সরকারি কর্মচারীদের ‘স্যার’ সম্বোধন শোনার আকুতি ভারতীয় উপমহাদেশেই প্রবল। ‘জো হুকুম জাহাপনা’ বলতে বলতে আমরা স্যার বলা শুরু করেছি। বলাই বাহুল্য ঔপনিবেশিক শাসন আমলে ব্রিটিশরা আমাদের স্যার বলা শিখিয়েছে। ব্রিটিশরা এদেশ ছেড়ে গেছে ৭৬ বছর আগে। পিছন ফেলে গেছে স্যার সম্ভাষণের মধু। এখন ব্রিটিশ মুল্লুক থেকে স্যার সম্বোধন উঠে গেছে। এখন কেউ নাইটহুড (Knighthood) উপাধি পেলেই কেবল তাকে স্যার ডাকা হয়। বরং উল্টো ব্রিটিশ মুল্লুকে সরকারি চাকরিজীবীরা সেবাপ্রার্থীকে স্যার সম্বোধন করেন।
Advertisement
আর্মি-পুলিশ-প্রশাসন-বিচারক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নানা সেবাখাতের কর্মচারীরা জনগণের সেবা করার জন্য জনগণের উপার্জিত অর্থ থেকেই বেতন-ভাতা পায়। অথচ সরকারি পেশাজীবীরা জনগণের সঙ্গে ‘প্রভু’র মতো আচরণ করে।
বিষয়টি খুবই আইরনিক্যাল; যাদের ট্যাক্সের টাকায় আমার বেতন হয়; আমি তার মাথার ওপর ছড়ি ঘুরাই। এরকম একটি অবাস্তব ঘটনাই যুগের পর যুগ ঘটে চলেছে কোনো প্রতিবিধান ছাড়াই। যার নিয়োগ হচ্ছে জনস্বার্থে; সে যুগের পর যুগ জনস্বার্থবিরোধী সম্বোধন শুনতে পছন্দ করছে; এ এক অচিন্তনীয় বাস্তবতা।
সরকারি সেবাখাতে নিশ্চিতভাবে অনেক ইতিবাচক সেবক মননের মানুষ কাজ করেন; কিন্তু নেতিবাচক শাসক মননের লোকেরা সংখ্যায় এত বেশি ও তাদের সদর্প বিচরণ এত বেশি দৃশ্যমান; যে জনপ্রশাসনের সমালোচনা করতে গিয়ে অল্পসংখ্যক ইতিবাচক-সেবক মননের মানুষদের প্রতি অনেকটা অবিচার করা হয়। তবে জনপ্রশাসনের ভেতরে বসে তারা নিজেরাও নেতিবাচক শাসক মনোবৃত্তির আদিম লোকেদের সতত ঈর্ষা ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার; এটাও নিশ্চিত।
Advertisement
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, গোটা পৃথিবীতে একমাত্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকারি চাকুরে বা সেবকদের সেবার মান খারাপ। উপমহাদেশে যে ব্রিটিশরা এই জনপ্রশাসনের ধারণা প্রবর্তন করেছিল; সেই খোদ ব্রিটেনেই সরকারি চাকুরে বা সেবকদের মনোভঙ্গি একেবারেই বদলে গেছে। যে ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের লোকেরা আদিম যুগে প্রত্যাশা করতো, জনগণ তাদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলবে; সেই ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের সদস্যরাই এখন জনগণকে ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ বলে।
অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সিভিল সার্ভেন্ট বা জনসেবকরা রয়ে গেছে আদিমযুগে। তারা একবিংশ শতকের আধুনিক পৃথিবীতে বসে এখনো প্রত্যাশা করে, জনগণ তাদের ‘স্যার’ বলবে। এতো গেলো কেবল সম্বোধনের দিক; কিন্তু এই সম্বোধনের মনস্তত্ত্বের মাঝেই যে আদিম ‘প্রভু’ দৃশ্যমান; কাজের ক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত আরও ভয়াবহ আত্মম্ভরিতায়।
কোনো কোনো পেশায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখানো হয় তোমাদের অন্যরা স্যার বলবে, তোমরা ভুলেও কাউকে স্যার বলবে না। যেন অন্য কাউকে স্যার সম্ভাষণ করলেই তাদের ঐতিহাসিক মহাপতন হয়! এভাবে তীব্র রেষারেষিময় একটি অসুস্থ আত্মম্ভরিতার চর্চা চলছে ক্ষমতা কেন্দ্রের কাছাকাছি থাকা সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে।
আত্মম্ভরিতার অসুস্থ সংস্কৃতি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে প্রকটভাবে দৃশ্যমান হওয়ার কারণ; সমাজের সুষম বিকাশ না ঘটা। সামন্ত বা জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইটি সামন্ত বা জমিদার সমাজের অংশ হওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতায় পরিণত হওয়ায় সমাজ মনোজগতে আধুনিক সাম্যভাবনা বিকশিত হয়নি একেবারেই। কেউ দরিদ্র অবস্থা থেকে সচ্ছল অবস্থায় গেলে আর হাতে সামান্য ক্ষমতা পেলেই দরিদ্র শ্রেণির নিপীড়কে পরিণত হচ্ছে নিয়মিতভাবে। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি সমানুভূতির বোধ অর্জিত হচ্ছে না একেবারেই।
Advertisement
নানা পেশা ও সেবার মানুষের মধ্যে একমাত্র রাজনীতিকরাই অল্প বিস্তর জনগণের সমালোচনা নিতে পারেন। অন্য পেশাজীবী ও সেবাগোত্রের মানুষ বিন্দুমাত্র সমালোচনা নিতে পারেন না; সমালোচনার কারণ বুঝতে পারেন না; বরং ক্ষিপ্ত হন। এদের পেশানুভূতি ধর্মীয় অনুভূতির মতোই কট্টর। ফলে তাদের উত্তরণের সম্ভাবনা আশংকাজনকভাবে কমতে থাকে।
গণকর্মচারীরা জনগণকে কী বলে সম্বোধন করবেন, সে বিষয়ে এখন ভাবার সময় এসেছে। উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্রে সেবা নিতে যাওয়া নাগরিকরা সরকারি কর্মচারীদের নাম ধরে সম্বোধন করেন। বাংলাদেশেও এখন সরকারি কর্মচারী আইন সংশোধন করে সেখানে ‘সম্বোধন’ নামে একটি নতুন ধারা যুক্ত করা দরকার, যেখানে স্পষ্ট বলা থাকবে, ‘সেবাগ্রহীতা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীগণের নাম উচ্চারণ করিয়া সম্বোধন করিতে পারিবেন।’ এই বিধান করা হলেই কেবল গণকর্মচারীদের স্যার সম্বোধন শোনার আকাঙ্ক্ষা দূর হবে।
লেখক: সরকারি কর্মকর্তা।
এইচআর/এএসএম