দেশজুড়ে

মেশিনের দাপটে হারানোর পথে হাতে ভাজা মুড়ি

সারা বছরই মুড়ির কদর থাকে। তবে রমজান মাস এলেই যেন নওগাঁয় মুড়ির চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। লবণ-পানি দিয়ে হাতে ভাজা মুড়ির স্বাদ অন্যরকম। কিন্তু মেশিনে তৈরি মুড়ির দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ি। ফলে কারিগরদের কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে। অনেকে পেশা বদলেছেন। যারা আজও আছেন তারা হাতে ভাজা মুড়ির ঐতিহ্য ধরে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা চান।

Advertisement

নওগাঁ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ড দুর্গাপুর কলেজপাড়া। শহর থেকে দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। এ গ্রামে প্রায় শতবছর ধরে লবণ-পানি দিয়ে হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি হয়ে আসছে। ১০ বছর আগেও প্রায় ৮০টি পরিবার মুড়ি তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেসময় এ পাড়াটি মুড়ি পাড়া হিসেবেও পরিচিত ছিল। নিজেরা ধান চাষ থেকে শুরু করে চাল উৎপাদন করে শুকিয়ে কয়েকটি ধাপে মুড়ি তৈরি করতো। এ মুড়ি বিক্রির আয়ে তাদের জীবন জীবিকা চলতো। বর্তমানে সেখানে মাত্র সাতটি পরিবার হাতে ভাজা মুড়ি তৈরি করছে। প্রতিদিন এ পাড়া থেকে প্রায় ৩০০ কেজি মুড়ি উৎপাদন হচ্ছে। তবে মেশিনের মুড়ির দাপটে প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে অনেকে এখন পেশা বদলেছেন।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, কাকা ডাকা ভোর থেকে শুরু হয়েছে মুড়ি ভাজার কার্যক্রম। মুড়ি ভাজার কাজে দুই চুলা ব্যবহৃত হচ্ছে। একপাশে মুড়ির চালে লবণ-পানি মিশিয়ে গরম করা হচ্ছে। আরেক পাশে হাড়িতে বালি দিয়ে সেই গরম করা চাল থেকে মুড়ি ভাজা হচ্ছে। একজন চাল গরম করেন অপরজন মুড়ি ভাজেন। তবে অনেক সময় একাও এ কাজ করতে হয়।

এভাবে প্রতিদিন ৫০ কেজি চালের মুড়ি ভাজা হয়। সকাল থেকে চলে ৯-১০ টা পর্যন্ত। এরপর বাড়ির পুরুষরা মুড়ি নিয়ে বিভিন্ন গ্রাম ও হাট-বাজার ঘুরে বিক্রি করেন।

Advertisement

এদিকে জেলায় প্রায় ১০টি মেশিনের মুড়ির কারখানা আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) এলাকায় আছে তিনটি। এ তিন কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১১ হাজার কেজি মুড়ি উৎপাদন হয়। আর বাকি কারখানায় প্রায় ১০ হাজার কেজি। এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৩ লাখ টাকার মুড়ি উৎপাদন হয়। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলা, জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলা এবং রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় সরবরাহ করা হয়। তবে রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় প্রায় ২০ লাখ টাকার মুড়ি উৎপাদন হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

হাতে ভাজা মুড়ির কারিগররা জানান, এখন তাদের ধান ভেঙে আর চাল উৎপাদন করতে হয় না। সরাসরি বাজার থেকে মুড়ির চাল কিনে লবণ-পানি মিশিয়ে হাতে মুড়ি ভাজা হয়। ভোর থেকে শুরু হয় তাদের মুড়ি ভাজার কার্যক্রম। পাঁচ-ছয় ঘণ্টায় দুজন কারিগর ৫০ কেজি চালের মুড়ি ভাজতে পারেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে কারিগর মলিনা রানি বলেন, ‘মেশিনের উৎপাদিত মুড়ির সঙ্গে আমরা পেরে উঠছি না। মেশিনে মুড়ি উৎপাদনে খরচ কম এবং কম সময়ে বেশি মুড়ি ভাজা যায়। হাতে ভাজা মুড়িতে সময় বেশি লাগার পাশাপাশি উৎপাদন খরচও বেশি পড়ে। এ কারণে অনেকে পেশা পরিবর্তন করে এখন কৃষি কাজ বা অন্য কাজ করছেন। তবে বাপ দাদার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে কষ্ট করে এখনো অনেকে এ পেশা করে যাচ্ছে।’

মলিনা রানি আরও বলেন, ‘মেশিনে মুড়ি ভাজা শুরু হওয়ার পর আমাদের কপাল পুড়তে শুরু করেছে। ২৫ বছর থেকে মুড়ি ভাজার কাজ করছি। আগে নিজেদের মুড়ি ভাজতাম। গত পাঁচ বছর ধরে অন্যের মুড়ি ভেজে দেই। ৫০ কেজি মুড়ি ভেজে ৩০০ টাকা পাই। এরমধ্যে খরচ হয় ১৫০ টাকা। যেখানে খড়ি লাগে ১২৫ টাকা এবং লবণ ২৫ টাকা। বসে না থেকে কাজ করলে কিছু টাকা পাওয়া যায় জন্যই করছি।’

Advertisement

দুর্গাপুর গ্রামের মুড়ি বিক্রেতা সুভাস বলেন, ‘বাপ-দাদার সময় থেকে আমরা মুড়ি ভাজা-বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৫০ কেজি চালের মুড়ি ভাজতে ৩ হাজার ২০০ টাকা খরচ পড়ে। এরমধ্যে ৫০ কেজি চালের দাম ২ হাজার ৯০০ টাকা আর খড়ি-লবণ ও কারিগরের মজুরি ৩০০ টাকা। ৫০ কেজি চাল থেকে ৪৩ কেজি মুড়ি হয়। প্রতিকেজি মুড়ির উৎপাদন খরচ ৭৪ টাকা। বাজারে বিক্রি হয় ৮০ টাকা কেজি। পুরুষরা বিভিন্ন গ্রাম ও হাট ঘুরে মুড়ি বিক্রি করে।’

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) এলাকায় শোভা চিড়া ও মুড়ি মিলসের মালিক উজ্জল কুমার দাস বলেন, ‘৫০ কেজি বস্তা চাল থেকে মুড়ি উৎপাদন করতে খরচ পড়ে ২ হাজার ৫৫০ টাকা। এরমধ্যে চালের দাম পড়ে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং অন্যান্য খরচ ১৫০ টাকা। ৫০ কেজি চাল থেকে মুড়ি হয় সাড়ে ৪২-৪৩ কেজি। প্রতিকেজি মুড়ি উৎপাদনে খরচ পড়ে ৬০ টাকা। যেখানে পাইকারি বিক্রি হয় ৬৩-৬৫ টাকা কেজি। রমজান মাসে মুড়ির চাহিদা বেশি থাকায় প্রতিদিন প্রায় ৮-৯ হাজার কেজি মুড়ি উৎপাদন হয়। আর অন্য সময় ৭ হাজার কেজি।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প (বিসিক) নওগাঁর উপ-ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, মেশিনে তৈরি মুড়ির দাপটে পেশা টিকিয়ে রাখা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে হাতে ভাজা মুড়ি কারিগরদের। এরপরও এখনো মোটামুটি হাতে ভাজা মুড়ির চাহিদা আছে। হাতে ভাজা মুড়ির ঐতিহ্য রক্ষায় কারিগরি প্রশিক্ষণসহ ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ ব্যবস্থাসহ সবধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে।

এসজে/জিকেএস