই ১৩টি বিমা কোম্পানির আর্থিক সক্ষমতা তদন্তের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে আইডিআরএকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
এর পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। সম্প্রতি ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে আইডিআরএর তদন্ত দল। তদন্তে ট্রাস্ট লাইফের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চ হার, দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন কম হওয়া, কোম্পানির নগদ আন্তঃপ্রবাহ কম থাকাসহ বেশ কিছু অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ প্রতিবছর যে প্রিমিয়াম আয় করছে, তার প্রায় পুরোটাই ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির পাঁচ বছরের আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করেছে তদন্ত কমিটি। এই পাঁচ বছরে কোম্পানিটি ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ব্যয় করেছে ২৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
একটি জীবন বিমা কোম্পানি ব্যবস্থাপনা খাতে কী পরিমাণ অর্থ খরচ করতে পারবে, তা আইনে নির্ধারিত আছে। আইন অনুযায়ী, ২০২১ সালে ব্যবস্থাপনা খাতে ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ১৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি খরচ করে ২০ কোটি ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে এ খাতে অবৈধভাবে খরচ করা হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
Advertisement
আগের বছর ২০২০ সালে এ খাতের সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা ছিল ১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি খরচ করে ২২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। ৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা আইনি সীমার অতিরিক্ত ব্যয় করা হয়। ২০১৯ সালে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত খরচ করা হয় ৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। আইন অনুযায়ী ওই বছর ব্যবস্থাপনা খাতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত ছিল ১৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। কিন্তু কোম্পানিটি খরচ করে ২২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
একইভাবে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা নির্ধারিত হয় ১৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। এর বিপরীতে কোম্পানিটি খরচ করে ২১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত খরচ করা হয় ৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে আইনি সীমার অতিরিক্ত খরচ করা হয় ৫ কোটি ৮ লাখ টাকা। বছরটিতে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ১২ কোটি ২২ লাখ টাকা। কোম্পানিটি খরচ করে ১৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
শুধু এই পাঁচ বছরে নয়, ব্যবসা শুরুর পর থেকে কোম্পানিটি এভাবে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করছে। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্যবসা শুরুর প্রথম বছর ২০১৪ সালে কোম্পানিটি বিমা পলিসি বিক্রি করে প্রিমিয়াম আয় করে ১১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় করে ১৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
পরের বছর ২০১৫ সালে প্রিমিয়াম বাবদ আয় হয় ১৬ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় হয় ১৭ কোটি ১৪ লাখ টাকা। একই ভাবে ২০১৬ সালে ২০ কোটি ৭ লাখ টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় করে ২১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যবসা শুরুর কয়েক বছর প্রতিষ্ঠানটি যে আয় করে তার থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করে।
এদিকে আইডিআরএর তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, প্রতিবছর কোম্পানিটির সিংহভাগ পলিসি তামাদি বা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ২০২১ সালে কোম্পানিাটির মোট বিমা পলিসি ছিল ১১ হাজার ৮১১টি। বছরটিতে পলিসি তামাদি হয় ৭ হাজার ৭৪৩টি। এতে সচল পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৬৮টি। বছরটিতে তামাদি পলিসির হার ৬৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
আগের বছর ২০২০ সালে তামাদি পলিসির হার ছিল ৮২ দশমিক ২১ শতাংশ। বছরটিতে মোট বিমা পলিসি ছিল ১২ হাজার ৭২২টি। এরমধ্যে ১০ হাজার ৪৫৯টি পলিসি তামাদি হয়ে যায়। ফলে সচল পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ২৬৩টি। ২০১৯ সালে পলিসি তামাদির হার ছিল ৮৫ দশমিক ১৫ শতাংশ। বছরটিতে মোট বিমা পলিসি ছিল ১০ হাজার ৮২টি। এরমধ্যে ৮ হাজার ৫৮৫টি তামাদি হয়ে যায়। ফলে চলমান পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৪৯৭টি।
একই ভাবে ২০১৮ সালে কোম্পানিটিতে তামাদি পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ১৭৭টি। এ বছর মোট বিমা পলিসি ছিল ১০ হাজার ৬৭টি। ফলে বছর শেষে সচল পলিসির সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৮৯০টি। আর তামাদি পলিসির হার দাঁড়ায় ৭১ দশমিক ২৯ শতাংশ। ২০১৭ সালে পলিসি তামাদির হার ছিল ৭৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বছরটিতে ৯ হাজার ১৪৫টি বিমা পলিসির বিপরীতে তামাদি পলিসি দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৬টি। এতে সচল পলিসি থাকে ২ হাজার ৫৯টি।
এভাবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়ায় কোম্পানিটির নবায়ন প্রিমিয়াম আয়েও ধস নেমেছে। প্রতি বছর কোম্পানিটি নতুন বিমা পলিসি বিক্রি করে যে প্রিমিয়াম আয় করছে, পরের বছর তার সিংহভাগ আদায় হচ্ছে না। ২০২১ সালে কোম্পানিটির দ্বিতীয় বর্ষ নবায়নের শতকরা হার দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। ২০২০ সালে দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন প্রিমিয়াম আদায়ের হার ছিল ২৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর আগে ২০১৯ সালে ২১ দশমিক ৮১ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ২৫ দশমিক ৮২ শতাংশ আদায় হয়। অর্থাৎ প্রতি বছর কোম্পানিটি নতুন যে পলিসি বিক্রি করছে, পরের বছরই তার ৭০ শতাংশের বেশি আর আদায় হচ্ছে না।
ট্রাস্ট ইসলামী লাইফের আর্থিক চিত্র পর্যালোচনা করে আইডিআরএর তদন্ত দল অভিমত দিয়েছে, দ্বিতীয় বর্ষ প্রিমিয়াম নবায়ন হার, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদি হওয়ার হার এবং প্রিমিয়াম সংগ্রহের ব্যয় কোম্পানির আর্থিক ভিত্তিকে দুর্বল করে রেখেছে। কোম্পানির নগদ আন্তঃপ্রবাহ কম থাকায় ভবিষ্যতে ট্রাস্ট লাইফ গ্রাহকদের উত্থাপিত বিমা দাবি পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে। আবার পাঁচ বছরের মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত না হয়ে কোম্পানি অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করেছে।
আইডিআরএর তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ব্যয়, পলিসি তামাদির উচ্চ হার এবং দ্বিতীয় বর্ষ নবায়ন কম হওয়ায় বিমা আইন-২০১০ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রকৃত বিমা পলিসি ইস্যুর ক্ষেত্রে জোর দেওয়া, কমিশন ব্যয় হ্রাস করা, পলিসি তামাদি হওয়ার হার কমানো এবং কোম্পানির সম্পদ বিধিমালা অনুযায়ী বিনিয়োগের নির্দেশ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি কোম্পানির সার্বিক আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র বিশেষ নিরীক্ষার মাধ্যমে চিহ্নিত করার সুপারিশও করেছে আইডিআরএ।
এমএএস/এমকেআর/জিকেএস