যদি প্রশ্ন করা হয় বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে, সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা কে?সম্ভবত সঠিক উত্তরটি হবে শাবানা। একবাক্যে উত্তর দেবে সবাই এবং তা স্বীকার করবে। শাবানা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে রীতিমতো মাইলস্টোন। জনপ্রিয়তার চূড়ান্ত উদাহরণ। প্রায় দীর্ঘ ৪০ বছর একই জায়গায় যিনি তার অবস্থান ধরে রেখেছিলেন, রাখতে পেরেছিলেন। এমন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, দিনের পর দিন, ভাবা যায় কারও!অথচ এই ঈর্ষণীয় সাফল্য তিনি পেয়েছিলেন। শুধু কি তার নিজের কারণে, শুধু অভিনয়ের গুণে, নাকি সামাজিক কাঠামোও শাবানাকে জনপ্রিয় হয়ে উঠবার নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে, সেটিও ভাববার বিষয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ‘শাবানা’ রীতিমতো একটি প্রতীকী চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন। ‘আদর্শ স্ত্রী’র আদর্শই হয়ে উঠেছিলেন শাবানা। শাবানা অভিনীত বেশিরভাগ বাংলা ছবির দিকে তাকালে দেখা যাবে কাহিনীর ছক নির্দিষ্ট, প্রায় একই রকম চিত্র, দৃশ্যে সব কয়টি ছবিতে।প্রায় প্রতিটি ছবিতে শাবানা প্রথমে নায়কের কিংবা নায়ক শাবানার মৃদু প্রেমে পড়েন। দুজনে আলতো ধাক্কা খান, চোখে চোখ রাখেন, মিটিমিটি হাসেন, চিঠি চালাচালি করেন, গাছের গা জড়িয়ে ধরে গান করেন, খানিকটা কাছাকাছি আসেন, অতঃপর বিয়ে এবং সংসার। ছবির কাহিনী এগিয়ে যায়। ছবিতে শাবানা পতিপরায়ণা, ধার্মিক, রক্ষণশীল বাঙালি নারী।শাবানা ভীষণভাবে স্বামী অনুরক্তা, অথচ কিছুদিন পরই প্রেমিক স্বামীটি হয়ে ওঠে বহুগামী। বিয়ের আগে শাবানা ছিলেন প্রেমিকা, বিয়ের পর সেবিকা। স্বামীর পরকীয়া, বহুগামিতা সকল কিছু জানার পরও তিনি স্বামীকে ছেড়ে যান না। কোনোদিন যাবেনও না- এই মন্ত্রে দীক্ষিত। মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন, স্বামী আঁকড়ে ধরে রাখেন। সংসারের টানে, স্বামীর টানে। বাঙালি নারীদের যা হয়!অন্যদিকে স্বামীর আকর্ষণ পরনারীতে। স্বামী চরিত্রে ‘আলমগীর’ কিংবা ‘জসিম’ যেই হন- তিনি পার্টিতে যান, মদ খান, লাম্পট্য করেন অন্য নারীদের নিয়ে। মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন মদ্যপ স্বামী, বাড়ি ফিরে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন। শাবানা কাঁদেন, তবে গোপনে। কেউ যেন না দেখে, না জানে। পতিভক্তির চরম পরীক্ষা চলে পর্দায়। যে রাতে শাবানার মদ্যপ, লম্পট স্বামীটি তাকে চড় মারেন, গায়ে হাত তোলেন, সে রাতে স্বামীর জন্য, শাবানা আরও বেশি করে প্রার্থনা করেন। সেই রাতটি পরীক্ষার চরম রাত! সকল নির্যাতন শেষে ঘুমন্ত স্বামীর পায়ের কাছে শাবানা কাঁদেন, কিন্তু শব্দ করেন না। কখনও কখনও ঝড়ের রাতে জীবনের সকল ঝড় উপেক্ষা করে শাবানা রাতেই ছুটেন মাজারে, স্বামীর জন্য দোয়া করেন, মানত করেন। দর্শকরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে সমর্থন করেন।যে নারীরা তার স্বামীর সঙ্গে প্রেমলীলায় মাতেন, তারা ‘নষ্ট মেয়ে’ এমনটি শাবানা নিজেও মনে করেন, অথচ স্বামীটি কিন্তু নষ্ট হয় না হাজার নারীর প্রেমে! পর্দার স্বামীটি অর্থসম্পদ, সম্মান সব খুইয়ে একসময় অন্য মেয়েদের ‘বেশ্যা-নটি-ছিনাল’ গাল দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফেরেন। শাবানা ‘সতী নারীর পতি’ পরীক্ষায় একশতে একশ পেয়ে পাস করেন। শাবানা সব ভুলে যান। ভুলে যান সমস্ত অতীত। অপমানিত হওয়া, অসম্মানিত হওয়া- সব। প্রাণের স্বামীর বুকে কিংবা পায়ের কাছে মাথা রেখে কাঁদেন।পরের দৃশ্য আরও ভয়ঙ্কর। পরক্ষণেই শাবানা হাসেন, নাচেন, গান গেয়ে স্বামীর মনোরঞ্জন করেন। দৃশ্যটি দর্শকদের যারপরনাই আনন্দ দেয়। পুলক বোধ করেন পুরুষ দর্শকরা।মুহুর্মুহু করতালি। বাহ! শাবানা নাহ!এই না হলে বাংলার নারী!আসলে শাবানা একটি প্রতীক। অবদমিত, নির্যাতিত, নিগৃহীত স্ত্রীদের প্রতিনিধি তিনি। শাবানাদের নিজের বলে কিছু নেই। নিজস্ব বলে থাকতে নেই কিছু- শুধু স্বামী ছাড়া। শাবানা অভিনীত ছবিগুলোকে চিরকালই বলা হয়েছে ‘সামাজিক ছবি’। কিন্তু এসব সামাজিক ছবিতে নারীর প্রতি, দিনে পর দিন অসামাজিক রকমের যে নিপীড়ন, নির্যাতন দেখানো হয়েছে, তা কেউ বলেনি। কেউ বলেনি এই দৃশ্যের পরিবর্তন হোক। পরিবর্তন চাই। পুরুষরা শাবানার এই চরিত্রটিকে ভালোবাসেন। আদর্শ নারী চরিত্র বলে মনে করেন। স্ত্রীদের ছবিঘরে নিয়ে আসেন দেখতে, দেখাতে শাবানার আদর্শ শিখাতে। কেননা, শাবানারা মার খায়, মুখ বুজে শব্দ করে না। প্রেম দেয়, শরীর দেয়- মনপ্রাণ দিয়ে। প্রার্থনা করে, জীবন দিয়ে- পুরুষের জন্য!লেখক : উপসম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম যুক্তরাষ্ট্র।এইচআর/পিআর
Advertisement