দেশজুড়ে

মজুরি কম, ঈদেও নেই বোনাস

সিরাজগঞ্জের মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস তাঁতশিল্প। তবে যন্ত্রের প্রভাবে এ শিল্প এখন অনেকটা রুগণ। অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও দুর্গতিতে ধুঁকে ধুঁকে দিনযাপন করছেন এ শিল্প সংশ্লিষ্টরা।

Advertisement

তাঁতশিল্পীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করছেন। কিন্তু কাপড় বিক্রি করে পরিবারে সচ্ছলতা ফেরানোর আশা করলেও সেটা পূরণ হচ্ছে না। এক সময় তাঁত চালানোর খটখট শব্দ আর ব্যাপারীদের আনাগোনায় মুখর থাকতো সিরাজগঞ্জের তাঁতপল্লি। কালের বিবর্তনে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। এখন আর তাঁতি বা জোলাপাড়ার সেই সুদিন নেই। ফলে অনেকেই পরিবর্তন করছেন পৈতৃক এ পেশা।

মঙ্গলবার (২১ মার্চ) তাঁতপ্রধান বেলকুচি ঘুরে দেখা যায়, তাঁতিদের টুংটাং শব্দের দাপট আর আগের মতো নেই। এক সময় এখানকার তৈরি তাঁতবস্ত্রের সুনাম শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরেও ছিল। অথচ দিন যতই যাচ্ছে ততই এ পেশা হুমকির মুখে পড়ছে। নদীভাঙন, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ সমস্যা, স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, তাঁত যন্ত্রাংশ, সুতা ও রং-রাসায়নিকের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং সময়মতো ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় দেউলিয়া হওয়াসহ নানাবিধ কারণে তাঁতশিল্প আজ অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।

আরও পড়ুন: তাঁত কারখানা এখন গোয়ালঘর!

Advertisement

বেলকুচির চালা অফিসপাড়ায় কথা হয় ৫০টি তাঁতের মালিক হাজি তৈয়বার আলীর সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে জানান, এ শিল্পে আর সুদিন নেই। সুতা, রং ও যন্ত্রাংশের দাম এবং শ্রমিক মজুরি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় এ পেশা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া একটি ভালো মানের শাড়ি তৈরি করে নামমাত্র লাভে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায় বিক্রি করতে হয়। দেশের স্বনামধন্য কোম্পানিগুলো ওই শাড়ি কিনে তাদের লেভেল সাঁটিয়ে বাজারে বিক্রি করে কয়েকগুণ লাভে।

তাঁত শুমারি ২০০৩ অনুযায়ী সিরাজগঞ্জে তাঁতি পরিবারের সংখ্যা মোট ১৪ হাজার ৮৭০ এবং তাঁত সংখ্যা প্রায় এক লাখ ৩৫ হাজারের অধিক। প্রতি বছর এ জেলায় হস্তচালিত তাঁত থেকে প্রায় ২৩ কোটি মিটার বস্ত্র উৎপাদিত হয়।

কামারখন্দ উপজেলার চর দোগাছী গ্রামের তাঁত শ্রমিক শফিকুল ইসলাম ও মোহাম্মদ আলী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের মজুরি কম, ঈদ উপলক্ষেও কোনো বোনাস নেই। কাজ করলে মালিকরা টাকা দেন, না করলে দেন না। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালো নেই। কোনো রকমে বেঁচে আছি।

আরও পড়ুন: মুখ থুবড়ে পড়েছে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্প

Advertisement

তারা বলেন, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করি। তাছাড়া রমজান মাসও এসে গেছে, খরচ একটু বেশি হবে। তাই একটু বেশিই পরিশ্রম করছি।

একই গ্রামের আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, পৈতৃক পেশা হিসেবে এক সময় ৫০টি তাঁতের মহাজন ছিলাম। বর্তমানে তাঁত রয়েছে পাঁচটি। নিজেই তাঁতের কাজ করি, তবুও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

অপরদিকে তাঁত মালিকরা জানান, বাঙালি নারীদের চাহিদা মোতাবেক বিভিন্ন নান্দনিক ডিজাইনের শাড়ি তৈরি হচ্ছে। এ শাড়ি ৩০০ থেকে ১০ হাজার টাকায় পাইকারিতে বিক্রি হলেও রং-সুতার মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন খরচের সঙ্গে বিক্রয় মূল্যের সমন্বয় না হওয়ায় শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

সিরাজগঞ্জ তাঁতপল্লির শাড়ি ব্যবসায়ী উজ্জ্বল কুমার তাঁত কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। সেই সঙ্গে এ শিল্প টিকিয়ে রাখতে পাওয়ার লুম ও ভারতের শাড়ির সয়লাব কমিয়ে দেশি শাড়ির রপ্তানি বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।

আরও পড়ুন: লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত সিরাজগঞ্জের তাঁতশিল্প

সিরাজগঞ্জ তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি ও বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম এবং পাওয়ার লুম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক হাজি বদিউজ্জামান জাগো নিউজকে জানান, প্রতিনিয়তই রং, সুতাসহ তাঁতের উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি পেলেও কাপড়ের মূল্যবৃদ্ধি না পাওয়ায় এ শিল্পে রুগণতা সৃষ্টি হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক একরামুল হক রিজভী জাগো নিউজকে বলেন, সিরাজগঞ্জের অর্থনীতি তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাই দেশীয় তাঁতশিল্প রক্ষায় সরকারকে তাঁতিদের ঋণসহ রং ও সুতায় ভর্তুকি দিতে হবে। পাশাপাশি অবৈধপথে ভারত থেকে কম দামি শাড়ি আসা বন্ধ করতে হবে। তাহলেই তাঁতশিল্প সমৃদ্ধ হবে।

এফএ/এএসএম