৬ অক্টোবর ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৬ই রজব ৫৮৩ হিজরিতে সম্মিলিত ক্রুসেড বাহিনীকে পরাজিত করে বাইতুল মুকাদ্দাসে বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন মুসলিম জাতির সূর্য সন্তান সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। যে রজব মাসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে মিরাজে গিয়েছিলেন, আল্লাহপাকের অপার মহিমায় সে রজব মাসেই মুসলমানরা বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করার সৌভাগ্য অর্জন করেন। মুসলিম বাহিনী শহরে প্রবেশ করার সাথে সাথেই মুসলমানদের মাঝে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ দিনের বন্দিত্ব আর সীমাহীন অত্যাচার থেকে মুক্তি পেয়ে আনন্দ বেদনার এক বিচিত্র অনুভূতিতে ভরে উঠে তাদের হৃদয়গুলো।অপর দিকে জেরুজালেম শহরের খ্রিস্টান অধিবাসীদের মনের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। তারা ভেবেছিল ৮৮ বছর ধরে মুসলমানদের উপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়েছে, মুসলিম বাহিনী সে সবের প্রতিশোধ নেয়া শুরু করবে। কিন্তু না দৃশ্যপট ভিন্ন হয়।ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিকদের কাছ থেকে জানা যায়, সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী এই ব্যাপারে উদার মনোভাব ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। তিনি তার সেনাপতি ও কমান্ডারদের শহরে শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করতে কঠোর নির্দেশ দেন এবং কোনো প্রকার অন্যায় অত্যাচার যেন না হয় সে ব্যাপারে সকলকে সতর্ক করেন।খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা তাদের লিখিত গ্রন্থে সুলতান সালাহউদ্দিনের এই মহানুভবতার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। এই মহানুভবতা থেকে যেমন বঞ্ছিত হয়নি স্বয়ং সম্রাট, তেমনি বঞ্ছিত হয়নি কোনো সাধারণ সৈনিক, খ্রিস্টান জনসাধারণ, নারী, শিশু কিংবা তরতাজা যুবক।ফেলে আসা ইতিহাস১৫ জুলাই, ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে মুসলিম আমিরের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে জেরুজালেমের মুসলমানরা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। হাজার হাজার মুসলিমের লাশের উপর দিয়ে মুসলমানদের প্রথম কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করে খ্রিস্টানদের সম্মিলিত ক্রুসেডার বাহিনী। তাদের এই বিজয়ে সর্বত্র খ্রিস্টান দেশগুলতে শুরু হয়ে গেল বিজয়ের উৎসব। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ উৎসব হল বাইতুল মুকাদ্দাসে। বিজয়ী ক্রুসেডার বাহিনী বেপরোয়া লুটপাট শুরু করে মুসলিমদের প্রতিটি ঘরে ঘরে। কোনো ঘরের পুরুষ মানু্ষ, হোক সে বৃদ্ধ বা দুগ্ধ পোষ্য শিশু, কাউকেই জীবিত রাখলো না। জীবিত ছিল শুধু যুবতী মেয়েরা, যারা হয়েছিল পশুদের লালসার খোরাক। বহু সংখ্যক মুসলিম নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় অবস্থান নিয়েছিল মসজিদুল আকসা সহ বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে।ইউরপীয় ঐতিহাসিকদের মতে তখনকার শরণার্থীদের সংখ্যা ছিল ৭০ হাজারেরও অধিক। এই বিপুল সংখ্যক মুসলিম মনে করেছিল খ্রিস্টানরা মসজিদের মত পবিত্র স্থানে আক্রমণ করবেনা। কিন্তু বিজয়ের উল্লাশে মত্ত ক্রুসেডার বাহিনী হিংস্র পশুর মত ঝাপিয়ে পড়ল মুসলিমদের উপর। মসজিদুল আকসাসহ অন্যান্য মসজিদগুলো লাশে ঠাঁসাঠাসি হয়ে গেল। মসজিদগুলো থেকে রক্ত প্রবাহিত হয়ে পড়তে লাগল রাস্তায়।ঐতিহাসিক বিশ্লেষনে দেখা যায়, ‘রাস্তায় এত রক্ত জমা হল যে, খ্রিস্টান অশ্বারোহীদের ঘোড়াগুলোর পা পর্যন্ত সেই রক্তে ডুবে যেত। শুধুমাত্র এইটুকুতেই তারা থেমে থাকেনি। মসজিদুল আকসাসহ বিভিন্ন মসজিদ সমূহকে তারা বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা শুরু করে দিল। কিছু মসজিদ ভেঙ্গে ফেলল, কিছু মসজিদকে ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করল আর কিছু মসজিদ কে পতিতালয় বানিয়ে আল্লাহর ঘরের চরম অবমাননা করল। এভাবেই মুসলিম আমির ওমরাহদের বিলাসিতা, গাদ্দারি ও বিশ্বাস ঘাতকতার ফল দীর্ঘদিন ধরে মুসলমানদের ভোগ করতে হল। যে জুলুমের অবসান ঘটিয়ে ছিলেন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী।বাইতুল মুকাদ্দাসে খ্রিস্টানদের মহা বিপর্যয়ের পর মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পোপ ২য় আরবানুসের আহবানে সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হল সমগ্র খ্রিস্টান শক্তি। ইংল্যান্ডের রিচার্ড দি লায়নহার্ট, ফ্রান্সের ফিলিপ অগাস্টাস আর জার্মানির ফ্রেডরিকের নেতৃত্বে প্রায় ৬ লাখ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে খ্রিস্টানদের পবিত্র স্থান আক্রায় মুসলমানদের অবরোধ করা হয়।১১৮৯ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই আগস্ট থেকে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন বছর মেয়াদী ৬ লাখ সৈন্যের এই বিশাল অবরোধ সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী মাত্র ২০ হাজার মতান্তরে ৩০ হাজার সৈন্য দিয়ে প্রতিরোধ করেন। অবশেষে খ্রিস্টান বাহিনী ১১৯২ খ্রিস্টাব্দের ৯ই অক্টোবর অবরোধ তুলে নিয়ে নিজদেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে শতশত বছর কোন খ্রিস্টান সম্রাট শত চেষ্টা করেও বাইতুল মুকাদ্দাস আর দখল করতে পারেনি।সুলতান আইয়ুবী কর্তৃক বাইতুল মুকাদ্দাস নিয়ন্ত্রণে নেবার প্রায় ৮০০ বছর পর এবং ইসলামী খিলাফাত ধ্বংসের ৪৩ বছর পর মুসলমানরা প্রত্যক্ষ করল এক বেদনাদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা। মুসলিম বিশ্বের পারস্পরিক অনৈক্য ও দুর্বলতার ফলে পবিত্র বাইতুল মুকাদ্দাস আর মসজিদুল আকসা আবার চলে গেল বিধর্মীদের হতে। খ্রিস্টানদের মদদে সেখানে কর্তৃত্ব নিল অভিশপ্ত ইহুদী জাতি। ৮০০ বছর আগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটল সেই পবিত্র মাটিতে। মুসলমানদের রক্তে নতুন করে ভিজতে শুরু করল ফিলিস্তিনের মাটি। যা এখনো বিরাজমান।আজ শুধু ফিলিস্তিন নয় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিম মানবাত্মা ক্রন্দন করছে একজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবীর জন্য।এক নজরে সালাহউদ্দীন আইয়ুবীপূর্ণ নাম : সালাহউদ্দীন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। রাজবংশ : আইয়ুবী। পিতা : নাজমুদ্দিন আইয়ুব। জন্ম : ৫৩২ হিজরি (১১৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)। জন্মস্থান : তিকরিত, মসুল আমিরাত। ধর্মবিশ্বাস : ইসলাম (সুন্নি)। দাম্পত্যসঙ্গী : ইসমতউদ্দিন খাতুন। পূর্বসূরি : নুরউদ্দিন জেনগি। উত্তরসূরি : আল আফদাল (সিরিয়া) ও আল আজিজ উসমান (মিশর)। রাজ্যাভিষেক : ১১৭৪, কায়রো। রাজত্বকাল : ১১৭৪-১১৯৩। মৃত্যু : ৪ মার্চ ১১৯৩ (৫৫ বছর)। মৃত্যুস্থান : দামেস্ক, সিরিয়া। সমাধিস্থল : উমাইয়া মসজিদ, দামেস্ক, সিরিয়া।আল্লাহ তাআলা বর্তমান মুসলিম উম্মাহকে একজন সালাহউদ্দীন আইয়ুবী দান করুন। এ ক্রুসেড বিজয়ীবীর ১১৯৩ সনের ৪ মার্চ দামেস্কে ইন্তিকাল করেন। মহান রাব্বুল আলামীন সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবীকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।এমএমএস/পিআর
Advertisement