মতামত

অর্থনৈতিক কূটনীতি এগিয়ে নিতে হবে

বর্তমানে বিশ্বে ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) রয়েছে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এলডিসি ক্যাটাগরিতে দেশগুলোকে শ্রেণিবদ্ধ করার ধারণাটি আসে। আয়, মানবসম্পদ, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দুর্বলতার পরিস্থিতি জাতিসংঘের সংস্থা দ্বারা মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়, যাতে এলডিসি হিসাবে সংঘায়িত করা যায়। এলডিসিভুক্ত দেশগুলো বাণিজ্য ও উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে একচেটিয়া আন্তর্জাতিক সহায়তা ব্যবস্থা (ISMs) পাওয়ার অধিকারী। শেষ পর্যন্ত, জাতিসংঘের সংস্থা এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) এলডিসিগুলোকে অর্থনৈতিক দুর্বলতা থেকে বের আনতে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করে।

Advertisement

সহায়তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে এলডিসিদের কাছে পণ্য ও পরিষেবার জন্য অগ্রাধিকারমূলক বাজার প্রবেশাধিকার ব্যাপকভাবে প্রদান করা হয়। এছাড়াও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষ আচরণ এবং ডব্লিউটিওর নিয়মের অধীনে এলডিসিগুলোকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হয়। স্বল্পোন্নত দেশগুলো জিএসপি, শুল্কমুক্ত এবং কোটামুক্ত বাজার সুবিধা, আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিতে (আরটিএ) বিশেষ বাজার সুবিধা এবং ডব্লিউটিওর মেধা সম্পত্তির বাণিজ্য-সম্পর্কিত TRIPS চুক্তির অধীনে নমনীয়তার সুবিধা গ্রহণ করে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) সুবিধার আওতায় এসেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশও অন্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে ইবিএ সুবিধাভোগী। মূলত, জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস (জিএসপি), ইবিএ, জিএসপি প্লাস, জিএসপি স্ট্যান্ডার্ড সুবিধা প্রদান করা হয় এই তিনটি সুবিধা ভোগ করার যোগ্য হওয়ার মানদণ্ডের ভিত্তিতে মূল্যায়নের ভিত্তিতে।

বাংলাদেশ এখন দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত এবং একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের সাথে নেপাল ও লাওস এবং উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নিজেদের যোগ্যতা অর্জন করেছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত হওয়ার মানদণ্ড ‘উন্নয়ন নীতি কমিটি’ দ্বারা সমালোচনামূলকভাবে পর্যালোচনা করা হয়। পরে জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল (ইসিওএসওসি) সিডিপির দাখিল করা প্রতিবেদন যাচাই করে।

Advertisement

এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ যে পর্যালোচনার কাজ প্রতি তিন বছর পর পর করা হয়। সিডিপির সুপারিশ অনুযায়ী কোনো দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে সংশ্লিষ্ট দেশকে ডব্লিউটিও কর্তৃক প্রদত্ত বাণিজ্য সুবিধা সংক্রান্ত অনেক কিছু হারাতে হয়। অন্যদের মতো, বাংলাদেশও এলডিসি পরবর্তী ডব্লিউটিও প্রদত্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। ২০২৬ থেকে বাংলাদেশকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

২৫০টিরও বেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি রয়েছে, যারা WTO দ্বারা প্রদত্ত বাণিজ্য-সম্পর্কিত দিকগুলোর মেধাস্বত্ব অধিকার (TRIPS) সুবিধা পাচ্ছে। একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল রপ্তানি ২৬৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০০৯ সালের ৪৫.৭ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৬৯ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এই খাতে মেধাস্বত্ব অধিকার (আইপিআর) থাকার কারণে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি এসেছে।

এলডিসিদের জন্য আইপিআর সুবিধা ২০৩৩ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ২০২৬ সালে এলডিসি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ আর আইপিআর সুবিধা পাবে না। তবুও আশার কথা হচ্ছে ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য রপ্তানিতে এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বোচ্চ (প্রায় ৫৫.৪ শতাংশ)। যদিও বাংলাদেশ এখন যে জিএসপি সুবিধা গ্রহণ করেছে তা WTO নিয়ম অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়ে যাবে।

এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ সবার কাছেই পরিচিত। বাংলাদেশের সরকার প্রধান চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন। এখন বাংলাদেশ সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চিন্তাভাবনার পাশাপাশি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছে। সম্প্রতি, কাতারের দোহায় পঞ্চম জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশ সম্মেলন (এলডিসি ৫) শেষ হয়। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি এবং জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনে যোগ দেন।

Advertisement

সম্মেলনটি অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থে কাজ করে। স্বল্পোন্নত দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের দৌড়ে রয়েছে। এসডিজি সংক্রান্ত লক্ষ্য পূরণে উন্নয়ন সহযোগীদের সহযোগিতা প্রয়োজন। এগিয়ে যাওয়ার জন্য বৈশ্বিক অংশীদারত্বের খুব বেশি প্রয়োজন। টেকসই উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে LDC-৫ সম্মেলন হলো এক দশকের মধ্যে একবারের একটি সুযোগ। সম্মেলনটি স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে আগামী দিনে সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হতে সাহায্য করবে।

এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জের কথা স্মরণ করিয়ে প্রধানমন্ত্রী সবাইকে একত্রে কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান। এসময় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ‘গ্র্যাজুয়েটিং কোহর্টের জন্য টেকসই এবং মসৃণ রূপান্তর’, ‘বেঙ্গল টাইগারের উত্থান: বাংলাদেশে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা’, ‘স্মার্ট এবং উদ্ভাবনী সমাজের জন্য এলডিসিতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ’, ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও আঞ্চলিক একীকরণে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অংশগ্রহণ’, ‘মসৃণ ও টেকসই গ্র্যাজুয়েশনের জন্য গ্লোবাল পার্টনারশিপ: মার্চিং টু স্মার্ট বাংলাদেশ’ এবং আঞ্চলিক দূত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ এবং বিদ্যমান সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার পাশাপাশি দূরকরণে পাঁচটি সহায়তা চেয়েছিলেন। এগুলো হলো- ১. জলবায়ু পদক্ষেপসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রভাবশালী প্রযুক্তি স্থানান্তরের জন্য আন্তর্জাতিক বেসরকারি খাতকে উপযুক্ত প্রণোদনা প্রদান করা, ২. ব্রডব্যান্ড বিভাজন এবং এলডিসিগুলোতে প্রযুক্তিগত বৈষম্য কমাতে ডিজিটাল অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করা, ৩. এলডিসি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য গবেষণা, গবেষক এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।

৪. এলডিসি উত্তরণের পরেও TRIPS চুক্তির সুবিধার ধারাবাহিকতা, বিশেষত ফার্মাসিউটিক্যালস এবং এগ্রোকেমিক্যাল খাতের জন্য, ৫. উদ্ভাবন এবং উন্নয়ন উভয়ের জন্য সহায়ক একটি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি ব্যবস্থার বিকাশে সহায়তা। ‘স্মার্ট অ্যান্ড ইনোভেটিভ সোস্যাইটিগুলোর জন্য এলডিসিতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ’ শীর্ষক কর্মসূচিতে এই পাঁচটি মূল সহায়তার দাবি করা হয়েছিল।

বিশ্বে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর বাণিজ্য অংশীদারত্বের কথা বিবেচনা করে, উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যে বাড়ানোর জন্য মুক্ত এবং অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তিতে ফোকাস দেওয়া উচিত, যা বর্তমানে এখনও কম (১ শতাংশ)। করোনাভাইরাস মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি সামনের দিনগুলোতে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে পারে। দেশটি এলডিসি উত্তরণ-সম্পর্কিত সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সাথে সাথে এসডিজি অর্জনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। বৈশ্বিক পর্যায়ে সহযোগিতা নিশ্চিত করা হলে চাপ অনেকটা দূর হবে।

বাণিজ্য-সম্পর্কিত জটিলতাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে FTA/PTA/RTA স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তা এখন একটি চাহিদা। অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে এসব চুক্তি সম্ভব নিশ্চিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করার ওপর জোর দেন, যা বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে সহজ শর্তে চুক্তি করতে সাহায্য করবে। এলডিসি ৫ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে TRIPS ছাড় এবং অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা ছিল মূল দাবি। এই দুটি বিষয় নিশ্চিত হলে বাংলাদেশ সব ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট সময় পাবে।

লেখক: গবেষক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম