অর্থনীতি

‘ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানো শিখছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে’

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রথম উপাচার্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, সাধারণ মানুষের জীবনযাপন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

Advertisement

জাগো নিউজ: নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়ানো নিয়ে সিন্ডিকেটের কথা পুরোনো। রমজান উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা যেন আরও বেপরোয়া। এটি পরম্পরায় হয়ে আসছে। তাহলে কি ব্যবসার নীতি-নৈতিকতা মানুষ ভুলতে বসেছে?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: ঠিক বলেছেন। আমরা তো দায় ভুলে গেছি। ব্যবসা, সেবা আর নৈতিকতা যে একই সূত্রে গাঁথা, তা আর বলার জো নাই। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালেও সরকারপ্রধান ছিলেন। রমজানে কোনো জিনিসের দাম বাড়েনি তখন। মূল্যস্ফীতি ছিল ১ দশমিক ৭ শতাংশ। আমি তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। সব রেকর্ড আছে। আজকের পরিস্থিতি একদিনে হয়নি। বিভিন্ন পক্ষ এখানে জড়িত।

Advertisement

জাগো নিউজ: যেমন?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: মানুষের সেবা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের মধ্যে তদারকি সেল বা টিম আছে। তারা রাষ্ট্রের নিযুক্ত। মানুষের কল্যাণে তাদের কাজ করার কথা। অথচ আমি মনে করি দায়ের প্রশ্নে তাদের শৈথল্য বা উদাসীনতা আছে।

এ কারণেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করেন, এই রাষ্ট্রে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। কৃষক পায় ২০ টাকা আর ভোক্তা কেনে ৮০ টাকায়। বাকি ৬০ টাকা কাদের পকেটে যায়? এর হিসাব তো রাষ্ট্রের কাছে থাকার কথা।

আরও পড়ুন>> ‘সাধারণ মানুষ অনিশ্চিত জীবনমান নিয়ে বেঁচে আছে’

Advertisement

কষ্টে বুক ফেটে যায়। ব্রয়লার মুরগির দাম হঠাৎ করে ১শ টাকা বাড়ানো হলো। সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০ টাকা কমালো এবং ঢাক-ঢোল পিটিয়ে বাহবা নিচ্ছে। এই বাহবাই ৮০ টাকা বৈধ করে দিলো ব্যবসায়ীদের জন্য। চিন্তা করা যায়! এক কেজি মাংসে ৮০ টাকা বাড়িয়ে দিলো মাত্র কয়েক দিনে! কোনো বিবেক কাজ করে না। ঠিকমতো মনিটরিং করলে তো এমন হওয়ার কথা নয়।

জাগো নিউজ: এক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: যারা মনিটরিং করেন, তারা তো এখানে লোক দেখানো দায়িত্ব পালন করেন। টেলিভিশন, ক্যামেরা, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মাঠে যাচ্ছে। মাঠ থেকে চলে এলে আগের অবস্থা বহাল থাকে। মনিটরিং করা তো নিয়মিত কাজ। টেলিভিশন, মিডিয়াকে নিয়ে এসব করতে হবে কেন? ক্যামেরা বন্ধ করে এসব করতে হবে।

জাগো নিউজ: রোজার মাসে ধর্মীয় আবেগ কাজ করার কথা। অনেক ব্যবসায়ী এ মাসে ওমরা করতেও যান। আবার ব্যবসায়ীরাই অন্যায্য মূল্য বাড়াচ্ছেন রমজান উপলক্ষে। সমাজ যাচ্ছে কোথায়?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: নৈতিকতা থেকে বিচ্যুতি ঘটলে আসলে কোনো মূল্যবোধ আর কাজ করে না। ধর্মীয় মূল্যবোধও না। মুসলিম প্রধান অনেক দেশেই রোজা উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা ছাড় দেন। বাংলাদেশে তার উল্টো।

ব্যবসায়ীরা কথা রাখবেন না বলে সরকারের মন্ত্রীরাও হতাশা প্রকাশ করেন। তাহলে সাধারণ মানুষ আর কী করতে পারে! ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে বারবার আমদানি শুল্ক কমানো হয়। অথচ দাম বেড়ে গেলে তা আর কমানো হয় না।

আরও পড়ুন>> জিনিসপত্রের দাম বাড়েনি: বাণিজ্যমন্ত্রী

ব্যবসার অপর নাম সেবা। এদেশে শতকরা ৯৪ শতাংশ মানুষ মুসলমান। ইসলাম ধর্মে খুব শক্ত করে বলা আছে ওজনে কম দেওয়া যাবে না, খাদ্যে ভেজাল দেওয়া যাবে না, অতিরিক্ত দাম নেওয়া যাবে না। আমরা কী দেখতে পাচ্ছি!

মুক্তবাজার অর্থনীতি নিয়ে আমরা বড়াই করি। অথচ মনোপলি প্রফিট নিয়েই সবাই ব্যস্ত। কোনো দায় নেই। কেউ কেউ দায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেন বটে। মানুষের সেবাকেও গুরুত্ব দেন। কিন্তু পরে আর অসুস্থ প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না। ধর্মের নীতিকথা মানলে এই দশা হওয়ার কথা না।

জাগো নিউজ: এর জন্য বিশেষত কোন বিষয়কে দায়ী করবেন? মানুষকে পুঁজির পেছনে এভাবে ছুটতে হলো কেন?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: দ্রব্যমূল্যের জন্য রাষ্ট্রকেই প্রধানত দায়ী করবো। গত দুই মাসে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে। ৭০ ডলারে নেমে এসেছে ব্যারেলপ্রতি। দুই মাস আগে ১৪০ ডলারে উঠেছিল। সব জিনিসের দাম বাড়ালো।

সরকার অর্ধশত টাকা বাড়ালো লিটারপ্রতি। আবার কমালো পাঁচ টাকা। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানো শিখছে রাষ্ট্রের কাছ থেকে। ব্রয়লার মুরগির দাম ১শ টাকা বাড়িয়ে ২০ টাকা কমালো। সরকারের জ্বালানি নীতি ব্যবসায়ীরা অনুসরণ করছেন। ভর্তুকি সরকার কমাবে এটি সময়ের দাবি। কিন্তু কখন কমাবে, কখন বাড়াবে তা তো সরকারের নীতির মধ্যে পড়ে।

আরও পড়ুন>> রমজান ঘিরে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য, দিশেহারা মানুষ

সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অপরাধ জেনেও মাফ পেয়ে যাচ্ছে। শাস্তি দেওয়া হয় না। ব্যবস্থা গ্রহণ করুন, মনিটরিং করুন। ব্যবস্থা না নিলে চাকরিচ্যুত করুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।

বছরে ৮শ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে বলে প্রকাশ পেয়েছে। এরপরেও সাধারণ মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে অর্থনীতি, উন্নয়ন আগলে রেখেছে। সামাজিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। আর নৈতিকতা কমছে। সবলরা দুর্বলকে ঠকানোর জন্য উঠে-পড়ে লাগছে। সাধারণ মানুষ দেখছে শুধু। এই ঠকে যাওয়া রোধ করার কোনো প্রতিবিধান নেই। এই প্রতিবিধানের জন্য মানুষকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আশা করি মানুষ ঘুরে দাঁড়াবে একদিন। দুষ্টুদের দমন করা সম্ভব এবং রাষ্ট্র এটির দায় নিয়ে সহজেই করতে পারে।

এএসএস/এএসএ/জেআইএম