অর্থনীতি

টেন্ডার ছাড়াই বিশ্বব্যাংকের ঋণের ১২২৬ কোটি টাকা খরচের ছক

বিশ্বব্যাংকের ঋণের পুরো টাকা খরচের জন্য চলমান একটি প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পে সাধারণত ওপেন টেন্ডারে (উন্মুক্ত দরপত্র) কেনাকাটা করা হয়। অথচ এ প্রকল্পে কোনো ধরনের টেন্ডার ছাড়াই এক হাজার ২২৬ কোটি টাকা বিভিন্ন আইটেম কেনার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন ঘটনা ঘটেছে। মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর এ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। শুধুমাত্র বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তার অবশিষ্ট অর্থ খরচ করার জন্য প্রকল্পটি আদৌ সংশোধনের প্রয়োজন আছে কি না, তা আবারও যাচাইয়ের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

Advertisement

সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে ২৪ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়। যার মধ্যে খরচ হয়েছে ১৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ব্যয় না হওয়া পাঁচ কোটি ২১ লাখ ডলার এ প্রকল্পে ব্যবহারের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক সম্মতি দেয়। এ সুযোগে চলমান প্রকল্পটি সংশোধন করা হয়। মূল প্রকল্পের মেয়াদ ছিল জুলাই ২০১৮ থেকে জুন ২০২৩। নতুন করে জুন ২০২৫ অর্থাৎ দুই বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এতে খরচ বেড়েছে সোয়া ১২শ কোটি টাকা।

আরও পড়ুন>> ১১ বছরে মেয়াদ বেড়েছে ৭ বার, ব্যয় বেড়েছে ২৪৯৩ কোটি

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, অনুমোদিত মূল প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল এক হাজার ৮৬৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ২৮০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। বাকি এক হাজার ৫৮৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বিশ্বব্যাংকের ঋণ। প্রকল্পটি প্রথমবার সংশোধন করলে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৫৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ২৭১ কোটি ১৯ লাখ এবং বিশ্বব্যাংকের ঋণ দুই হাজার ১৮৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বেড়েছে ৫৯৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। বাড়তি এ ঋণের অর্থ খরচের জন্যই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে আইএমইডি।

Advertisement

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, নতুন ব্যয়ের অর্ধেকই ক্রয় পরিকল্পনার বাইরে। যেমন- ক্রয় পরিকল্পনায় ৪৩টি পণ্য প্যাকেজের জন্য ১৮১ কোটি ৩০ লাখ টাকা, ৫১টি পূর্ত প্যাকেজের জন্য ৮৩০ কোটি টাকা ও ৪৩টি সেবা প্যাকেজের জন্য ১৯৪ কোটি টাকা, ১৩টি নন-কনসালট্যান্সি প্যাকেজের জন্য ১০৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ধরা হয়েছে। কিন্তু ক্রয় পরিকল্পনায় এক হাজার ২৩০ কোটি টাকা টেন্ডার আইটেম হিসাবে রাখা হয়েছে। প্রকল্পের অবশিষ্ট এক হাজার ২২৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা নন-টেন্ডার আইটেম হিসাবে রাখা হয়েছে অর্থাৎ এগুলো ক্রয় পরিকল্পনার বাইরে। এক হাজার ২২৬ কোটি টাকা কেন ক্রয় পরিকল্পনার বাইরে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকায় এমন বিলাসী ব্যয় অনুমোদন প্রসঙ্গে কৃষি, পানি সম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের (সচিব) এ কে এম ফজলুল হক বলেন, ‘ভেবে-চিন্তে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। মাছের উন্নয়নে নানা আইটেম কেনা হবে। আমরা অযৌক্তিক কোনো আইটেম অনুমোদন দেয়নি। আইএমইডি, ইআরডিসহ সবার মতামত নিয়েই প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’

আরও পড়ুন>> কক্সবাজার ঢেলে সাজাতে ২৪৯৭ কোটি ঋণ দেবে জাইকা তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটির জন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে মোট ২৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি হয়। তবে মূল অনুমোদিত ডিপিপিতে ১৮৭ দশমিক ৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যবহৃত হয়। পরে অব্যবহৃত ৫২ দশমিক ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এ প্রকল্পে ব্যবহারের বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সম্মতি পাওয়া গেছে। এজন্য প্রকল্পটি সংশোধন প্রয়োজন হয় এবং মেয়াদও দুই বছর বাড়ানো হবে।’

সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মৎস্য সম্পদের বৃহত্তর অন্বেষণ এবং সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ও উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যতা কমানোর লক্ষ্যে ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ’ শীর্ষক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল মৎস্য অধিদপ্তর। প্রকল্পের প্রায় পুরো অর্থায়নই ছিল বিশ্বব্যাংকের। আড়াই হাজার কোটি টাকার বিদেশি ঋণের প্রকল্পের প্রায় অর্ধেকই ক্রয় পরিকল্পনার বাইরে রয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন>> গলাচিপা সেতু: অনুমোদনের আগেই ব্যয় বাড়ছে ৩১৭ কোটি টাকা

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে আদৌ কোনো উপকার হচ্ছে না। প্রকল্পটি শুধু দেশের বিদেশি ঋণের বোঝাই বাড়াবে। প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে অগুরুত্বপূর্ণ এসব প্রকল্প বারবার মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে।

দেশের উপকূলের ৭৫টি উপজেলার ৭৫০টি ইউনিয়নের মাছচাষিদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছিল। বিশেষ করে নৌ-যানচালক ও মাছচাষিদের লাইসেন্স সিস্টেম চালু করার কথা ছিল। জেলেদের এক লাখ ৫০ হাজার স্মার্ট কার্ড দেওয়ার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত এ খাতে তেমন একটা ব্যয় হয়নি। এছাড়া সামুদ্রিক মৎস্য-সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান আধুনিকায়ন, তিনটি ন্যাশনাল ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান প্রণয়ন, চকরিয়ার বাঁধে বনায়ন ছাড়াও ১০০ মডেল মৎস্যজীবী গ্রাম প্রতিষ্ঠার কথা রয়েছে প্রকল্পে।

আরও পড়ুন>> তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলে বাড়ছে আরও ৩৬২ কোটি

মূল ডিপিপিতে ফিজিক্যাল কনটিজেন্সি ও প্রাইস কনটিজেন্সি খাতে কোনো অর্থ বরাদ্দ না থাকলেও প্রস্তাবিত সংশোধিত ডিপিপিতে ফিজিক্যাল কনটিজেন্সি খাতে ২৪ কোটি ২৯ লাখ টাকা ও প্রাইস কনটিজেন্সি খাতে ৯৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শেষপর্যায়ে এসে এ দুই খাতে ১১৭ কোটি ৪২ লাখ টাকার ব্লক অ্যালোকেশন রাখার যৌক্তিকতা কী, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

আরও পড়ুন: বৈদেশিক ঋণে কাটছাঁট, ঠিক থাকছে সরকারি বরাদ্দ

পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে এই দুই খাতে প্রস্তাবিত অর্থ বরাদ্দ বাদ দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির সর্বশেষ মেয়াদে এই প্রস্তাব করা হয়েছে, যাতে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু ক্রয় পরিকল্পনায় ১০টি পণ্য, ছয়টি সেবা ও সাতটি নন-কনসালট্যান্সি প্যাকেজের কমপ্লিশন অব কনট্রাক্টের শেষ সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৫ সালের জুনেই। চুক্তির শেষ সময়সীমা প্রকল্পের মেয়াদের শেষ সময়সীমার অন্তত এক থেকে দুইমাস আগে পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের যৌথ অর্থায়নে প্রাক্কলিত ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদের প্রকল্পটি ২০১৮ সালের অক্টোবরে অনুমোদন করে একনেক। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৪৫০ কোটি ২২ লাখ টাকা, যা মূল প্রাক্কলিত ব্যয়ের ২৪ শতাংশ।

প্রকল্প এলাকা ও উদ্দেশ্যদেশের উপকূলীয় চার বিভাগের ১৬ জেলার ৭৫টি উপজেলার ৭৫০টি ইউনিয়ন এ প্রকল্পের আওতাভুক্ত। মূলত সামুদ্রিক ও উপকূলীয় মৎস্য সম্পদের বৃহত্তর অন্বেষণ এবং সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ও পরিবেশের টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতা হ্রাস ও জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন করাই প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য।

প্রকল্পের কাজসামুদ্রিক মৎস্য সংক্রান্ত আইন ও বিধি-বিধান আধুনিকায়ন, তিনটি ন্যাশনাল ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান প্রণয়ন, পাঁচটি বাণিজ্যিক মৎস্য নৌযানে ভ্যাসেল মনিটরিং সিস্টেম প্রবর্তন ও ১০ হাজার বাণিজ্যিক মৎস্য নৌ-যানে ট্র্যাকিং সিস্টেম স্থাপন, পাঁচটি সামুদ্রিক মৎস্য নজরদারি চেকপোস্ট স্থাপন করা।

আরও পড়ুন>> বিদেশি অর্থায়ন কাটছাঁটে রেকর্ড, কমছে ১৮ হাজার কোটি টাকা

এছাড়া সামুদ্রিক মাছের মজুতের অবস্থা আপডেট করার জন্য ক্যাচ অ্যান্ড এফোর্ট মনিটরিং সিস্টেম চালু, মৎস্য নৌযান ও মৎস্যজীবীদের রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্সিং সিস্টেম প্রবর্তন, ১৬টি ফিশল্যান্ডিং সাইট আধুনিকায়ন, হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে, স্যালানাইজেশন ম্যাপিং ও ৫২০ হেক্টর খাল পুনর্বাসন করাই ছিল প্রকল্পের অন্যতম কাজ।

অন্যদিকে ৩৫০টি চিংড়ি ক্লাস্টার তৈরি ও ম্যাচিং গ্রান্ট দেওয়া, চিংড়ি ক্লাস্টারে ই-ট্রেসিবিলিটি প্রবর্তন, কক্সবাজারের চকরিয়ায় অবস্থিত সরকারি চিংড়ি এস্টেটের ২৭টি স্লুইস গেটসহ ৭০ কিমি বাঁধ/পেরিফেরাল ডাইক, ফিডার ক্যানেল ও বাইরের দিকে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হবে।

আরও পড়ুন>> উচ্চশিক্ষায় চড়া সুদে ১৮৪১ কোটির বিশ্বব্যাংক ঋণ

তিনটি ফিশ হেলথ ডায়াগনস্টিক, চারটি ফিশ কোয়ারেনটাইন, একটি কোয়ারেনটাইইন রেফারেন্স ও তিনটি পিসিআর ল্যাব আধুনিকায়ন, বাগদা ব্রুড (মা-চিংড়ি) ম্যানেজমেন্ট সেন্টার স্থাপন, উপকূলীয় ৪৫০টি মৎস্যজীবী গ্রামে কমিউনিটি বেজড অর্গানাইজেশন প্রতিষ্ঠা করা হবে।

প্রকল্পের আওতায় অতি দরিদ্র মৎস্যজীবীদের এককালীন সহায়তা, ১০০টি মডেল মৎস্যজীবী গ্রাম প্রতিষ্ঠা ও ১০০টি প্রডিউসার গ্রুপ তৈরি করা হবে। ১৫ হাজার জনকে ভোকেশনাল ট্রেনিং এবং ৪৫টি উপজেলায় মৎস্যজীবী ফেডারেশন প্রতিষ্ঠা করা হবে।

এমওএস/এএএইচ