স্বামীকে হারিয়েছেন ১৬ বছর আগে। অনেক কষ্ট করে মা সন্তানদের মানুষ করেছেন। সাত সন্তানের মধ্যে সবার ছোট রুহুল আমিন রনি (৩৫)।
Advertisement
মাদারীপুরে থাকা অবস্থায় অটোরিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ জোগাতেন। প্রায় সাত মাস আগে ধারদেনা করে জীবিকার সন্ধানে পাড়ি জমান সৌদি আরব। সেখানে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। একটু একটু করে দেনা পরিশোধ করছিলেন। এরইমধ্যে ঘটে যায় দুর্ঘটনা।
ওমরাহ করতে যাওয়ার সময় সৌদি আরবের দক্ষিণাঞ্চলের আসির প্রদেশের আকাবা শার এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান রনি। তিনি সদর উপজেলার কুনিয়া ইউনিয়নের দিয়াপাড়া গ্রামের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত এসহাক মাতুব্বরের ছেলে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসহাক মাতুব্বর পরিবার নিয়ে খুলনায় থাকতেন। সেখানেই প্রায় ১৬ বছর আগে মারা যান। এরপর সাত বছর আগে মাদারীপুরের নিজ বাড়িতে সাত সন্তান নিয়ে চলে আসেন এসহাকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম। অনেক কষ্ট করে চার ছেলে ও তিন মেয়েকে বড় করেছেন। তার এক মেয়ে তালাকপ্রাপ্ত হওয়ায় চলে আসেন মায়ের সংসারে।
Advertisement
ছোট্ট একটি দোচালা ঘর ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। অভাবের সংসারে কিছুটা খরচ জোগাড়ের জন্য রনি অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। এরপর বিয়ে করেন। সংসারে এক ছেলে আসফির মাতুব্বর (৫) ও মেয়ে আসফিয়া (৩) বড় হতে থাকলে খরচ বেড়ে যায়। কোনো উপায় না পেয়ে ধারদেনা করে জীবিকার সন্ধানে সাত মাস আগে সৌদি আরব যান রনি। এতে করে সংসারের কিছুটা সচ্ছলতা আসতে শুরু করে। কিন্তু সেই সুখ বেশিদিন সইলো না, হারাতে হলো রনিকে।
এ ঘটনার খবর পাওয়ার পর থেকেই রনির বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। বৃদ্ধা মাকে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দিতে পারছেন না আত্মীয়-স্বজনসহ পাড়া প্রতিবেশী। মা কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান হারাচ্ছেন। স্ত্রী আসমা বেগমেরও একই অবস্থা। ছোট মেয়ে তেমন কিছু না বুঝলেও ছেলে বাবা বাবা বলে কান্না করছে। খবর পেয়ে আশপাশের লোকজনও ছুটে আসছেন রনি বাড়িতে।
রাবেয়া বেগম বলেন, ১৬ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছি। এরপর অনেক কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছি। রনি অনেক ধারদেনা করে সৌদি আরব গেছে। সৌদি আরব থেকে ফোন করে পরিচিত কয়েকজন জানিয়েছে গাড়িতে আগুন লেগে পুড়ে রনি মারা গেছে। তার লাশও নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে আমার ছেলের লাশও কি দেখতে পাবো না? এত টাকা ধারদেনা করেছে, সেগুলো কীভাবে শোধ করবো? আমরা সরকারের সহযোগিতা চাই।
রনির শাশুড়ি রাশিদা বেগম বলেন, আমার জামাই অনেক ধারদেনা করে বিদেশ গেছে। এখন আমরা কী করবো? আমার মেয়ে এই ছোট ছোট দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবে?
Advertisement
তিনি আরও বলেন, শুনেছি ওই গাড়িতে আগুন লেগেছে। তাই হয়তো তার দেহ আগুনে পুড়ে গেছে। হয়তো তাই মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে না।
রনির স্ত্রী আসমা বেগম বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেলো। আমার দুই সন্তান নিয়ে আমি একেবারে পথে বসে গেলাম। তাছাড়া এই ধার করা প্রায় চার লাখ টাকা আছে। তা কীভাবে শোধ করবো? আমি সরকারের সহযোগিতা চাই। যাতে করে আমরা দেনা শোধ করতে পারি। আর এই ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে একটু খেয়ে-পরে বাঁচতে পারি।
তিনি বলেন, বাসে আগুন লেগে আমার স্বামী মারা গেছে বলে শুনেছি। কিন্তু তার মরদেহ নাকি পাওয়া যায়নি। যদি সে বেঁচে থাকে, তাহলে যেন তার ভালোভাবে চিকিৎসা হয়। আর মারা গেলে যেন মরদেহ বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়, এই দাবি সরকারের কাছে জানাই।
রনির চাচাতো ভাই মিঠু মাতুব্বর বলেন, বুধবার আমরা রনির মৃত্যুর খবর পেয়েছি। জসিম নামে আমাদের এক আত্মীয় সৌদি আরবে রনির সঙ্গে থাকতেন। জসিমই রাতে ফোন করে আমাদের জানিয়েছেন রনি ওই গাড়িতে ছিলেন। দুর্ঘটনায় রনি মারা গেছেন। তবে তার মরদেহ পাওয়া যায়নি।
কুনিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. হুমায়ন বলেন, ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। রনি অনেক ধারদেনা করে সৌদি আরব গেছেন। তাই পরিবারটি রনিকে হারিয়ে খুবই অসহায় হয়ে পড়েছে। তাই যদি সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতার ব্যবস্থা করা যায়। তাহলে হয়তো পরিবারটির একটু উপকার হতো।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাইনউদ্দিন বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে রনির পরিবারের জন্য যতটুকু সহযোগিতা করা সম্ভব, তা করা হবে। ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/এমআরআর/এমএস