জানি, বহুবার পড়েছি কীভাবে বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছেন, কীভাবে পাকিস্তানীরা অত্যাচার করেছে এবং কীভাবে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা দেশকে স্বাধীন করেছেন। কিন্তু আজও সম্ভবত আমরা অনেকেই উপলব্ধি করতে পারিনি, বঙ্গবন্ধু কাদের হাত থেকে এই জাতিকে মুক্ত করেছেন!
Advertisement
একটা নিয়মিত বাহিনী কতটা উন্মাদ, কতটা বিকৃত হতে পারে তার উদাহরণ ১৯৭১ সালের পাকিস্তান বাহিনীর উপর আর নাই। এটি কোনো গালি না। এই লেখায় আমি হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট এবং পাকিস্তানী লেখকদের তুলে ধরলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকালে যুদ্ধে পরাজয়ের কারণ জানতে জুলফিকার আলী ভুট্টো একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেন, যে কমিশনের প্রধান করা হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী বিহারি বিচারপতি হামুদুর রহমানকে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর এই তদন্ত কমিশন সম্পর্কে জর্জটাউন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ক্যারল ক্রিস্টাইন ফেয়ার ২০২২ সালের এক আর্টিকেলে লিখেছেন, ‘ভুট্টোর এই তদন্ত কমিশন গঠন ছিল অনেকটা একজন ডাকাতের তার নিজের অপরাধ সম্পর্কে অভিযোগ গঠনের আদেশ প্রদানের সামিল। ৮০টি সিট পেয়ে যিনি নিজে ১৬২ সিট পাওয়া ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা প্রদানে বাধা দেন, তার তৈরি এই কমিশন।’
হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে কিছু ত্রুটি আছে। আর সেটা থাকাই স্বাভাবিক। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৯ মাসে মোট ২৬ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে তাদের দ্বারা। পক্ষান্তরে ১ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ নিরিহ বিহারি, পশ্চিম পাকিস্তানী এবং দেশপ্রেমি পূর্ব পাকিস্তানীকে হত্যা করেছে মুক্তিকামীরা। বোঝেন ঠেলা!
Advertisement
তথাপি হামুদুর রহমান কমিশন পাকিস্তান সম্পর্কিত, বিশেষ করে পাকিস্তানের মিলিটারি সংক্রান্ত তদন্তে অনেক কিছু লুকাতে পারেনি। সে সুযোগও ছিল না। আর সেকারণেই পাকিস্তান দীর্ঘ ২৮ বছর এই কমিশনের রিপোর্ট গোপন করে রেখেছিল। কমিশন ২০০ প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছে। ভুট্টোর কাছে হস্তান্তরের পর রিপোর্ট ক্লাসিফায়েড বা গোপন করে রেখেছিলেন ভুট্টো নিজেই। এর প্রধান কারণ ছিল, পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর এত নগ্ন কাহিনী উঠে এসেছে যে গোটা দেশের ভাবমূর্তি বলে কিছু থাকবে না।
দ্বিতীয় কারণ, তিনি জানতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা এই রিপোর্ট প্রকাশ করলে নাখোশ হবে। তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন না। যদিও শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি। অফুরন্ত ক্ষুধার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সন্তোষ্ট রাখা যায় না। নিজেই নিজের শিষ্য জেনারেলের হাতে প্রাণ দিলেন।
যা হোক, ভুট্টো পরে যিনিই পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েছেন তাকেই সেনাবাহিনীকে নানাভাবে তৃপ্ত রাখতে হয়েছে। আর সেটা করতে গিয়ে এই রিপোর্ট গোপন রেখেছেন। অবশেষে ভারতীয় একটি সংবাদ মাধ্যম এই রিপোর্টের কিছু অংশ হস্তগত করে প্রকাশ করলে পাকিস্তান ২০০০ সালে রিপোর্টটি প্রকাশে বাধ্য হয়।
কী আছে সেই রিপোর্টে? বরং বলি, কী নাই সে রিপোর্টে! পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বর্ণিত হয়েছে ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জেনারেল ইয়াহিয়াসহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উশৃঙ্খল জীবনযাপন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও লুটপাটের কাহিনী। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের একটি আসক্তি ছিল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে একবারের জন্য হলেও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা।
Advertisement
অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেসব কর্মকর্তারাও নিজেদের স্ত্রীদের ইয়াহিয়ার কাছে ঠেলে দিতে সামান্য কুণ্ঠা বোধ করেননি। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে এবং পাকিস্তানীদের লেখায় আছে, একটি নয় বা দুটি নয়- অসংখ্য কর্মকর্তা নিজেরা স্ত্রীকে পৌঁছে দিয়েছেন ইয়াহিয়ার রাওয়ালপিন্ডির অথবা করাচির ডেরায়।
আকলিম আখতার রানি নামে একজন দেহব্যবসায়ি নারী ছিলেন। তাকে সবাই এখনো চেনে জেনারেল রানি নামে। তিনি রাওয়ালপিন্ডিতে একটি বাসা নিয়ে সেই বাসায় নারী সংগ্রহ করতেন এবং সেনা কর্মকর্তাদের সাপ্লাই দিতেন। এক পর্যায়ে তিনি ইয়াহিয়ার মোক্ষরানি হয়ে ওঠেন এবং জেনারেল রানির বাড়ি ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হয়।
পরবর্তী জীবনে তিনি সাক্ষাৎকার দিয়ে জানিয়েছেন, অসংখ্য নারীকে তিনি ইয়াহিয়া খান, জেনারেল লতিফ, জেনারেল হামিদ, ব্রিজেডিয়ার জেহানজেব আরবাবসহ অসংখ্য সামরিক কর্মকর্তাকে সরবরাহ করতেন। যেসব নারী ব্যবহৃত হয়েছেন তারমধ্যে অনেককেই আমরা চিনি। সামাজিকভাবে তারা পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত। তাদের নাম উল্লেখ না করাই শোভন।
আরেকজন দেহব্যবসার সঙ্গে জড়িত নারী ছিলেন সাঈদা বুখারি। তিনি লাহোরে ‘সিনোরিটা হোম’ নামে একটি ব্রোথেল হাউস চালাতেন। এই নারীর ছিল জেনারেল এ কে নিয়াজির সঙ্গে পানের ব্যবসা। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পান রপ্তানি ছিল তখন রমরমা ব্যবসা। এই নারীর খরিদ্দারও ছিলেন ইয়াহিয়া- নিয়াজি থেকে শুরু করে জাঁদরেল সব জেনারেলরা।
ব্রিটিশ নিয়মের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানে নিয়ম ছিল (সম্ভবত এখনো আছে) প্রেসিডেন্টের বাসভবনে কে প্রবেশ করলো, কখন প্রবেশ করলো, কখন বের হলো সব রেজিস্ট্রি খাতায় উল্লেখ রাখা বাধ্যতামূলক। সেই হিসাবে ইয়াহিয়া খানের রাওয়ালপিন্ডি এবং করাচির বাসভবনের সব হিসাব রেজিস্ট্রি খাতায় লেখা ছিল।
হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত খাতার অনেক পাতা তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, কোনো কোনো নারী সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে প্রবেশ করে পরদিন সকালে বের হয়ে আসতেন। উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত গায়িকা দিনে দু থেকে তিনবারও দেখা করতে যেতেন।
এই গায়িকা প্রথমে আয়কর সংক্রান্ত ঝামেলায় পড়ে জেনারেল আকলিম আখতার রানির মুখাপেক্ষি হন। আকলিম তাকে ইয়াহিয়ার কাছে নিয়ে যান। তখনই ‘কুইন অব মেলোডি’ মধ্যবয়স্ক। রানির ভাষ্যমতে, ইয়াহিয়া খান এই গায়িকার গায়ে ‘দারু’ ঢেলে তা গা থেকে চেটে খেতেন।
রানি প্রত্যক্ষদর্শী। চিফ অব স্টাফ জেনারেল আব্দুল হামিদ খান এবং ইয়াহিয়া খান একসঙ্গে মিলে একাধিক নারী নিয়ে সরে পড়তেন। কী করে এরকম আচরণ কোটি কোটি মানুষের দায়িত্ব নেওয়া ব্যক্তিদের দ্বারা সম্ভব!
হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেই আছে, জেনারেল হামিদের স্ত্রী আনোয়ার ইষা’র স্ত্রীকে নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭.২০ মিনিটে ইয়াহিয়ার ডেরায় প্রবেশ করেন। সেখান থেকে তারা বের হন রাত ১১.৪০ মিনিটে। মে মাসের ২ তারিখে জেনারেল লতিফের স্ত্রী বেগম গুল নেওয়া কে নিয়ে প্রবেশ করেন রাত ৮ টায়। কখন বের হন তার কোনো রেকর্ড নেই। ১৯৭১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জেনারেল শহিদ আহমেদের স্ত্রী সন্ধ্যা ৭টায় ইয়াহিয়ার ঘরে ঢোকেন এবং রাত ১২,৫ মিনিটে, অর্থাৎ পাঁচ ঘন্টা পর বের হন!
ইয়াহিয়া থাকতেন সবসময় মদ্যপ। দেশের এতবড় সমস্যা, লক্ষ সেনা পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত, সেই দেশের শাসক কী করে একেক জন নারীর সঙ্গে পাঁচ ঘন্টা, সাত ঘন্টা কাটাতে পারেন! মধ্যযুগের বা প্রাচীন যুগের কোনো শাসকও তো এই আচরণ করতেন না!
শুধু ইয়াহিয়া তো নয়, উচ্চাসনে দায়িত্বপালনকারী পাকিস্তানী মিলিটারিরা নারী সম্ভোগের ব্যাপারে উন্মত্ত হয়ে থাকতেন! এমনকি ১১-১২ ডিসেম্বর যখন শত্রুর গোলা গিয়ে পাশের ক্যাম্পে পড়ছে তখনো কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াতুল্লাহ তার বাঙ্কারে কয়েকটি মেয়ে নিয়ে ‘ফূর্তি’ করছেন।
৬০৪ ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মেজর সাজ্জাদুল হক কমিশনের কাছে সাক্ষি দিয়েছেন, ঢাকায় প্রায়শই নিত্যশিল্পীদের ধরে নিয়ে আসা হতো জেনারেলদের আমোদ-ফূর্তির জন্য। তিনি আরো বলেছেন, টাইগার নিয়াজি নিজে তিন তারকা স্টাফ কার-এ মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতে বেরিয়ে যেতেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ আহমেদ খান কমিশনের কাছে দেওয়া সাক্ষিতে বলেছেন, সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে একটি কথা ছিল যে ‘কমান্ডার যেখানে ধর্ষক, সেখানে নিজেকে সামলে রাখি কী করে! জেনারেল নিয়াজি নিজেও নির্লজ্জের মতো বলেছিলেন,‘আপনি পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ করবেন, মরবেন আর যৌন সংসর্গ করতে ঝিলাম যাবেন এমন প্রত্যাশা করতে পারেন না।’
ইয়াহিয়া খানের মিলিটারি সেক্রেটারি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইসহাক হামুদুর রহমান কমিশনকে বলেছিলেন, ‘আমি ইয়াহিয়া খানের এইরকম নিজেকে ধ্বংস করা থেকে রক্ষা করতে কোরআনের আয়াত পড়ে শোনাতাম।’ তৎকালীন পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক এন এ রিজভী কমিশনের কাছে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি হলাম একমাত্র মানুষ যে প্রেসিডেন্টকে বলেছিলাম, স্যার আপনি অত্যন্ত উচ্চ আসনে বসা। আপনাকে মনে রাখতে হবে আপনার কিছু বাধ্যবাধকতা আছে। এমনকি একথাও বলেছিলাম যে আমি বেগম সাহেবাকে বলবো, আপনি যেখানে যান তিনিও যেন আপনার সঙ্গে যান!’
এইসব অসংযত, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজ করতে গিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের ক্ষমতার কী রকম অপব্যবহার হয়েছে তার একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে লেখা শেষ করছি। বেগম শামীম কে এন হুসেন রাতে ইয়াহিয়ার ডেরায় প্রবেশ করতেন এবং ভোরে বের হয়ে যেতেন প্রায়ই।
পরে শামীমকে অস্ট্রিয়ায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়, তার স্বামী কে এন হুসনকে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত এবং শামীমের পিতা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আমিন আহমেদকে ৭০ বছর বয়সে ন্যাশনাল শিপিং করপোরেশনের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। শামীম বা তার স্বামী হুসেন কেউই ফরেইন সার্ভিসের লোক ছিলেন না, কূটনৈতিক কোনো অভিজ্ঞতাও ছিল না।
এই ধরনের সুবিধা আদায়ে কিছু উচ্চ পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তা নিজের সুন্দরী স্ত্রীকে ইয়াহিয়ার ডেরায় পৌঁছে দিয়ে বাড়ি চলে যেতেন। বাণিজ্যসহ নানা পদ পদবির ক্ষুধা তাদেরকে ‘কাকোল্ড’ বানিয়েছে। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়! হামুদুর রহমান রিপোর্টে এমন প্রায় ৫০০ নারীর নাম উল্লেখ আছে।
জেনারেল ইয়াহিয়া কিন্তু রাওয়ালপিন্ডির হার্লি স্ট্রিটে তার বাড়িতে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করে, সরকারের সব সুবিধাদি ভোগ করে ১৯৮০ সালের আগস্টমাসে মৃত্যুবরণ করেন। এসব অপরাধের জন্যও তাকে কোনো বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। কমিশনও তার এইসব অপরাধের জন্য কোনো শাস্তির কথা উল্লেখ করেনি। বরং কমিশনের রিপোর্টের ১২ কপির মধ্যে ১১টিই পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। সুতরাং বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে কাদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন তা বোঝা গেল?
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।mohshin266@gmail.com
এইচআর/এমএস