‘এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে/জল ভরা দৃষ্টিতে/এসো কোমল শ্যামল ছায়ায়’ অনেক আগেই হুমায়ুন আহমেদ আহ্বান জানিয়েছিলেন তার নিড়ে। ঝর ঝর বৃষ্টিতে তার কোমল স্নিগ্ধ শ্যামল ছায়ার তরে। তবে আমাদের যেতে একটু বিলম্ব হয়েছিলো বটে। আহ্বানের কিছুটা ব্যতিক্রমও ঘটেছিলো।
Advertisement
বর্ষাকে উপেক্ষা করে বসন্তেই হাজির হয়েছিলাম নুহাশপল্লীতে। নির্জীব সেই পল্লী। নির্মল আকাশ। প্রখর সূর্য। গাছের পাতা ভাবলেশহীন। শান্ত সৌম্য পরিবেশ।
আরও পড়ুন: কলকাতার যেসব স্থানে ঢুঁ মারতে ভুলবেন না
উপরে লিচু, জাম আর শান্তির প্রতীক জলপাই গাছ। নিচে সবুজ ঘাসের গালিচা। যেন এক টুকরো শান্তি নিকেতন। এইখানে চির নিদ্রায় উত্তরাধুনিক বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তী লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
Advertisement
বলছিলাম নুহাশ পল্লীর কথা। হুমায়ূন আহমেদের সমাধির কথা। কিংবদন্তির পল্লীর সৌন্দর্যের কথা। এসব কিছু খুব কাছ থেকে ছুয়ে দেখতে ছুটে যায় আমরা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের বার্ষিক বনভোজনে হিমুর সাজে হলুদ রঙে সজ্জিত হয়ে মিলিত হই সবাই। খুব সকালে রাজধানী পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রওনা দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যায় রুপকথার স্বর্গরাজ্য নুহাশ পল্লীতে।
যেখানে ঘন বন আর বিশাল গাছের কোমল ছায়া। নুহাশ পল্লীর পশ্চিম পাশের দেয়াল ঘেঁষেই কিংবদন্তীর সমাধি। চারদিকে কাঁচের দেয়াল। ভেতরে অনেকটা জায়গা নিয়ে শ্বেত পাথরের সমাধি। শিথানের পাশে কাঁচের উপর হুমায়ূন আহমেদের স্বাক্ষর করা ফলক। পুরো জায়গাজুড়ে সুনশান নীরবতা।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর ভ্রমণে যে ৫ কাজ করলেই বিপদ
Advertisement
নুহাশ পল্লীতে যাওয়ার ইচ্ছে অনেক দিনের। কিন্তু হয়ে ওঠেনি এর আগে। তবে এবার তা সফল হয়েছে। বিভাগের শিক্ষক মিল্টন বিশ্বাস, আরিফুল আবেদ(আদিত্য), রাহেল রাজিব, সোনিয়া পারভীন ও সাবরিন নাহার ম্যামের কল্যানে তা সম্ভব হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাথে ছিলেন। আর তাদের সহযোগিতায় ছিলো বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
সাদামাটা নুহাশপল্লী। ভেতরে প্রবেশের দেখলাম বড় চত্বর। উত্তর দক্ষিণে লম্বা পুরো জায়গাটা। ডান পাশে জল ফোয়ারা, সুইমিং পুল। মা-ছেলের স্ট্যাচু। আমার চোখ খুঁজছিলো সমাধিস্থল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বা পাশে সমাধি। সবার আগে সেখানে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করলাম।
হুমায়ূন আহমেদের সমাধিস্থলে গিয়ে মনে হল এই চত্বরের প্রতিটি বালুকনায়, ঘাসে, জলে-স্থলে মিশে আছেন সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ। এখানে যতটা অক্সিজেন আছে নিশ্বাস নেওয়ার সবটুকুতে মিশে আছেন ওই মানুষটি। এর কিছুটা পূবে দাবা ঘর।
আরও পড়ুন: খাগড়াছড়ির ‘নিউজিল্যান্ড পাড়া’য় গিয়ে যা দেখবেন
কাঠের তৈরি দাবার গুটি এখনো আছে। তবে ভেঙ্গে যাচ্ছে অনেকগুলো। ঘরটাতে প্রচুর ধুলাবালি। বন্ধু ফাহিমসহ কয়েকজন খেলার চেষ্টাও করলো কিছুক্ষণ। বাকিরা স্মৃতি রাখতে ছবি উঠানোয় ব্যকুল।
এদিকে বৃষ্টি বিলাস শূন্য। কে আর অমন শৈল্পিক বাসনায় বৃষ্টি দেখবে? একটি ভাঙা মোড়া। কয়েকটা জীর্ণ সোফা। সবকিছুতেই অযত্নের ছাপ। বৃষ্টি বিলাস ভবনের ভেতরে পোড়ো বাড়ির মতো কয়েকটি খালি খাট। লোকজন নেই। সেখানে আমরাই রাজত্ব করলাম কিছুক্ষণ।
পশ্চিম পাশের বিশাল টিনের ঘরের দিকে গেলাম না। মনে হচ্ছে কিছুই নেই ওতে। বটতলায় বুড়ো দৈত্য যেন শীর্ণকায়। তার নিচে মৎস্যকুমারী বড় একা! কোথাও কেউ নেই। তারপরেই জলসিঁড়ি সমৃদ্ধ বিশাল পুকুর।
শহুরে যান্ত্রিকতার বাইরে এমন বিশাল পুকুর পাওয়া মানে অন্য উম্মাদনা। দলবেঁধে লাফ-ঝাপ-সাঁতার। হুমায়ূন আহমদের সবচেয়ে প্রিয় জায়গাগুলোর একটা এই পুকুর ঘাট। যার নাম দিঘী লীলাবতী। এখানে তিনি অনেক সময় কাটিয়েছেন। অনেক নাটক সিনেমার শুটিং করেছেন এখানে।
আরও পড়ুন: সিকিম ভ্রমণে যে ভুল করলে বিপদে পড়তে পারেন
পুকুরের উত্তর পাড়ে মাঝারি সাইজের বটগাছ। দক্ষিণে একটি নতুন একতলা ছোট ঘর। বৃষ্টি দেখার জন্য বোধহয় এরচেয়ে ভালো জায়গা আর নেই। পুকুরের মাঝখানে একটি ছোট দ্বীপ। তাতে আছে গাছের ছায়া। সেখানে যাওয়ার জন্য একটি কাঠের সেতু। তবে তার অবস্থা এখন জীর্ণশীর্ণ।
এর পরে দলবেঁধে সুইমিং পুলে গোসল, খেলা ও খুনসুটি। তারপরেই দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি। একে একে সকলের খাওয়া শেষ হলে শুরু হয় খেলাধুলা আর র্যাফেল ড্র।
সেই সাথে নামলো সন্ধ্যা। সুনশান নিরাবতায় আবার ছেয়ে গেল নুহাশপল্লী। কৃত্তিম কোলাহল থামিয়ে বিদায় নিতে হলো ক্ষণিকের হিমুদের।
আরও পড়ুন: নীলাচল ভ্রমণে থাকা-খাওয়া ও যাতায়াত খরচ কত?
এরপর বাসে উঠে সারাদিনের তৃপ্তি ও সৌন্দর্যের বর্ণনা সবার মুখে। হুমায়ূন আহমেদের সার্থকতা যেনো এখানেই। সবাই বলে উঠলো দিনটি ভালো কাটলো। জায়গা সুন্দর। হুমায়ূন আহমেদ এভাবেই বেঁচে আছেন বাংলায়।
বাংলার মানুষদের মনে, প্রকৃতির পাতায়। এ প্রজন্ম তাকে আজীবন স্মরণ করবে। হাজারো ভক্ত পাঠকের হৃদয়ে তিনি চির ভাস্কর হয়ে থাকবেন হিমুর চরিত্রে। বিচরণ করবে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে রুপার খোঁজে।
জেএমএস/জেআইএম