সাহিত্য

মোহাম্মদ রায়হানের গল্প: অতসী

ইসলামপুর থেকে সদরঘাটের দিকে দশ মিনিট হাটলে বায়ে একটি মোড়। সেখান থেকে একদম সোজা নাক বরাবর তিনতলা বাড়ি। সেই বাড়িতে মাসখানেক হলো উঠেছি। ওঠার আলাদা হেতু বলতে টিউশন মাস্টার হিসেবে বাড়িতে ডুকেছি। বাড়ির বাইরের দেওয়াল যতটা শ্যাওলার দখলে, ভেতর দিকটা ততই পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা। আমার শোবার জন্য যে কক্ষ দেওয়া হয়েছে, তা যথেষ্ট ভালো। বেলকনি নেই কিন্তু একটি জানালা আছে।

Advertisement

কক্ষে একটি জায়গা আমার ভাবার জন্য বরাদ্দ রেখেছি। এখানে আরাম কেদারায় বসে কখনো ঝিমাই, কখনো বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো আত্মস্থ করি। আজ নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। চেয়ারটা খটখট শব্দ শুরু করেছে। তারপরও আরামে বসেছি শক্ত করে। হঠাৎ মনে পড়লো, অতসী আজ দুদিন ধরে কোনো চিঠি লিখছে না।

অতসী, আমার ছাত্র নিলয়ের বড় বোন। এবার ভার্সিটিতে পা দিয়েছে। আমার পড়াশোনা শেষ মাস ছয়েক আগে।

আমার জানালার ওপারে একটি দালান আছে। দালানের ঘরটি আজ দুদিন ধরে অন্ধকার। আমার যখন ক্লান্তি পায়, ওই ঘরের বাচ্চাদের নাচানাচি দেখি। পনেরো-ষোলো বছরের একটি মেয়েও আছে তাদের সঙ্গে। আমাকে দূর থেকে দেখলেই ধপাস করে জানালা বন্ধ করে দেয়।

Advertisement

ভাবতে ভাবতেই নিলয় এসে হাজির।স্লামালেকুম নিরব ভাইয়া, ও ভাইয়া।হ্যাঁ হ্যাঁ, নিলয়। খবর কী? তোমার আপু কোথায়?কেন ভাইয়া, হঠাৎ আপুর কথা কেন?আমি ভ্রু কুঁচকে নিজের উপরই বিরক্ত হয়ে বললাম, উহু, ওর মনে হয় একটা চ্যাপ্টার আমার থেকে বুঝে নেওয়ার কথা ছিল।আপু আছে তো। ডাকবো এখন?না না, ওর আসার হলে আসবে।

ভাবলাম, অতসী তো আছে। তাহলে চিঠির জবাব কেন আসছে না! আজ ঘুমানোর আগে আরেকটি চিরকুট লিখে ফেললাম। ‘তোমার উত্তরের অপেক্ষায় বেশ কয়েক প্রহর কাটিয়ে দিয়েছি। কতশত দীর্ঘশ্বাস পড়েছে আক্ষেপের। উত্তর দিতে কুণ্ঠাবোধ কি জেগেছে মনে?’ প্রতিবারের মতো সাদা সুতোয় ভাঁজ করে ঝুলিয়ে দিলাম জানালার ঠিক নিচের দিকে দুটো পিলারের ফাঁকে।

আজ মনটা খারাপ। নিলয়কে আটচল্লিশ ঘণ্টার জন্য ছুটি দিয়েছি। হঠাৎ জানালা দিয়ে ওপারে তাকাতেই দেখি বাচ্চাগুলোর নাচানাচিতে ঘরটি আবার মেতেছে। বেশ কিছুক্ষণ দেখে মন ভালো হয়ে গেল। তবে মেয়েটি আবারও জানালা বন্ধ করে দেওয়ায় আর দেখতে পেলাম না। ধপাস করে আরাম করতে বসে গেলাম।

বুঝলাম না, অতসীর প্রতি কেন এত ঝোঁক তৈরি হলো। মেয়েটির রূপ বর্ণনা করার মতোই সুন্দর। বিশেষ করে ওর চোখ। আমার এ বয়সে এমন সুনয়না আমি দেখিনি। প্রথমদিন হাতপাখা দিতে আসার পরই হলো আমার দৃষ্টিবদল। শরীরের গঠন স্বাভাবিক। চোখে কাজল দিতে দেখিনি। কল্পনায় বহুবার কাজল আমি লেপ্টে দিয়েছি তার চোখে। এই ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই।

Advertisement

পরদিন দুপুর দুটোর দিকে দেখলাম আমার বেঁধে দেওয়া চিঠির জায়গায় হলুদ কাগজের আরেকটি চিরকুট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমি সুতোয় টান দিয়ে চিঠিটি লুফে নিই। বেশ আগ্রহ, মনের আজান্তেই প্রকাশ পাচ্ছে। হাত কাঁপছে কেন জানি। প্রথম দৃষ্টিতে চিরকুটের বর্ণগুলো অস্পষ্ট লাগছে। চোখ কচলাতে কচলাতে চিরকুটটা পড়া শুরু করলাম।

‘বহু দিন নয়, সহস্র দিনের জন্য আপনাকে চাই। আপনাকে আপন করে চাই শেষ সীমানা অবধি। বাবাকে বলেছি। আর দেরী সয় না। আমাদের ঘর বাঁধার দিন ঘনিয়ে এসেছে। বাবা আগামীকাল আসবেন। কাল সন্ধ্যায় আপনি আমাদের ঘরে আসুন। বাবাকে সব একসঙ্গে বলবো। সমাজ-সংস্কৃতি আর ভালো লাগছে না। এবার মুখ খুলবো।’

চিরকুটটি পড়ে আমার গায়ের কাঁপুনি আরও বেড়ে গেছে। আটাশ বছরের জীবনে এমন হয়েছে কি না মনে পড়ে না। হঠাৎ হলো কি? আমার মনে হলো, বোধশক্তি হারিয়ে ফেলবো আর কিছুক্ষণ হলেই। কিছু না বুঝেই পরের দিন রইচ আংকেলের রুমে হাজির হলাম।

কিছু জানি না, বুঝতেও পারছি না। আসলে আমাকে দিয়ে কী হচ্ছে? না বুঝেই আংকেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চলে গেলাম।কেমন আছেন আংকেল?ভালো বাবা, বোসো। তারপর বলো, নিলয়ের খবর কী?আসলে আমি আজ একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। হ্যাঁ বাবা, বলো। কীভাবে যে বলি।ইতঃস্তত করতে করতে পেছনে খেয়াল করলাম নিলয় আর অতসীও হাজির।হ্যাঁ বলো, লজ্জা পাচ্ছো কেন।আসলে আমি আর অতসী একে অপরকে...

কথা শেষ হওয়ার আগেই অতসী আর রইচ আংকেল একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘কী’! রইচ আংকেল সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে গেলেন। অতসী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার কাছে অ্যাসাইনমেন্ট করতে যাই। তাই বলে এতদূর আপনি গেলেন কী করে!আসলে...প্লিজ ভাইয়া।

হনহন করে বের হয়ে গেলাম। রুমে গিয়ে আর স্থির থাকতে পারলাম না। কেবল ভাবনায় বুদ্বুদ ওঠে, কীভাবে পারলো হুট করেই এত পরিবর্তন হয়ে যেতে! লজ্জা আর আত্মসম্মানের যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করলাম।

পরদিন বাসা ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিছু বই, ডায়েরি আর সব সার্টিফিকেট ছাড়া কিছুই নেইনি। দুপুর একটার দিকে কাউকে না জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

পথে ষোলো বছর বয়সী ওই মেয়েটি পথ আটকে বলে উঠলো, ‘এসব কিছু আমার জন্য। আমায় ক্ষমা করবেন প্লিজ।’

হঠাৎ করেই ট্রেনের হুইসেল বাজলো...

এসইউ/জিকেএস