মতামত

ফলস অ্যালার্ম ও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ মহড়া

বসন্তের ‘হানামি’ বা চেরীফুল ফোটার মৌসুমে ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেশ মজা করা হয়েছিল। রাতে আরেক অনুষ্ঠানে যেতে হবে। সারাদিন লম্বা ড্রাইভ করে চেরী বাগান ঘুরে বহু দূরের ওপেন লেকে মাছ ধরে সবাই ক্লান্ত। মাছের বারবিকিউ রাতের খাবারের একটি মেন্যু। কিন্তু বাইরে হঠাৎ ঝির ঝির বৃষ্টি ও ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলে ক্যাম্পাসের চেরীতলার স্পট পরিত্যাগ করে সবাই আমাদের ডর্মের দ্বিতীয় তলার হলঘরে গিয়ে উঠলাম। সেখানে ফ্রি চুলায় রান্নাসহ সব ব্যবস্থা ছিল।

Advertisement

সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে রান্না-বান্নার কাজে মনোযোগ দিয়েছিল। বিদেশের ওসব পার্টিতে কারও বাবুগিরি করা চলে না। সবাই খুশিমনে সব কাজে অংশ নেওয়ার নিয়ম। রান্না শেষে খাবার সাজানো হয়েছে। এমন সময় ডর্মের ‘ফায়ার অ্যালার্ম’ বেজে উঠলো। বেশ কর্কশ স্বরে একবার, দুবার নয়- তিনবার বাজতে লাগলো। উপরের তলায় কোথাও আগুন লেগেছে এই ভেবে সবাই দ্রুত হলঘর থেকে বের হয়ে বাইরের পার্কিং লটে চলে গিয়েছিলাম।

সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ পর জানা গেলো আমাদের ভবনে আগুন লাগেনি। আমাদের মাছ বারবিকিউ করার চারকোলের অতিরিক্ত ধোঁয়ায় একজস্টর চালু করে না দেওয়ায় বদ্ধ কিচেনের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন আগুনের ধোঁয়া আঁচ করে গোটা ভবনে জরুরি অ্যালার্ম বাজিয়ে সবাইকে আগুনের সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছে। সবাই জরুরি নির্গমন পথ অনুসরণ করে নিরাপদে নিচে চলে গেছে।

তখন মনে হয়েছিল- কত সেনসেটিভ ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন! একটু বেশিমাত্রার ধোঁয়ার সন্ধান পেলে আর রক্ষা নেই। সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। এই মেশিন জাপানের সব ভবনের সব ঘরেই লাগানো থাকে। শুধু দাউ দাউ আগুন নয়, ধোঁয়ার সূত্রপাত হলেই সেগুলো বেজে উঠে সবাইকে সতর্ক করে দেয়, যা হোক, যারা ওই বছর নতুন গিয়েছিল আমাদের ক্যাম্পাসে তারা অ্যালার্ম শুনে অনেকটা ভয় পেয়েছিল। আমরা যারা পুরোনো বাসিন্দা ছিলাম তারা এরকম ফায়ার অ্যালার্ম অনেকবার শুনেছি। যেগুলো ছিল সতর্কতামূলক মহড়া মাত্র। পরে সে রাতে আমাদের পার্টি ঠিকমতোই শেষ হয়েছিল।

Advertisement

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গুলশানের একটি আধুনিক বহুতল আবাসিক ভবনের ৭ম তলায় আগুনের সূত্রপাত। সে আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে গেলে ১২ তলা থেকে দুজন লাফিয়ে নিচে পড়লে মারা যান। ওই অগ্নিকাণ্ডে শিশুসহ ২২ জন আহত হন। জানা গেছে, সেই ভবনটিতে আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল। জরুরি নির্গমন পথ ছিল। ‘ফায়ার অ্যালার্ম’ দেওয়ার মতো ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন প্রতিটি ফ্লোরে লাগানো ছিল। তবে অনেকে ফায়ার অ্যালার্ম শোনেননি।

যারা শুনেছিলেন তারা ভেবেছে সেটা ছিল ‘ফলস্ ফায়ার অ্যালার্ম’! অথবা রাস্তা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স জরুরি অ্যালার্ম বাজিয়ে সব সময় যাতায়াত করে। সেরকম কিছু একটার শব্দ হতে পারে। তাই তারা অ্যালার্মের গা করেননি। আর এরকম একটি আধুনিক ভবন যেখানে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে অগ্নিকাণ্ডের সময় বাইরে না বেরিয়ে ঘরের ভিতর বসে থাকাই ভালো! অর্থাৎ, আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগানো হলেও সেগুলোর ব্যবহার বিধি সম্পর্কে সচেতনতামূলক জ্ঞান তাদের সবার মধ্যে ছিল না। তাই তো একজন বাবুর্চি ও একজন গৃহকর্মী জরুরি নির্গমন পথ দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা না করে আতঙ্কে ১২ তলার বেলকুনি থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন।

আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ডের প্রতি মানুষের ভয় বেড়েছে। কিন্তু সচেতনতা বাড়েনি। পুরোনো বড় বড় ভবনে এত আধুনিকমানের ফায়ার ‘ফায়ার অ্যালার্ম’ দেওয়ার মতো যন্ত্রপাতি বসানো না হলেও অধুনা এ ব্যাপারে সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ, বিল্ডিং কোডের মধ্যে ‘ফায়ার অ্যালার্ম’ দেওয়ার প্রয়োজনীয় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা রাখার আইনি বিধান রয়েছে। এটা অমান্য করলে ভবন মালিকের শাস্তি অবধারিত। তবে বিল্ডিং কোডের এথিকস্ মেনে আংশিক কাজ করে পুরো কাজের জন্য সনদ তুলে নিয়ে ঘরে রাখলেই মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো কঠিন। তাই আন্তরিকতার সাথে প্রতিটি ভবনে বিল্ডিং কোডের এথিকস শতভাগ মেনে আধুনিক ফায়ার নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু রাখা প্রয়োজন।

পাশাপাশি অ্যালার্ম বাজলো আর আমি শুনেও ঘুমিয়ে থাকলাম সেটা করা হলে বিপদ অনিবার্য। অনেক অলস ব্যক্তি জরুরি কাজের জন্য ঘড়িতে জেগে ওঠার সময় অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। অ্যালার্ম ঠিকসময় বেজে উঠলে রাগ করে ঘড়ি থাপ্পড় দিয়ে অ্যালার্ম বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে যেতে দেখা যায়। এর পরিণতি সম্পর্কে তারা মোটেও ভাবেন না। এমন বদ অভ্যাস থাকলে ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে না ঘুমানোই শ্রেয়।

Advertisement

যেটা ঘটতে শোনা গেছে গুলশানের বাড়ির বাসিন্দাদের মুখ থেকে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের জরুরি ফায়ার অ্যালার্ম শুনেছেন কিন্তু সেটাকে তারা ‘ফলস অ্যালার্ম’ভেবেছেন। তাই ভবনের বাইরে যেতে চাননি। এরকম বিপদের সময় এটা শুধু নিতান্ত অবহেলাই নয়- চরম হেঁয়ালিপনার নামান্তর। এরকম হেঁয়ালিপনা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। তাই এ অবস্থা নিরসনের জন্য প্রয়োজন ঘন ঘন সতর্কতামূলক মহড়ার আয়োজন করা। আমাদের দেশে যে হারে সুউচ্চ ভবন তৈরি হচ্ছে এবং যেভাবে মানুষ বহুতল ভবনে বসবাস করতে আগ্রহী হয়ে পড়েছে সেই হারে ফায়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিকশিত হয়নি।

আজকাল বহুতল ভবনে ফায়ার প্রতিরোধী স্প্রে, ফায়ার প্রতিরোধী গ্যাস সিলিন্ডার, পানির পাইপ, মুখোশ, পোশাক ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। অনেক অফিসের বিভিন্ন তলার কোণায় কোণায় এসব নিরাপত্তা সরঞ্জাম সাজানো থাকে। কিন্তু কথা হলো সেগুলো শুধু সাজিয়ে রাখার জিনিস নয়। কারণ, মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে বা বেশি পুরোনো হয়ে গেলে সেগুলো অকার্যকরী হয়ে পড়ে।

সেজন্য প্রতি তিন বা ছয় মাস পর পর সেসব জিনিস ব্যবহার উপযোগী আছে কি না তা পরীক্ষার জন্য জরুরি মহড়ার আয়োজন করা উচিত। বিপদের সময় সেগুলো ঠিকমতো সেবা দেয় না। আবার অনেকেই সেসব নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবহার করতে জানেন না। এসব জিনিসের মেয়াদ পার হলে সেগুলো ফেলে দিয়ে নতুন নিরাপত্তা কিট্স কেনা উচিত।

এজন্য প্রতিটি ভবনে অফিসে, কারখানায় বাধ্যতামূলক বাজেট রাখার নির্দেশনা বস্তবায়ন করা উচিত। উঁচু অফিস, হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বসতঘরের প্রতিটি কক্ষে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ মেশিন লাগানো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। যারা একটু ধোঁয়া পেলেই জরুরি সংকেত দেবে। এছাড়া হাসপাতাল, তেলের ডিপো, পাম্প, গুদাম, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার এমনকি পল্লী অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত অগ্নিনির্বাপণ মহড়া গ্রহণ করে মানুষকে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা থেকে সচেতন করার পদক্ষেপ হাতে নেওয়া উচিত। সেসব মহড়ায় বাড়ির বা অফিসের ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণ আবশ্যিক করা উচিত। কারণ প্রশিক্ষণ নেওয়া থাকলে বিপদের সময় একটি শিশুও অনেক মূল্যবান জানমাল রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

আমাদের দেশে প্রতিটি বিপর্যয় ঘটে যাওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, বোর্ডসভা করা হয়। কিন্তু যেসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেগুলো নিয়ে পূর্বপরিকল্পনামাফিক দায়িত্ব পালন বা কাজ সুসম্পন্ন করা হয় কি না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাই প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা বাড়ানো এবং অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে অগ্নিকাণ্ডের প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে ও পুরোনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরখ করতে ঘন ঘন অগ্নিনির্বাপণ মহড়ার আয়োজন করা খুব জরুরি।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/ফারুক/এএসএম