আমাদের সবচেয়ে বড় গৌরবের কাল মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর। আমরা এই নয় মাসে নিজেদের সাহসের, শৌর্যের, একতার পরিচয় দিতে পেরেছি। বাঙালি যে কেবলমাত্র প্রতিবেশীর সঙ্গে জমিজমা নিয়ে মামলা লড়ে না বরং অস্ত্র হাতে নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে এর প্রমাণ আমরা একাত্তরে দিয়েছি।
Advertisement
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জনযুদ্ধ। যে যুদ্ধে নারী পুরুষ সকলেই অংশ নিয়েছে। কিন্তু বিজয়ের পর যুদ্ধটি পরিণত হয় পুরুষের যুদ্ধে, পুরুষের বীরগাথায়। নারীর যুদ্ধ, নারীর আত্মত্যাগ, নারীর বীরত্ব রয়ে যায় চোখের আড়ালে। বলা যায়, নারীর যুদ্ধটাকে অনেকাংশেই লুকিয়ে ফেলা হয়। যেন এটা লজ্জার।
যুদ্ধে নারীর ত্যাগ, ভূমিকা, বীরত্ব সবকিছুকে আড়াল করার প্রথম ধাপ শুরু হয় নারীকে ‘ইজ্জত হারানো, সম্ভ্রম হারানো’ বলার মধ্য দিয়ে। বলা শুরু হয়, দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে, সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কি সুচতুর কৌশল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের দুই থেকে চার লক্ষ নারী ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হন। ধর্ষণ ও ভয়াবহ নির্যাতনকে ‘ইজ্জত হারানো’, ‘সম্ভ্রম হারানো’ বলার মানে কি?
ধর্ষণের শিকার হওয়া মানে কোনোভাবেই ‘সম্ভ্রম হারানো’ নয়। সম্ভ্রম, ইজ্জত, সম্মান কোনোটাই নারীর প্রজনন অংগে অবস্থান করে না। ৭১ এ প্রকৃতপক্ষে সম্ভ্রম হারিয়েছে, বেইজ্জত হয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পুরো বিশ্বের সামনে তারা যুদ্ধাপরাধী, ধর্ষক, বর্বর হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে যে নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তারা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। তারা যে নির্মম নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন সেকথাটি স্পষ্টভাষায় সঠিক শব্দে বলতে হবে। ‘সম্ভ্রমহারানো’ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে পাকিস্তানি ও রাজাকারদের অপরাধকে নরম ও লঘু করার কোনো প্রয়োজন নেই। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশের দুই থেকে চার লাখ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন একথা স্পষ্টভাষায় উল্লেখ করে এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত সম্মান দিতে হবে।
Advertisement
বাংলাদেশের যুদ্ধাহত এই নারীরা যে যুদ্ধের সময় কতটা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সেকথা মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে রয়েছে। ড. নীলিমা ইব্রাহীমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইতেও রয়েছে। যুদ্ধের সময় পুরুষ মুক্তিযোদ্ধারাও অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নারী পুরুষ অনেকেই শহীদ হয়েছেন। যে পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা আহত অবস্থায় বাড়ি ফিরতে পেরেছেন তারা স্বাধীনতার পরে সম্মানিত হয়েছেন। অনেকে খেতাব শিরোপা না পেলেও অন্তত সামাজিকভাবে হেয় হননি। কিন্তু যে নারীরা বন্দী শিবির থেকে ফিরেছেন তাদের অনেকেই আর পরিবারে স্থান পাননি। তাদের যেতে হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রে, বিদেশে। এমনকি অনেককে যৌনকর্মীর পেশাও বেছে নিতে হয়েছে। এই নারীদের সন্ধান করে তাদের সম্মানিত করার সময় কি এখনও হয়নি?
পিরোজপুরের শহীদ ভাগিরথীর কথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে রয়েছে। ভাগীরথী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। ধরা পড়ার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ভয়াবহ নির্যাতনের পর হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাগিরথী কোনো পদক, সম্মান কিছুই পাননি। তাকে কোনো মরণোত্তর সম্মানও দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের এত এত বীর প্রতীক, বীর বিক্রম পদক। অথচ এদের মধ্যে কয়জন নারী আছেন? মাত্র দুইজন বীরত্বব্যঞ্জক পদকধারী নারী আছেন বাংলাদেশে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের উল্লেখেও শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন এবং শহীদ কবি মেহেরুন্নিসার নাম খুব বেশি উচ্চারিত হয় না। তাদের বীরত্ব, আত্মত্যাগের বিবরণ আমরা জানতে পারি না তেমনভাবে। বাংলাদেশে অস্ত্রহাতে যুদ্ধকরা নারীও অনেকেই ছিলেন। আরও ছিলেন গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম প্রধান অংশ তথ্য আদান প্রদান, অস্ত্র বহন, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দানের কাজে। এদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কি কোনো স্বীকৃতি নেই?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি মর্মান্তিক অধ্যায় যুদ্ধশিশু। যুদ্ধশিশুদের অনেকে বিদেশে বিভিন্ন পরিবারে আশ্রয় পেয়েছিলেন। অনেকে সমাজের ব্যঙ্গবিদ্রুপ সহ্য করে, মাসহ একঘরে হয়ে টিকে ছিলেন বাংলাদেশে। অনেকে জনারণ্যে মুখ লুকিয়ে অন্য পরিচয়ে কোনোভাবে জীবন ধারণ করেছেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা শবনম ফেরদৌসীর জন্মসাথী চলচ্চিত্রটিতে যুদ্ধশিশুর প্রসঙ্গ এসেছে।
Advertisement
যুদ্ধশিশুদের পরিচয় আজও সামনে আনার সময় হয়নি কি? স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। এখনও কি সময় হয়নি যুদ্ধশিশুদের স্বীকৃতি দিয়ে তাদের জন্মদাত্রীদের এদেশের বীরকন্যার মর্যাদা দেয়ার?
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অনেক অকথিত অধ্যায় রয়েছে। এই অধ্যায়গুলো উন্মোচনের সময় এসেছে এখন। পঁচিশে মার্চের হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষণা করা, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের জন্য, মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার নারীদের যথাযথ সম্মান দান এখন সময়ের দাবি। আমরা জাতি হিসেবে যে সভ্য এবং মানবিক হয়েছি তার পরিচয় দেয়ার জন্যই যুদ্ধাহত নারী ও যুদ্ধশিশুদের সামাজিক সম্মান দানের বিষয়টি জরুরি।
আরো একটি কথা। সাড়ম্বরে স্বাধীনতা দিবসের উদযাপন করলেই স্বাধীনতা নিশ্চিত হয় না। এদেশে নারী ও শিশুসহ সকল মানুষের নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারলেই অর্থবহ হবে আমাদের স্বাধীনতা। যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন স্বাধীনতা শব্দটি দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পরিপূর্ণ সুখের অনুভূতি এনে দিতে পারবে না।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমএস