‘আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার!আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!আমি মানি না কো কোন আইন,আমি ভরা তরী করি ভরাডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!’যারা নজরুলের এই কথাগুলো পড়েছিলেন, তাদের জন্য সুখবর হলো সমাজ ও মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে আইন না মানার যে প্রত্যয় তিনি ব্যক্ত করেছেন, সেটি কালের বিবর্তনে শুধু সমাজের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; তা প্রসারিত হয়েছে সমাজ থেকে বিজ্ঞানে, বিজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানের গবেষণায়। বিজ্ঞানের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির সনাতনী ধারার ওপর একটি বিরাট জিজ্ঞাসার চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন বিশ শতকের অনেকেই। কার্ল পপার থেকে শুরু করে ল্যাকাটস পর্যন্ত এমনকি টমাস কুন, ম্যাক্স স্টাইরনার, মিসেল ফুঁকো—সবাই সায়েন্টিফিক রিলেটিভিজমের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এর ফলে বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে যে সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক কাঠামোবাদ গড়ে উঠেছে তার ভিত গেছে নড়বড়ে হয়ে। সাহিত্য কিংবা শিল্পাঙ্গনও এর থেকে দূরে নয়। উত্তর-আধুনিক দর্শনচিন্তা বলতে গেলে এ ধরনের আপেক্ষিক বোধের পেটের ভেতর বেড়ে উঠেছে। বিশ শতকের মধ্যপাদে বহুত্ববাদের রসে সিক্ত হওয়া সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা, নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস এই রিলেটিভিজমেরই সন্তান। অনেক সাহিত্য সমালোচক মনে করেন, বিশ শতকের শিল্প আন্দোলন দাদাবাদ (dadaism) শিল্পের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার লাইসেন্স দিয়েছে। অর্থাৎ শিল্পের ওপর থেকে তুলে নিয়েছে সব ধরনের খবরদারী। ঠিক সে রকম অস্ট্রীয়-ব্রিটিশ-মার্কিন দার্শনিক পল ফায়ারাবেন্ড (১৯২৪-১৯৯৪) বিজ্ঞানের দর্শনেও নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার সর্বোচ্চ ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘এনিথিং গোজ’ বা যা খুশি কর। এই ফাঁকে একটু বলি রাখি, দাদাবাদ হচ্ছে বিশ শতকের শুরুর দিকে ফরাসিতে একটা শিল্প আন্দোলন; যার মূল প্রত্যয় ছিল শিল্পের স্বাধীনতা। শিল্প যে কোনো রকম ফরমায়েশি বা ঘরোয়া বিষয় নয়, সেটি জানিয়ে দেওয়াই ছিল এ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য। পরে অবশ্য দাদাবাদ সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদের সঙ্গে মিলেমিশে শিল্পের এক বিশেষ ঘরানা তৈরি করেছে গেল শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে। অনেকে মনে করেন, উত্তর-আধুনিক ভাবনায় শিল্প আন্দোলনের এই যাত্রা একটি বিশেষ বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে শিল্পমহলে। আর এ কারণেই প্রভাব পড়েছে পরের সব চিন্তাঙ্গনে। সেখান থেকেই আধুনিকোত্তর পথে মানুষের মিছিল। বৈজ্ঞানিক গবেষণাও এর আঁচ থেকে দূরে থাকতে পারেনি।
Advertisement
বিশ শতকের শুরুর মুহূর্তে শত বছরের চিরায়ত ভাবনায় যে আগুন লাগে, তার দায়-দায়িত্ব গিয়ে পড়ে আইনস্টাইনের ওপর। কারণ তিনি ২৬ বছর বয়সে ১৯০৫ সালে স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটিতে দেখিয়ে দিলেন বস্তুর দৈর্ঘ, সময়, ভরকে আগের মতো ব্যাখ্যা করার কোন উপায় নেই। যার সাথে অবধারিতভাবে সংযুক্ত হয়েছে আলো তথা আলোর বেগ। এর ফলে ভেঙে পড়েছে ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের ইস্পাত-কঠিন দেওয়াল। নিউটনিয়ান গতিবিদ্যার ওপর মানুষের যে অসীম আস্থা গড়ে উঠেছিল তা রীতিমত সীমিত হয়ে গেছে আইনস্টাইনের হাতে। ১৯১৫ সালে এই তত্ত্বেরই অসম্পূর্ণতা নিয়ে আইনস্টাইন প্রকাশ করেছেন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ, যেখানে স্থান ও কালের নতুন ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। স্থান আর কালের মাঝে যে বিভাজন ছিল, তা উঠে গিয়ে হয়েছে স্থান-কাল। আর এর ফলে আমরা প্রবেশ করেছি চতুর্মাত্রিক নতুন এক বিশ্বে, যেখানে ‘কালের যাত্রার ধ্বনি’ পৌঁছেছে নিঃসীম শূন্যে। আপেক্ষিক বিশ্বমাত্রা আমাদের তাই নিয়ে গেছে ভাবনার এক নতুন দুয়ারে। এই নতুন দুয়ারের এক নতুন পথিক ফায়ারাবেন্ড। সায়েন্টিফিক আমেরিকানে জন হরগান লিখেছেন, “যতসব অদ্ভুত জিনিস ঘটে ততই ফায়ারাবেন্ড প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন”। হরগান আরও লিখেছেন, ফায়ারাবেন্ড তথাকথিত প্রগতির উগ্র সমালোচক হলেও আগের থেকে তাঁকে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে।
চিরায়ত সত্যের ডেরায় আঘাত হানা এই নতুন বিজ্ঞান একদিকে আপেক্ষিক তত্ত্ব অন্যদিকে কণাবাদী বলবিদ্যা। একদিকে বিরাট বিশ্ব যেমন বাহু মেলে আছে অন্যদিকে ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র মাতা বসুমতি। এই দুই ভুবনের একান্ত পাঠ মানুষের চোখ খুলে দিয়েছে। বিজ্ঞানের এতকাল ধরে বয়ে চলা সত্য যেন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে নতুন বিজ্ঞানের আশ্চর্য সব তত্ত্বে। অভিজ্ঞতার একান্ত কর্ষণে যে জ্ঞান পাওয়া গেছে তাতে চিরায়ত সত্য বলে কোনোকিছু মেনে নিতে মনটা আর সায় দেয় না। ১৯২০ এর দশকে এ ধরনের এক বৈজ্ঞানিক বোধ ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইউরোপে। ঠিক এমন এক পরিবেশে অস্ট্রিয়ার এক সাধারণ পরিবারে জন্ম হয়েছে পল ফায়ারাবেন্ডের। অনেকেই তাঁকে বলছেন এনার্কিস্ট, বহিমিয়ান, রিলেটিভিস্ট, স্কেপ্টিক, বিচ্ছিন্নতাবাদী, উদ্ভট ইত্যাদি। অনেকেই বলেছেন বিজ্ঞানের জন্য বিশেষ একজন কালপ্রিট! আবার তাঁকে গ্রহণও করেছেন অনেকে শঙ্কাহীন চিত্তে। তাঁর সত্তর বছরের জীবনে ঘটেছে নানা ঘটনা; এ নানা ঘটনাকে ছেঁকে তুলে একটা ভাষ্য রচনা করা বেশ আয়াস সাধ্য কাজ নয়। তবে তাঁকে একজন এপিস্টিমলজিক্যাল এনার্কিস্ট বললে তিনি নিজেও অখুশি হবেন না বলে নিশ্চিত করা যায়। আদতে তাঁর এনার্কিজমের আঁতুড় ঘর হচ্ছে এপিস্টিমলজিক্যাল ডিসকোর্স বা জ্ঞানবিদ্যক ডেরা।
ফায়ারাবেন্ডের জন্ম ভিয়েনার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯২৪ সালে। তার কিছু আগে মাত্র বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। যুদ্ধের গন্ধ তখনও চারিদিকে ছড়িয়ে, সবদিকে হাহাকার তখনও নেভেনি। দুর্ভিক্ষ, অনাহার, মুদ্রাস্ফীতি, মারামারি তখনও নিয়মিত ঘটনা। ঠিক এমন একটা পরিবেশে ওলফগ্যাংগেসের তিন রুমের একটা ফ্লাটে ফায়ারাবেন্ডের জন্ম। জগত বলতে ওইটুকুর মধ্যেই তাঁর বেড়ে ওঠা। কারণ তাঁর ভাষায়, “বাইরের দুনিয়াটা তখন ভয়ানক”। কদাচিৎ সে সময়ে তাঁকে বাইরের যেতে হয়েছে। বাইরের নিরাসক্ত পরিবেশ তাঁকে কিছুতেই আকৃষ্ট করতে পারেনি। ছ’বছর বয়েসে যখন স্কুলে যাওয়া শুরু হলো, তখন তাঁর কাছে ছিল পুরোটা অজানা, অচেনা এমনকি কীভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয় সেটাও তাঁর জানা ছিল না। ফায়ারাবেন্ড স্কুল ছেড়ে হাইস্কুলে গিয়ে বেশ কয়েকটি ভাষা শিখে নেনে। এর মধ্যে ল্যাটিন এবং ইংরেজি ছিল অন্যতম। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ভরজুগশুয়েলা (Vorzugsschüler) বা সেরা ছাত্র হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে ওঠেন। মজার ব্যাপার, মাত্র ষোলো বছর বয়সেই তিনি তাঁর শিক্ষকের চেয়ে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে বেশি পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তবে দর্শনের প্রতি তাঁর আগ্রহ নিছক দুর্ঘটনা থেকে। হাইস্কুলে পড়তে পড়তে বই সংগ্রহ করার প্রতি তাঁর প্রবল নেশা হয়ে দাঁড়ায়। সে সময়ে পুরোনো বইয়ের অকশান হতো, অল্প টাকায় কাড়ি কাড়ি বই পাওয়া যেতো, তার মধ্যে দর্শনের বইগুলো ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কিছু বই আবার পাওয়া যেতো ফ্রি। এর মধ্যে প্লেটো, দেকার্ত, লুডভিগ বুচনার প্রমুখের বই পড়তে পড়তে এক সময় হাইস্কুলে থাকতেই ফায়ারাবেন্ড দর্শনকে ভালোবেসে ফেলেন। একবার দেকার্তের মেডিটেশন পড়তে পড়তে তাঁর হঠাৎ মনে হয়েছে ‘আই থিঙ্ক দেয়ারফোর আই এক্সিস্ট’—এই কথাটা তাঁর মা আর তাঁর সম্পর্কের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়। তাই তাঁর মাকে গিয়ে একদিন বলেন, “তাঁর মা বেঁচে আছে কেবলমাত্র এজন্যই যে সে বেঁচে আছে এবং তাঁর মায়ের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকতো না যদি কি না সে না বেঁচে থাকতো (she existed only because I existed and that without me she did not have a chance)। কিশোর বয়সে এ ধরনের গভীর বিষয়ের প্যারডিক্যাল একপজিশন খুব দেখা যায়! আগেই বলেছি, ফায়ারাবেন্ড ছিলেন অতি জিনিয়াস।
Advertisement
পল ফায়ারাবেন্ড তরুণ বয়স থেকেই গণিত, ক্যালকুলাস, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যামিতি এবং দর্শনের গভীর তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকেন। তিনি নিজেই লিখছেন, “I was interested in both the technical and the more general aspects of physics and astronomy, but I drew no distinction between them. For me, Eddington, Mach (his Mechanics and Theory of Heat), and Hugo Dingier (Foundations of Geometry) were scientists who moved freely from one end of their subject to the other”. এর ফলে পদার্থবিজ্ঞান আর গণিতের চারিত্রিক প্রবণতা সম্পর্কে তাঁর বিস্তৃত ধারণা হয়ে ওঠে। তবে তিনি স্কুলজীবন থেকেই অপেরা, থিয়েটার, নাটক, কবিতা, সংগীতের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি জার্মান সেনাবাহিনীর সঙ্গে ট্রেনিং নেন। উল্লেখ্য, ১৯৩৮ সালে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া একীভূত হয়। যুদ্ধের মাঝেই তিনি জানতে পারেন তাঁর মা আত্মহনন করেন। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়; তখন রাশিয়ান আর্মির ছোড়া গুলি তাঁর হাতে এবং পেটে লাগে। ফলে তাঁর স্নায়ুতন্ত্র সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে সারাজীবনের জন্য সেক্সচুয়ালি ইম্পোটেন্ট হয়ে পড়েন। তাঁর বিষাদময় জীবনের বিস্তৃত গল্প লিখেছেন আত্মজীবনী ‘কিলিং টাইমে’।
আরও পড়ুন: এখানে কয়েকটি জীবন: গল্পজুড়ে জীবনের বিস্তার
যুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালে ‘কালচারাল অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ডেমোক্রেটিক রিফর্ম অব জার্মানি’তে ফায়ারাবেন্ড যোগ দেন। পরের বছর ভিয়েনায় ফিরে এসে ইতিহাস এবং সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনা শুরু করেন। তবে কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনি পদার্থবিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সে সময় তিনি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ওপর ‘এ র্যাভিং পজেটিভিস্ট’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। ১৯৪৮ সালে তিনি অস্ট্রিয়ার এলব্যাকে অস্ট্রিয়ান কলেজ সোসাইটির একটি সেমিনারে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ওখানেই তাঁর প্রথম দেখা হয় কার্ল পপারের সঙ্গে। পপার ছিলেন তাঁর থেকে বাইশ বছরের বড়। ভিয়েনা সার্কেলের অপমৃত্যুর পর সেখানকার একজন সক্রিয় সদস্য ভিক্টর ক্র্যাফটের নেতৃত্বে সে সময় ‘ক্র্যাফট সার্কেল’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি হয়। বিশেষ করে সেখানে সে সময় যারা ছাত্র ছিল, তাদের দিয়েই এ সার্কেল পরিচালিত হতো। অনেকেই এখানে বক্তৃতা করতে আসতেন। এঁদের মধ্যে ভিটগেন্সটাইন ছিলেন অন্যতম। ফায়ারাবেন্ড এ সার্কেলের অন্যতম একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন। এর বিশেষ কারণ হচ্ছে, ভিক্টর ক্র্যাফট ছিলেন ফায়ারাবেন্ডের অভিসন্দর্ভের তত্ত্বাবধায়ক। ১৯৫১-তে ‘বেসিক স্টেটমেন্টস’ নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ফায়ারাবেন্ড।
পল ১৯৫১ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলারশিপ নিয়ে ক্যামব্রিজে ভিটগেন্সটাইনের কাছে ভর্তি হন। কিন্তু ভিটগেন্সটাইনের অকাল মৃত্যুর পর এ দায়িত্ব গিয়ে পড়ে পপারের ওপর। ভিটগেন্সটাইনের অপার স্নেহ ছিল তাঁর ওপর। কিন্তু পরে তিনি পপারের টিচিং অ্যাসিস্টেন্ট হতে অস্বীকৃতি জানান। ১৯৫২ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে ভর্তি হয়ে ভিটগেন্সটাইনের ফিলসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশনের ওপর বিশেষভাবে পাঠ গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে ফায়ারাবেন্ড ফিরে আসেন ভিয়েনায়। কারণ তিনি পপারের কাছ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে গবেষণায় মনোনিবেশ করতে চান। পরে অবশ্য ভিয়েনায় আর্থার প্যাপের কাছে তিনি গবেষণা শুরু করেন। পরের বছর ভিয়েনা সার্কেলের আরেক সদস্য হারবাট ফেইগলের সঙ্গে পরিচিত হন। এ সময় তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ওপর প্রবন্ধ লেখেন। পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক ধারার ওপর তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল।
Advertisement
১৯৫৫ সালে ফায়ারাবেন্ড লন্ডনের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির লেকচারার পদে নিয়োগ পান। এ সময় ফিলোসফিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা ভিটগেন্সটাইনের ফিলোসফিক্যাল ইনভেস্টিগেশনের রিভিউ। ১৯৫৬ সালে তিনি কোয়ান্টাম ফিজিক্সের ওপর আরও কিছু প্রবন্ধ লেখেন। এর বছর দুয়ের মধ্যে তিনি দর্শনে এন্টি-পজিটিভিস্ট একটি বিশেষ ধারা তৈরি করে ফেলেন যার সুত্রপাত হয় পপারের হাত ধরে বিশেষ করে তাঁর ফলসিফিকেশনিস্ট থিওরির প্রভাবে। ১৯৫৯ সালে তিনি আমেরিকায় গিয়ে বার্কলিতে স্থায়ী হন। ৬০-এর দশকের শুরুতেই অভিজ্ঞতাবাদী দর্শনের মূল কৌশল যে রিডানশনিজম তার বিরুদ্ধে ভীষণ পরিমাণ অবস্থান নেন। ১৯৬৫-তে লেখেন ‘প্রব্লেম অব এম্পেরিসিজম’।
১৯৬৫ সালের পরে পাশ্চাত্য দর্শনে বহুত্ববাদী ধারার যে প্রচলন শুরু হয় বিশেষ করে কন্টিনেন্টাল দর্শনে, তার প্রভাব গিয়ে পড়ে ভাষাদর্শন তথা বিশ্লেষণী দর্শনেও। এমনকি বিজ্ঞানের দর্শনেও যে এর ছোঁয়া লাগে তার বিশেষ প্রমাণ ফায়ারাবেন্ড। অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন জ্ঞানের যে কাঠামোবাদ তৈরি করেছিল তার বিপুল সৌধের ভিত নড়বড়ে করে দেয় উত্তর পর্বের দার্শনিকেরা। ১৯৭০ সালে ফায়ারাবেন্ড লেখেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘এগেনস্ট মেথড’ যেখানে জ্ঞানের জগতে নিজেকে তিনি একজন এনার্কিস্ট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৭৪ সালে ফায়ারাবেন্ডের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইমায়ের লেকাটোসের মৃত্যু হয় যার সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা ছিল ফর এন্ড এগেন্সট মেথড নামে আরেকটি বই লিখবেন। ১৯৭৮ সালে লেখেন সাইন্স ইন ফ্রি সোসাইটি নামে অতি চমৎকার একটা বই। ইতোমধ্যে তিনি আরও বেশ কিছু বই রচনা করেন যার মধ্যে অন্যতম তাঁর আত্মজীবনী কিলিং টাইম। তবে তাঁর মৌলিক গ্রন্থের ভেতর সায়েন্স ইন ফ্রি সোসাইটি পাশ্চাত্য চিন্তায় ব্যাপক সাড়া ফেলে। ফায়ারাবেন্ড ১৯৮৯ সালে জুরিখে আসেন এবং অধ্যাপক পদে আসীন হন। এই সালেই তিনি গ্রাজিয়া বরিনিকে বিয়ে করেন। গ্রাজিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত আন্তরিক এবং রোমান্টিক। সে ছিল ফায়ারাবেন্ডের চতুর্থ স্ত্রী। ফায়ারাবেন্ড ১৯৯৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সুইজারল্যান্ডে মৃত্যুবরণ করেন। ভিয়েনায় পারিবারিক শ্মশানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
অভিজ্ঞতাবাদ, বহুত্ববাদ ও অনির্দেশ্যবাদ বিজ্ঞানের বসতঘরের দুই প্রধান খুঁটি হচ্ছে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণ। যা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণে ধরা যায় তাই গ্রহণীয়, অন্যথায় তা যতই জনপ্রিয় হোক না কেন গ্রহণ করার কোন কারণ নেই। এটাই বিজ্ঞানের চিরাচরিত নিয়ম। বিজ্ঞানের দার্শনিকদের একটা বিশেষ ঘরানা যাদের যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদী বলা হয়ে থাকে, তাদের মূল কথা অভিজ্ঞতার বাইরে কিছু নেই। জ্ঞানের একমাত্র উৎস অভিজ্ঞতা। মরিজ শ্লিকের নেতৃত্বে ১৯২০-এর দশকে ভিয়েনাকেন্দ্রিক একদল দার্শনিক বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, অর্থনীতিবিদ, যুক্তিবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ একটা ক্লাবের মতো গড়ে তোলেন। ক্লাবটার নাম দেওয়া হয় ভিয়েনা সার্কেল। মরিজ শ্লিক ছিলেন আইনস্টাইনের অতি ঘনিষ্ঠ একজন ব্যক্তি যিনি পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন। অধিবিদ্যা বা যে কোনো তত্ত্ববিদ্যক বিষয় জ্ঞানের অংশ হতে পারে না বলে তাঁর অবস্থান ছিল। তাদের ধারণা হলো, অধিবিদ্যার সব ভাষা অত্যন্ত অস্পষ্ট, তথ্যবিহীন যারপরনাই অর্থহীন। তিনি বার বার উচ্চারণ করেছেন, ‘বাক্যের অর্থ নির্ভর করে তার পরোখযোগ্যতার ওপর’। যে বাক্যকে পরোখ করা যায় তা সে সত্যি হোক মিথ্যাই হোক অর্থপূর্ণ। আর অধিবিদ্যার ভাষা কোনোভাবেই পরোখ করার উপায় নেই। সে জন্য এগুলো অর্থহীনতার পর্যায়ে পড়ে। পুরো ২০-এর দশক তো বটেই ত্রিশ এমনকি ৪০ এর দশকের কিছু সময় এই দর্শনের প্রভাব হয়ে ওঠে সাংঘাতিক। রুডলপ কার্নপ, ফিলিপ ফ্রাঙ্ক, ভিক্টর ক্র্যাফট, হ্যান্স হ্যান, অটো নিউরথ, এ যে এয়ারসহ অনেকেই এই দার্শনিক আন্দোলনের সঙ্গে নীতিগতভাবে একমত হন। তাঁদের প্রত্যেকেরই একটা কমন উদ্দেশ্য ছিল, দর্শন থেকে অধিবিদ্যাকে সরিয়ে ফেলা। কিন্তু এ কাজে প্রথম সমস্যা দেখা দিলো, কীভাবে আমরা দর্শন থেকে অধিবিদ্যাকে আলাদা করব? এর খুব একটা সহজ উপায় বের করতে যৌক্তিক অভিজ্ঞতাবাদীরা হিমশিম খেয়ে গেল। আসলে যাকে আমরা অধিবিদ্যা বলছি, সেটা যদিও সর্বাংশে অপরীক্ষিত তারপরেও জ্ঞানের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে এটা যে একেবারে মূল্যহীন সেটা দাবি করা চলে না। বিজ্ঞানের কত কিছুই তো পরীক্ষণের আওতার বাইরে। বিশেষ করে যেসব বাক্য ‘সাধারণ’ তাদের নিয়ে সমস্যাটা হলো বেশি। যেমন ‘সব পাখি দ্বিপদী’, ‘সব কোকিল কালো’, ‘সকল রাজহাঁস সাদা’ ইত্যাদি। এসব বাক্য অর্থাৎ সব বা সকল দিয়ে যেগুলো শুরু তাদের চূড়ান্ত পরীক্ষণের ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে বড্ড ঝামেলা! কারণ সকল পাখি, সকল কোকিল, সকল রাজহাঁস ইত্যাদি পরীক্ষা করার কোনো উপায় নেই। চূড়ান্ত অপরীক্ষিত থাকার পরেও এসব বাক্যের স্টাটাস কিন্তু অর্থহীন নয়। তাহলে অধিবিদ্যার দোষ কী?
আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব
এ ধরনের এক জটিল সমস্যা নিয়ে পরবর্তীতে অনেকেই কাজ করেছেন। তবে কার্ল পপার এর বিপরীতে একটা সমাধান দিতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞানের কোনো বিষয়কেই চূড়ান্তভাবে পরোখ করা সম্ভব নয়, বরং খণ্ডন করা সম্ভব। কারণ বিজ্ঞান আমাদের চূড়ান্ত কোনো জ্ঞান দিতে পারে না। যা পারে সেটা সাময়িক সমস্যার সমাধান। এ জন্য বিজ্ঞানের সব প্রত্যয়ই এড-হক ব্যাসিসে ধরে নিতে হবে। তা ছাড়া বিজ্ঞান আর অধিবিদ্যার মাঝে যে তথাকথিত দেওয়াল আছে সেটা বলা যায় ঠুনকো। বিশেষ কোনো বিভাজন রেখা তৈরি করা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানের দার্শনিক আলোচনায় তাঁর দেওয়া মিথ্যায়ন নীতি বিজ্ঞানের দর্শনে বেশ গাল ভরা একটা টার্ম। পপারের দর্শনতত্ত্বকে বলা হয় ক্রিটিক্যাল রেশনালিজম বা বিচারমূলক বুদ্ধিবাদ। এই বিচারমূলক বুদ্ধিবাদ তাঁর সব দর্শনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যেটা মূলত জ্ঞানের ক্ষেত্রে ট্রাইল অ্যান্ড এররের হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া। ইতিহাস, সমাজ, এমনকি মনোবৈজ্ঞানিক ধারার প্রতিটা ক্ষেত্রেই পপার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিতে অস্বীকার করেছেন। এই পপারেরই ছাত্র ছিলেন ফায়ারাবেন্ড। তবে ফায়ারাবেন্ড একটা ভিন্নপথে এগোতে চেয়েছেন। সেটা দেখব এখন।
ফায়ারাবেন্ডের এক হাংগেরিয়ান বন্ধু ছিল ইম্যার ল্যাকাটস নামে; দুবছরের বড়। ল্যাকাটসও ছিলেন খুব নামকরা দার্শনিক। একদিন এক পার্টিতে ল্যাকাটস বলেন, ‘পল, তুমি তোমার এসব উদ্ভট আর উল্টোপাল্টা আইডিয়াগুলো লিখে রাখছো না কেন?’ দুবছরের মাথায় ফায়ারাবেন্ড সেই সব ‘উদ্ভট’ বিষয়গুলো লিখে বই আকারে পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনে প্রকাশকের কাছে। কিন্তু আশ্চর্য, কী এক রহস্যজনক কারণে সেই পাণ্ডুলিপি গায়েব হয়ে যায়। তখন ল্যাকাটস বন্ধুর এহেন দুর্দৈবের কারণে আশ্রয় নিলেন ইন্টারপোলের। ইন্টারপোল সেটা উদ্ধার করে ফায়ারাবেন্ডের কাছে ফেরত পাঠাল কিছুদিনের মধ্যে। এটা ফেরত পেয়ে ফায়ারাবেন্ড আরও কিছু পরিবর্তন-পরিমার্জন করে প্রকাশ করলেন এগেনেস্ট মেথড। ইতোমধ্যে ল্যাকাটসের মৃত্যু হয় ১৯৭৪ সালে। আসলে ফায়ারাবেন্ড যা লিখেছেন এই বইতে, সেটা একটু বিক্ষিপ্ত আকারে। কোনো ধারাবাহিক অভিসন্দর্ভ আকারে নয়। এসব পড়ে ল্যাকাটস প্রায়ই তাঁকে রসিকতা করে বলতেন, বিচ্ছিন্নতাবাদী। ফায়ারাবেন্ড লিখছেন, এই উপাধি নিয়ে আমার কোনো আপত্তি ছিল না।
বিজ্ঞানের অভিজ্ঞতাবাদী ধারার বিপরীতে ফায়ারাবেন্ড অবস্থান নিয়েছেন। তিনি লিখছেন, ‘বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানী মাখ, বোল্টজম্যান, আইনস্টাইন, বোর—এঁদের বিপরীত ছিল আমার মত।’ তাঁদের মত কী ছিল? তাঁদের মত ছিল, অভিজ্ঞতার বাইরে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান অসম্ভব। কিন্তু ফায়ারাবেন্ড লিখলেন, ‘বিজ্ঞান আদতে আবশ্যিক ভাবে একটা নৈরাজ্যকর পদক্ষেপ, তাত্ত্বিক নৈরাজ্যবাদ অধিক মানবতাবাদী প্রচেষ্টা এবং এটা প্রগতির সহায়ক যা কি না বৈজ্ঞানিক ধরাবাঁধা নিয়মের তোয়াক্কাহীন’। বিজ্ঞান কেন নৈরাজ্যকর পদক্ষেপের অংশ তা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না, ফায়ারাবেন্ডের গভীর বিশ্বাস ছিল এটা। তিনি মনে করতেন, বিজ্ঞানের ইতিহাস হচ্ছে দুর্ঘটনা, কল্পনা, আর স্বপ্নালু প্রকল্পে ভরা। এটা আমাদের কাছে হাজির হয়েছে জটিল মানবিক পরিবর্তনের মাঝ দিয়ে যা কি না মানুষের দূরকল্পনা ও অনির্দেশ্য ভাবনার চূড়ান্ত ফলাফল। বিজ্ঞান শুধু কোনো বৈজ্ঞানিকের সরল রৈখিক চিন্তার প্রকাশ নয় বরং ঘটনা সম্পর্কে তাঁর ধারণা, ব্যাখ্যা, ভুল উদ্ঘাটন ও প্রস্তাবিত ধারণার সাথে ঘটনার সাযুজ্য নির্ণয়ের এক আনুধ্যানিক প্রচেষ্টার সমন্বিত ফলাফল। সুতরাং বিজ্ঞান কোনো অবিমিশ্র ঘটনা নয় বরং বহু ঘটনার মিশ্রিত ও জটিল প্রপঞ্চের এক অবিশুদ্ধ রূপ। বিজ্ঞানের বৈশিষ্টই হলো পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের ঐতিহাসিক দলিল যার ভেতর আছে বিরোধিতা, আছে ঘটনার অসংবৃততা, আছে ভুল আর বৈপরীত্য।
বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে কিছু অনমনীয়, দৃঢ় এবং সুষম কাঠামোর ওপর ভর করে। যা এগিয়ে যায় এক ধরনের সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক গবেষণার ভেতর দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিজ্ঞানের কোনো একক, নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয় কাঠামো বলে কিছু নেই। ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে ফায়ারাবেন্ড নিশ্চিত যে, বিজ্ঞানের পদ্ধতিগত লঙ্ঘন কোনো দৈবাৎ ঘটনা নয়। তিনি মনে করেন, প্রাচীনকালে পরমাণু সম্পর্কে দার্শনিকদের ধারণা, কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক ধারণা, আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিস্কার যেমন- গতিবিদ্যা, আলোর বিচ্ছুরণ তত্ত্ব, কণাবাদী তত্ত্ব ইত্যাদি, আলোর ওয়েভ থিওরি—এসব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কোনো বিশেষ বৈজ্ঞানিক ফর্মুলার ভেতর গড়ে ওঠেনি। বিজ্ঞানের পদ্ধতি হবে উন্মুক্ত, সীমাহীন এবং যাচ্ছে-তাই করার সনদ। বিজ্ঞানের জন্য যাচ্ছে-তাইকে ফায়ারাবেন্ড ‘এনিথিং গোজ’ নামে নতুন এক ব্র্যান্ড দিয়েছেন। তাঁর মতে, বিজ্ঞানের অবশ্যম্ভাবী অগ্রযাত্রায় যদি কোনো বাধা আসে, তাহলে সে বাধা অতিক্রমের জন্য যে কোনো পদ্ধতি নেওয়া হয়, নেওয়া হয়েছে। কী বাধা? বাধা হচ্ছে, কোনো একটা প্রস্তাবিত কাঠামো যখন আর সমস্যা সমাধান করতে পারে না, তখন বিকল্প বৈজ্ঞানিক ধারা তৈরি হয়। এই বিকল্প কিছু করতে যে সবক্ষেত্রে ধরাবাঁধা নিয়ম মানতে হবে, এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। তাই এগেন্সট মেথড-এ ফায়ারাবেন্ড লিখছেন, To those who look at the rich material provided by history, and who are not intent on improvising it in order to please their lower instincts, their craving for intellectual security in the form of clarity, precision, ‘objectivity’, ‘truth’, it will become clear that there is only one principle that can be defended under all circumstances and in all stages of human development. It is the principle: anything goes.
বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মূল সারৎসার হচ্ছে তথ্য ও উপাত্তের ভিত্তিতে একটা পরীক্ষণমূলক সত্যে পৌঁছানো। এর প্রধান অস্ত্র হচ্ছে ‘আরোহমূলক’ অনুমান অনুসরণ। এই আরোহমূলক অনুসরণের বিরুদ্ধে তিনি একটা বিরুদ্ধ-আরোহ পদ্ধতি বা আরোহ-বিমুখতার (Counter inductive) প্রস্তাব করেন। সেটা হচ্ছে, বিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠিত সূত্র ও বিষয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রকল্প চিন্তা করা। যেহেতু প্রতিষ্ঠিত সূত্রকে আরোহপদ্ধতিজাত মনে করা হয়, তাই এর অসঙ্গতিপূর্ণ কাজকে আরোহবিমুখ পদ্ধতি বলা যায়। এখন স্বাভাবিকভাবে এই প্রশ্ন আসবে, আরোহবিমুখতা কি আরোহ পদ্ধতির থেকে অধিক গ্রহণযোগ্য? আরোহবিমুখতা যেহেতু আরও অন্যপদ্ধতির আহ্বান করে, সে কারণে এটা বহুত্ববাদী পদ্ধতির সমার্থক। দুই বা একাধিক পদ্ধতির সাথে তুলনার মাধ্যমে একটা গ্রহণযোগ্য এবং অধিক যুক্তিপূর্ণ পদ্ধতি গ্রহণ করার বিষয়টা সামনে হাজির হয়। কারণ জ্ঞান তা সে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানই হোক আর সাধারণ জ্ঞানই হোক সব সময় একটা সম্পূর্ণতার দিকে যাত্রা করে। কারণ জ্ঞান সৃষ্টি হয় পরস্পর অসঙ্গতির মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য একটাকে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে। তাহলে বিজ্ঞান কি কোনো বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান দেয় না? বিজ্ঞান বইয়ের ওপর থেকে আমাদের কি অস্থা উঠে যাবে? বৈজ্ঞানিকরা এক একজন ফেয়ারি টেইল বা উপকথার লেখক হয়ে উঠবেন? নিশ্চয়ই নয়। তাহলে?
আরও পড়ুন: উত্তর-আধুনিকতার মর্মকথা
অনেকে মনে করেন, ফায়ারাবেন্ড ছিলেন বিজ্ঞানের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম শত্রু। ১৯৮৭ সালে নেচার পত্রিকায় Where Science Has Gone Wrong শিরোনামে একটা প্রবন্ধ লেখেন দুজন বৃটিশ পদার্থবিজ্ঞানী। নেচার পত্রিকায় এই নিবন্ধের সাথে ছাপা হয় তিনজন বিজ্ঞানের দার্শনিকের সাথে। এঁদের নাম পপার, কুন ও ফায়ারাবেন্ড। জন হরগান সে সময় কুন ও পপারের একটা ইন্টারভিউ করেন। তাতে হরগান দাবি করেন, তাঁরা দুজনেই নিজেদের কথায় নিজেরা ফাঁদে পড়েন। মানবচিন্তার মুক্তির কথা বলে তিনি বিজ্ঞানকে জাদুবিদ্যা, ভুডু কিম্বা জ্যোতিষশাস্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন। আর এর ফলে বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে ষষ্ঠ শতাব্দীর আগে গ্রীসের কল্পরাজ্যের ঘুমপাড়ানি গান অথবা প্রাচীন ভারতের বৈদিক পূর্ববর্তী যুগের অদ্ভুত সব কল্পকথা। কিন্তু বিজ্ঞান তো মিথ নয়, নয় ফ্যান্টাসি।
পল ফায়ারাবেন্ড তৈরি করেছেন বিতর্ক, হয়ে উঠেছেন অবিশ্বাসী। বিজ্ঞানের দর্শনের ভিন্ন স্রোতের মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর অবিচারী নোটে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা লিখেছিল, ‘Paul Feyerabend was a free spirit—irreverent, brilliant, outrageous, life-enhancing, unreliable and, for most who knew him, a lovable person’. ফায়ারাবেন্ড যদিও একজন এনার্কিস্ট হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন, যদিও অনেকের কাছে তিনি অনাহূত তবু বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর রাশি রাশি প্রশ্ন দার্শনিকদের সাংঘাতিক রকম ভাবায়।
এসইউ/জেআইএম