মতামত

বিচারপতি তোমার বিচার…

যে কোনো সমাজে বা দেশে বিচারকদের মর্যাদা সবসময় উঁচুতে, অনেক উঁচুতে। বলা হয় বিচারকদের চোখ বন্ধ থাকে; তারা সাক্ষি, যুক্তিতর্ক শুনে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেন। অন্য কোনো কিছুই একজন বিচারককে প্রভাবিত করতে পারে না, পারা উচিত নয়।

Advertisement

সাধারণভাবে বিচারকরা একটু বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করেন, যাতে তারা সামাজিক নানা প্রবণতায় প্রভাবিত না হন। একটা সময় ছিল যখন বিচারকদের নির্দিষ্ট আসন বিচারকদের চেহারাই সাধারণ মানুষ দেখতে পেতো না। ইদানীং অবশ্য বিচারকরাও নানান সামাজিক অনুষ্ঠানে যান।

তবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হোন, আর সাধারণ জজ হোন, সবার কাছেই আমাদের প্রত্যাশা ন্যায়বিচারের। কিন্তু বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রুবাইয়া ইয়াসমিন বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি বিচারকের আসনে বসার যোগ্য নন। ন্যায়বিচার তো দূরের কথা কোনো বিচার করারই নৈতিক অধিকার তার নেই। অথচ বিষয়টি খুবই সামান্য।

রুবাইয়া ইয়াসমিনের কন্যা বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এই স্কুলে নিয়ম করে শিক্ষার্থীরাই ক্লাশরুম পরিষ্কার করেন। রোল নাম্বার অনুযায়ী প্রতিদিন ৫ জন করে শিক্ষার্থী ক্লাশরুম পরিষ্কার করেন। মর্নিং শিফটের শিক্ষার্থীরা ক্লাশ করে যাওয়ার পর ডে শিফটের ছাত্রীরা ক্লাশরুম পরিষ্কার করেন। আর ডে শিফটের ক্লাশরুম পরিষ্কার করেন পরদিন মর্নিং শিফটের শিক্ষার্থীরা।

Advertisement

বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে শিক্ষার্থীদের দিয়ে ক্লাশরুম পরিষ্কার করানো নিয়ে একটু বলে নেই। ফেসবুকে দেখলাম অনেকেই, ছাত্রীদের দিয়ে ক্লাশরুম পরিষ্কার করানো নিয়ে বেশ উষ্মা প্রকাশ করছেন। তাদের দাবি, ক্লিনার থাকতে কেন শিক্ষার্থীদের দিয়ে ক্লাশরুম ঝাড়ু দেয়া বা পরিষ্কার করানোর কাজ করাতে হবে। আমি কিন্তু এই উষ্মার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না।

ক্লাশরুম কিন্তু শুধু পাঠ্যবই পড়ানোর জন্য নয়। পাঠ্য বই পড়ানোর কাজ ইদানীং অনলাইনেও সম্ভব। বিদ্যালয়ের ক্লাশরুমে আসলে জীবন পড়ানো হয়। পাঠ্যবই পড়ানো তার ছোট্ট একটা অংশ মাত্র। সবার সাথে মিলে মিশে ক্লাশ করা, নেতৃত্বের গুণাবলীর বিকাশ, মানবিকতার শিক্ষা, শিক্ষকদের সাথে আচরণ, বড়-ছোটদের সাথে আচরণ, স্কুলের অন্য কর্মচারিদের সাথে আচরণ- সবকিছুই স্কুলে শেখা যায়।

নিজেদের ক্লাশরুম নিজেরা পরিষ্কার করার মধ্যে কোনো গ্লানি নেই। আমার ছেলে প্রসূন আমিন সেন্ট যোসেফ স্কুলে পড়তো। স্কুলে দেরি করে গেলে বা কোনো অন্যায় করলে তাদের দিয়ে মাঠ পরিষ্কার করানো হতো। এটা নিয়ে গাইগুই করার কোনো সুযোগ ছিল না। প্রসূন কোনো দিন আলসেমি করলে আমি তাড়া দিতাম, তাড়াতাড়ি কর, নইলে কিন্তু মাঠ পরিষ্কার করতে হবে। কড়া রোদে মাঠ পরিষ্কার করতে তাদের কষ্ট হতো। কিন্তু আমার কখনো এটা আপত্তিকর মনে হয়নি। একজন শিক্ষার্থীকে সার্বিকভাবে মানুষ হয়ে উঠতে হলে জীবনের সব ক্ষেত্রের পাঠ নেয়াটা জরুরি। সমস্যা এই ঝাড়ু দেয়া নিয়েই।

গত সোমবার বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রুবাইয়া ইয়াসমিনের মেয়ের শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে ঝাড়ু দিতে অস্বীকৃতি জানালে সহপাঠীদের সঙ্গে তার বাকবিতণ্ডা হয়। বাসায় ফিরে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, ‘স্কুলে যে বস্তিগুলা ঝাড়ু দেই না বইলা বলছিল, আমি জজের মেয়ে দেখে ভাব দেখাই। হু দেখাই। আমার মা জজ, আমি ভাব দেখাবো না তো কে দেখাবে? পারলে তোর মাকেও জজ হয়ে দেখাতে বল। আইসে বস্তি।’

Advertisement

জজের মেয়ের এই স্ট্যাটাসে তার অন্য বান্ধবীরাও মন্তব্য করেন, যা সেই জজ এবং জজের মেয়ের পছন্দ হয়নি। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রুবাইয়া ইসলাম পরদিন মেয়ের স্কুলে যান এবং ‘আপত্তিকর মন্তব্য’ করা তিন শিক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের ডেকে আনান। রুবাইয়া ইসলাম শিক্ষার্থী সাইবার মামলায় কারাগারে পাঠানোর হুমকি দেন। প্রধান শিক্ষকের সামনেই এই অন্যায় হুমকি দেন রুবাইয়া ইসলাম।

হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। ভয় পাওয়া দুই অভিভাবককে বাধ্য করেন তার পায়ে ধরে মাফ চাইতে। প্রধান শিক্ষকের উপস্থিতিতে এক অভিভাবক আরেক অভিভাবকের পায়ে ধরে মাফ চাইছে, এর চেয়ে অশ্লীল দৃশ্য আর হতে পারে না। এ ঘটনায় সবাই অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে দুষছেন। তার দোষ অবশ্যই বেশি, শাস্তিযোগ্য। তবে প্রধান শিক্ষকের অপরাধও কম নয়।

প্রথম কথা হলো, প্রধান শিক্ষক ছাত্রীদের মধ্যকার ঝগড়ায় অভিভাবকদের ডেকে আনতে পারেন না। প্রধান শিক্ষকের উচিত ছিল, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজকে কঠোর ভাষায় বলে দেয়া যে, স্কুলে তিনি একজন অভিভাবকমাত্র, জজ নন। এখানে তিনি বা তার মেয়ে বাড়তি কোনো সুবিধা প্রাপ্য নন। সবাইকে ক্লাশরুম পরিষ্কার করতে হবে, জজের মেয়ের জন্য স্কুলে আলাদা নিয়ম থাকবে না। প্রধান শিক্ষক সেটা তো করেনইনি, উল্টো জজের হয়ে অন্য শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের শাসিয়েছেন এবং জজের পায়ে ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেছেন। জজ বা প্রধান শিক্ষক অন্যায় করলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ অন্যায় মেনে নেয়নি।

বিচারকের বিচার করতে তারা রাস্তায় নেমে আসেন, প্রতিবাদ জানায়। একজন সাধারণ শিক্ষার্থী অল্প কথায় চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন গোটা ঘটনার অসঙ্গতিটা, ‘তাহলে আমাদের মারা কেন এসে পা ধরবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন একটা জায়গা যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। জজ হইলেও উনি ফার্স্ট আমাদের স্কুলের একজন অভিভাবক। আমার মাও আমার স্কুলের একজন অভিভাবক। আমার বান্ধবীর মাও একজন অভিভাবক। তাহলে কীভাবে একজন অভিভাবক আরেকজন অভিভাবকের পা ধরে।’

অষ্টম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ, প্রধান শিক্ষকসহ আমাদের সবাইকে জীবনের বড় একটা শিক্ষা দিয়ে দিল। অথচ আমরা এই সহজ সত্যটা বুঝতেই পারিনি। জেলা প্রশাসক এসে শিক্ষার্থীদের নিবৃত করেছেন। সরকারও রুবাইয়া ইয়াসমিনকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করেছে। বিচারকের বিচারটা ন্যায় হলো না। বগুড়া থেকে ঢাকায় মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তি তো শাস্তি নয়, পুরস্কার। এখন এই জজের মেয়ে ঢাকার কোনো স্কুলে ভর্তি হয়ে তার দাপট দেখাবে।

এই ঘটনায় রুবাইয়া ইসলাম স্পষ্টতই ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। শিক্ষার্থীদের হুমকি দিয়েছেন, অভিভাবকদের পায়ে ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেছেন। আইন মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেবে। একটা বিষয় পরিষ্কার, রুবাইয়া ইসলামের কোনো পর্যায়েই বিচারকের আসনে বসার নৈতিক অধিকার নেই। বিষয়টি ধামাচাপার পর যেন তাকে আবার কোথাও বদলি করা না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে তার আদালত থেকে অনেক অন্যায় রায় আসবে, মানুষ বঞ্চিত হবে ন্যায়বিচার থেকে।

তবে এই ঘটনায় আমার মায়া হচ্ছে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ রুবাইয়া ইসলামের অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েটির জন্য। ছেলেবেলা থেকেই কী ভয়ঙ্কর বৈষম্য নিয়ে বড় হচ্ছে মেয়েটি। সে বুঝতে পারছে না, জজের মেয়ে বাড়তি কোনো যোগ্যতা নয়। স্কুলের সব সহপাঠি যে সমান মর্যাদার এটা তাকে বলাই হয়নি। বন্ধুদের যে বস্তির মেয়ে বলা উচিত নয়, এটা সে উপলব্ধি করতে পারেনি।

পৃথিবীতে যে কোনো কাজই যে ছোট নয়, এটা তাকে শেখানো হয়নি। নিজেকে জজের মেয়ে এবং বন্ধুদের ‘বস্তিগুলা’ বলে স্ট্যাটাস দেয়ার রুবাইয়া ইসলামের উচিত ছিল, তার মেয়েকে নিয়ে বসা, তাকে কাউন্সেলিং করা, তাকে বোঝানো। আমার ধারণা মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে বিসিএস টপকে বিচারক বনে যাওয়া রুবাইয়া ইসলাম নিজেই জীবনের শিক্ষাটা ঠিকমত পাননি। মেয়ের আগে মায়ের কাউন্সেলিং জরুরি। মেয়েকে বোঝাতে হবে, জীবনটা অনেক বড়। মানুষ সবাই সমান। জজের মেয়ে হওয়াতে তার কোনো কৃতিত্ব নেই। এই পৃথিবীতে ভালো মানুষ হিসেবে টিকে থাকতে হলে, এগিয়ে যেতে হলে, সেটা নিজের যোগ্যতায় করতে হবে।

লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম