বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য বাঁশ-বেত শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। নান্দনিক এ কুটির শিল্পের দুর্দিনেও বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কয়েক জন কারিগর। আধুনিক সভ্যতার দাপটে প্লাস্টিক সামগ্রীর বাজার দখল, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল না পাওয়া ও মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে চাহিদা কমে যাওয়ায় মানুষ এ পণ্যের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। তবে কিছু কারিগর বাঁশ থেকে মাছ বহনের খাড়ি তৈরি করে বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছেন।
Advertisement
বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ-বেতের সামগ্রীর চাহিদা কমায় উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের নগড়পাড়া জিয়সতলা এলাকায় বেশ কয়েক ঘর কারিগর বাঁশ দিয়ে মাছের খাড়ি তৈরি করে বাপ-দাদার পেশা টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। দিন দিন বিভিন্ন জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাড়ি বানাতে খরচ বাড়লেও বাড়েনি এ শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের মূল্য। যে কারণে কারিগররা অর্থাভাবে জীবন সংসারে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ উপজেলায় এক যুগ আগেও তিন শতাধিকের বেশি পরিবার এ পেশায় সম্পৃক্ত ছিল। আধুনিক সভ্যতার দাপটে নানা কারণে লাভজনক না হওয়ায় অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। গৃহস্থলির কাজে বাঁশ ও বেতের তৈরি নান্দনিক উপকরণ সামগ্রী শিশুদের দোলনা, র্যাগ, পাখা, ঝাড়ু, টোপা, সাজি, ওরা, কুলা, মোরা, পুরা, দাড়িপাল্লা, ঝাঁপিসহ গৃহস্থলি পণ্য এখন কদর হারিয়েছে।
আরও পড়ুন: মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পাট
Advertisement
চাহিদা কমে যাওয়ায় প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে কারিগররা পূর্বপুরুষের পেশা ধরে রাখতে মাছ বহনের খাড়ি তৈরিতে ঝুঁকে পড়েন। এখানেও ঘটে বিপত্তি। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল না পাওয়া ও মূল্য বাড়লেও বাড়েনি উৎপাদিত পণ্যের দাম। এতে কারিগররা পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক হারিয়েছেন। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এ পেশার লোকজন। উপজেলার কায়েতপাড়া ও গুতিয়াব এলাকার ৩৫-৪০টি পরিবার জীবন ও জীবিকার তাগিদে খাড়ি তৈরি করে এ শিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন।
খাড়িগুলো ছোট-বড় বিভিন্ন মাপের হয়ে থাকে। একটি বাঁশ থেকে বড় মাপের ২টি ও ছোট মাপের ৩টি খাড়ি তৈরি করা যায়। একজন কারিগর প্রতিদিন ২টি বড় মাপের অথবা ৩টি ছোট মাপের খাড়ি তৈরি করতে পারেন। পাইকারি বাজারে ১টি ছোট মাপের খাড়ির দাম ২২০ টাকা। বাঁশ ও অন্য খরচসহ মোট ১২০ টাকা খরচ হয়। একটি বড় মাপের খাড়ির পাইকারি দাম ৪০০ টাকা। বাঁশ ও অন্য খরচসহ মোট ২৮০ টাকা খরচ হয়। খাড়ি তৈরি করে একজন শ্রমিক দিন শেষে পান মাত্র ৩০০ টাকা। বর্ষাকালে কাজ-কর্ম একদম থাকে না। তখন খাবার জোটানোই কঠিন হয়ে পড়ে।
বেশ কয়েকজন পাইকার খাড়িগুলো কিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করছেন। বিশেষ করে যেসব এলাকায় মাছের আড়ত রয়েছে, সেখানেই বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন সাইজের খাড়িগুলো বিভিন্ন দামে বিক্রি করে থাকেন। পাইকাররা আড়তে নিয়ে কিছুটা বেশি দামে বিক্রি করলেও কারিগররা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
আরও পড়ুন: চা বাগানের বাংলো যেন ফুলের স্বর্গরাজ্য
Advertisement
আগে যে বাঁশ ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় পাওয়া যেত। সেই বাঁশ বর্তমান বাজারে কিনতে হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। এর উপড়ে রয়েছে পরিবহন খরচ। পাশাপাশি বেড়েছে অন্য খরচ। পেশা সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ-বেত শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সহজ হবে।
নগড়পাড়ার জিয়সতলার কারিগর কার্তিক সরকার বলেন, ‘আমদের কয়েকটি পরিবার বাঁশ দিয়ে মাছের খাড়ি তৈরির কাজ করে সংসার চলত। কিন্তু পণ্য তৈরিতে খরচ বাড়ার সঙ্গে মূল্য না বাড়ায় বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে ও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।’
কারিগর বিমল সরকার বলেন, ‘উৎপাদন খরচ বেড়েছে কিন্তু পণ্যের মূল্য বাড়েনি। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল না পাওয়া ও মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে অন্য খরচ। সে অনুপাতে বাড়েনি আমাদের তৈরি পণ্যের মূল্য। সারাদিন পরিশ্রম করেও ৩০০ টাকার কাজ করতেই কষ্ট হয়ে যায়। অর্থাভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে কারিগররা।’
আরও পড়ুন: সুপারির খোলে নান্দনিক তৈজসপত্র
বাঁশ-বেত শিল্পের কারিগর শংকর রায় বলেন, ‘এ পেশার আনুমানিক বয়স প্রায় ২০০ বছর। এক দশক আগেও নগড়পাড়া, জিয়সতলা, নাওড়া, বাগবেরসহ উপজেলার বেশকিছু এলাকায় প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০টি পরিবার এ শিল্পের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। অনেকে এ পেশায় দীর্ঘদিন যুক্ত থাকলেও কালক্রমে তা মাত্র ৩৫-৪০ পরিবারে এসে ঠেকেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে টিকতে না পেরে এরই মধ্যে অনেকেই পেশা বদলেছেন।’
উপজেলা চেয়ারম্যান শাহজাহান ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘এক সময় বাঁশ-বেত শিল্পের পণ্যের বেশ চাহিদা ছিল। সময়ের বিবর্তনে প্রতিযোগিতা বাজারে টিকতে না পেরে শিল্পটি হারিয়ে যেতে বসেছে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে কারিগরদের জন্য সহায়ক হতো। ঋণ সহায়তার মাধ্যমে এ শিল্পের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাতেহা নূর জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাঁশ ও বেত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া প্রয়োজন। আর্থিক সহযোগিতা এ পেশা টিকিয়ে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। গ্রামীণ অর্থনীতির চালিকাশক্তি ক্ষুদ্র কুটির শিল্প রক্ষার্থে উপজেলা কৃষি অফিস কাজ করছে।’
এসইউ/এএসএম