মতামত

‘রুচির দুর্ভিক্ষ’কে আমন্ত্রণ জানালো কারা?

জ্ঞান দিতে পয়সা লাগে না। লাগলে হয়তো আমরা কিছুটা হিসাবি হতাম। বাংলাদেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোটামুটি জনসংখ্যার কাছাকাছি। আর তাই তো ফ্রিতে জ্ঞান দিতে কার্পণ্য করি না আমরা। যে কোনো বিষয়ে কথা বলার আগে ভাবি না যে এ বিষয়টাতে কথা বলার মতো যোগ্যতা বা সেই শিক্ষাটা আমার আছে কি না।

Advertisement

এই যে অবাধে মত প্রকাশের মাধ্যম এটাই আজ সমাজ থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রভাব ফেলছে। এখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলতে চাইনি। ভুল বোঝার অবকাশ নেই। বলতে চেয়েছি মত প্রকাশের আগে যে ‘ভাবনাবোধ’ যে ‘ঔচিত্যবোধ’ কাজ করা উচিত বা কোনো বিষয়ে কথা বলার আগে যে ‘যোগ্যতা’ অর্জন করা উচিত সেটির অভাবের কথা।

জনাব মামুনুর রশীদের একটি উক্তিকে কেন্দ্র করে গত কয়দিন চলছে তুমুল কাটাছেঁড়া। অথচ তিনি কিন্তু কেবল একটি ইস্যুতে কথা বলেননি। সামগ্রিক একটি ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা বলতে গিয়েই প্রসঙ্গটি টেনেছিলেন। হ্যাঁ, অনেকেই বলতে পারেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে হিরু আলমকে আক্রমণ করতে পারেন কি না?

কিন্তু এই প্রশ্নটি করার আগেও কিন্তু আমরা ভাবছি না যে তিনি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবেই কথাটি বলেছেন। আগে পরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বাদ দিয়ে বিষয়টাকে নিয়ে গেলাম ব্যক্তি বনাম ব্যক্তিতে। মামুনুর রশীদের ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কথাটাকে অত্যন্ত ক্ষীণ করে ফেললাম আমরা। অথচ এই বিষয়ে আমরা নিত্য আলোচনা করি। সমাজটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সমাজে এখন ভালো কিছু আর হচ্ছে না। কোনো অনুকরণীয় চরিত্র নেই আমাদের সামনে। এই যে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা কথা বলছি এগুলো থেকে রুচির দুর্ভিক্ষ কথাটা কি আলাদা?

Advertisement

এটা তো অস্বীকারের কোনো উপায় নেই যে সমাজে এখন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ডিজিটাল মিডিয়ায়ই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সাংস্কৃতিক জগতের মানুষেরাও দেখি আজকাল টিকটক, শর্ট ভিডিও করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইছে। আমাদের পহেলা বৈশাখ আজ সংকুচিত।

আমাদের মঞ্চ সংকুচিত। আমাদের সিনেমার পর্দাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এজন্য দায় কার? জনাব মামুনুর রশীদের কথাটাকে অনেকভাবেই সমালোচনায় আনা যেত। এই জায়গাটিকে ধরেই কিন্তু আমরা বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবনমনের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা তুলতে পারতাম।

সমাজে হিরু আলমের যে উত্থান সেখানে হিরু আলম ব্যক্তি হিসেবে কতটা দায়ী আর রাষ্ট্র কতটা দায়ী সেই আলোচনাটিও সামনে আসা উচিত। ডিশ আলম থেকে হিরু আলমের উত্থানকে আমি বিশ্লেষণ করতে চাই বাঙালি সংস্কৃতির পতনের গতিপথের উদাহরণ হিসেবে।

ব্যক্তি বিষয় নয়। বিজ্ঞান বলে, কোনো কিছুই শূন্য থাকে না। সব অভাবেরই কোনো না কোনো রাস্তায় পূর্ণতা আসে। আজকাল আমরা বড্ড হালকা হতে চাই। রুচির পরিবর্তন কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক আর রুচির পরিবর্তন তো অবৈজ্ঞানিক কিছু নয়।

Advertisement

রুচি গড়ে ওঠে একজন ব্যক্তির পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা ও বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার ওপর। সেখানে হিরু আলমের ইতিহাস বাঙালি সংস্কৃতির উচ্চাসনে আসার মতো নয়। দরিদ্র ঘরের সন্তান হিসেবে তার টার্গেট ছিল কত অল্প সময়ে বিখ্যাত হওয়া যায় বা শর্ট কাট উপায়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উপায়।

বুদ্ধিমান মানুষ সে। সহজেই পেয়ে গেছে। কিন্তু এই যে হিরু আলমের গ্রহণযোগ্যতা এজন্য দায়ী কারা? যুগে যুগেই কিন্তু বিকৃত চর্চাকারীরা ছিল কিন্তু তাকে গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়টা নির্ভর করে গ্রাহকের রুচি ও সংস্কৃতির ওপর। আলোচনাটা হওয়া উচিত এই রাস্তায়।

আমাদের সমাজে ভালোমানের সাংস্কৃতিক চর্চা কি আছে আদৌ? মামুনুর রশীদের মতো শিক্ষিত সাংস্কৃতিক কর্মী/নেতাদের দায় কি এখানে একদমই নেই? রাষ্ট্রের সব শাখার মতো সাংস্কৃতিক শাখাটিও যে দুর্নীতিতে মজে গেছে সেটি কি আমরা অস্বীকার করতে পারবো? সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যারা হর্তাকর্তা তারা কে কবে কোন জায়গায় কতটা ভূমিকা রাখতে পেরেছেন?

সরকারের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ে বা সংস্কৃতি বিষয়ক নানা ধরনের কমিটিগুলোতে তো আমাদের সমাজের যারা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আছেন তারা যুক্ত ছিলেন। কেন তারা হিরু আলমের উত্থানকে আটকাতে পারলেন না? এটি কি নিছকই সুযোগের অভাব নাকি ব্যক্তিগত লোভ লালসা থেকে কেউই বের হতে পারেননি?

নাগরিকের রুচি গড়ে তোলার পিছনে রাষ্ট্রের যে ভূমিকা সেটি কি রাখতে পেরেছে? একে একে ভালো মানুষগুলো পিছিয়ে গেছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনটা দখলে নিয়ে নিলো একদল দুর্বৃত্ত বা পকেটের সংস্কৃতি কর্মীরা। মামুনুর রশীদের হয়তো সেগুলো নিয়ে খোলামেলা কথা বলা দরকার ছিল।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিতর্কিত করা হয়েছে নানাভাবে। মানুষের মগজে এখন না আছে ধর্ম না আছে সংস্কৃতি। এক বাউন্ডুলে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে সাধারণ মানুষগুলো। কোনো দিকনির্দেশনা নেই, কোনো রোড ম্যাপ নেই সামনে।

শিল্পকলা একাডেমির কর্মকর্তারা কি কাজ করছেন? একাডেমির ডিজি একজন পরিচিত সংস্কৃতি কর্মী অথচ তার বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আসে। শিল্পকলায় অনুষ্ঠান করার অনুমতির ক্ষেত্রেও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। অথচ এ নিয়ে কারও কোনো উচ্চবাচ্য নেই।

আসলে আমাদের কথা বলতে হবে গোড়ায় গিয়ে। কার্যকারণ অনুসন্ধান না করে কেবল উপসর্গ নিয়ে কাইজ্জা করলে ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু হবে না। মামুনুর রশীদের মতো ব্যক্তিদেরও জায়গা মতো কথা বলার সাহস রাখতে হবে। হিরু আলম তো কেবল উপসর্গের একটা। আসল সমস্যা তো আমাদের ব্যবস্থাপনায়। সেই দায়িত্ব অস্বীকার করবো কেন?

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম