দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান রাষ্ট্রটির টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। হাজার মাইলের ব্যবধানে দুই অংশে বিভক্ত, আলাদা ভাষা-সংস্কৃতি ও লোকাচার সত্ত্বেও শুধু ধর্মের ভিত্তিতে একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা অবাস্তব। কিন্তু তারপরও প্রতিষ্ঠার পর দেশটির শাসকগোষ্ঠী যদি ন্যায্যতাকে দেশ শাসনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতো তাহলেও হয়তো পাকিস্তান রাষ্ট্রটি মাত্র ২৩-২৪ বছর বয়সেই ভেঙে পড়তো না।
Advertisement
এটা তো ঠিক, রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি ছোট অংশের উপলব্ধিতে এসেছিল যে পাকিস্তানের দুই অংশের একসঙ্গে চলা সম্ভব নয়। তারপরও এটাই ঠিক যে ১৯৭১ সালে বাঙালি যুদ্ধ চায়নি, বাঙালি চেয়েছিল অধিকার ও মর্যাদা এবং বৈষম্য থেকে মুক্তি। কিন্তু তখন বাঙালির ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে নিয়মমাফিক ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে হয়তো তখনকার মতো পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা পেত। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর বাঙালি আশা করেছিল যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার পালাবদল হবে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে।
৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচিত হবে। কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্ররোচনা ও চাপে বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি শুরু করেন। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ভয় ছিল, বাঙালির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হলে পশ্চিম পাকিস্তানের এতদিনের কর্তৃত্ব হ্রাস পাবে। এ কারণে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার উদ্দেশ্যে তারা নানা পাঁয়তারা শুরু করে। তারা জোর করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে।
Advertisement
পরবর্তীসময়ে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের লেখা থেকেই জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বাঙালিদের দমনের সিদ্ধান্ত হয়। ইয়াহিয়া যে ১ মার্চ পার্লামেন্টের অধিবেশন আকস্মিকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেন, সেটা ওই শক্তি প্রয়োগের সিদ্ধান্তেরই ফল। ২৫ মার্চ যে বাঙালিদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে তার পরিকল্পনাও মার্চের শুরুতে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি তৈরি করেন।
পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল সৈয়দ মুহাম্মদ আহসান (এস এম আহসান হিসেবে বেশি পরিচিত ছিলেন) পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের ওপর সামরিক হামলার বিরোধী ছিলেন বলে অপারেশনের আগেই তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি করে পাঠানো হয়।
১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সিওএস জেনারেল হামিদ টেলিফোন করে জেনারেল রাজাকে অপারেশনের পরিকল্পনা করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৮ মার্চ সকালে ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করেন।
জেনারেল ফরমান অপারেশনের সিদ্ধান্ত এবং সাফল্যের শর্ত ইত্যাদির সীমা তৈরি করেন এবং জেনারেল খাদিম সেনাদলের স্থান বিতরণ, বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটের ওপর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদি কাজ তদারকি করেন। এটা ধারণা করা হয় যে বাঙালি সেনারা অপারেশনের শুরুর সময় বিদ্রোহ করবে, তাই পরিকল্পনাকারীরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলাপকালে বাঙালি সৈন্যদের অপারেশনের আগেই নিরস্ত্র করার এবং বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের প্রস্তাব দেন।
Advertisement
অপারেশন শুরু হয় ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে এবং অন্য গ্যারিসনকে ফোন কলের মাধ্যমে তাদের জিরো আওয়ারে (অপারেশন শুরুর পূর্বনির্ধারিত সময়ে) তাদের কার্যক্রম শুরুর জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়। ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন রাও ফরমান আলি এবং অন্য সব স্থানের সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন জেনারেল খাদেম। জেনারেল টিক্কা এবং তার কর্মকর্তারা ৩১তম কমান্ড সেন্টারের সব কিছু তদারকি করা এবং ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত ছিলেন।
ব্যাপক গণহত্যা ও অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু গণহত্যা চালিয়েও বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। কোন গণহত্যায় কত জন নিহত হয়েছেন তার নির্ভুল হিসাব আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি। গণহত্যার তীব্রতা, স্থায়িত্ব, জনসংখ্যা সব মিলিয়ে গণহত্যায় নিহতদের আনুমানিক হিসাব করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপজুড়ে নাজি, ফ্যাসিস্ট ও ফ্যালানজিস্টরা যে গণহত্যা চালায় তার সময়সীমা ছিল চার বছরের বেশি। এলাকার ব্যাপকতা ছিল।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ আয়তনে খুবই ছোট, জনঘনত্ব খুব বেশি। সে কারণে এখানে গণহত্যায় একটি সুবিধা পায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর, শান্তি কমিটির সদস্য, রাজাকাররা। অর্থাৎ এখানে গণহত্যা ধীরে ধীরে দীর্ঘদিন ধরে হয়নি। দ্রুত হয়েছে এবং জনঘনত্ব থাকায় বেশি মানুষ হত্যা সম্ভব হয়েছে। যেমন চুকনগরে কয়েক ঘণ্টায় প্রায় ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের গণহত্যার বৈশিষ্ট্য হলো, এত কম সময়ে এত বেশি মানুষ কোথাও আর হত্যা করা হয়নি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, যুদ্ধ শেষে গণহত্যার হিসাবটা শুরু হলো। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদা জানায়, গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা ৩ লাখ। অনেকে বলতে পারেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিলেন- ‘৩০ লাখ হত্যা করো, বাকিরা আমাদের হাত থেকে খাবার খুঁটে খাবে’- প্রাভদা কর্তৃপক্ষ হয়তো সেটি মনে রেখেছিল এবং সে আলোকেই ঘোষণা করেছিল ৩০ লাখ নিহত হয়েছিল।
সর্বজনীন মানবাধিকার জরিপ নামে একটি জরিপ করেছিল জাতিসংঘ এবং তার রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮২ সালে। সেখানে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬ থেকে ১২ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। এ হার গণহত্যার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।
এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা যেতে পারে। গণহত্যার যে হিসাব ১৯৭১ সালে দেওয়া হয়েছিল সেখানে উদ্বাস্তু শিবিরে মৃত্যুর সংখ্যা ধরা হয়নি। শিবিরের কর্তৃপক্ষও দিতে পারেনি। কিন্তু তৎকালীন পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কিত বীভৎস রিপোর্ট ও ছবি ছাপা হয়েছে।
একটি ছবিতে দেখা গেছে মহামারিতে মৃত্যু হয়েছে এমন মরদেহ কুকুরে খুবলে খাচ্ছে। আমেরিকার লাইফ পত্রিকার এক রিপোর্ট অনুযায়ী, শকুনরা অতিমাত্রায় মরদেহ খাওয়ায় তাদের অরুচি ধরে যায়। এই মরদেহের সংখ্যা অবশ্যই গণহত্যার সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে ২ লাখের বেশি নারী ধর্ষণসহ অমানবিক নিগ্রহের শিকার হয়। পাকবাহিনী অগণিত বাঙালি নারীকে ঢাকা সেনানিবাসের অভ্যন্তরে আটকে রেখে যৌন নির্যাতন করেছে। তাদের অধিকাংশ তরুণী যাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও নিজ বাড়ি থেকে ধরে আনা হয়েছিল। আমেরিকার নারীবাদী লেখক ও সাংবাদিক সুসান ব্রাউন মিলারের মতে, চার লাখের বেশি নারী ওই সময় নির্যাতনের শিকার হন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানিরা এত বিচিত্র পদ্ধতিতে গণহত্যা ঘটিয়েছে যে তা পৃথিবীর যেকোনো বর্বরতাকে হার মানায়। একদিকে যেমন সামরিক বাহিনী হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি বেসামরিক রাজাকার-আলবদর-আল শামস্ বাহিনীও গ্রামগঞ্জে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। হত্যার আগে লুটপাট ও হত্যার পরে অগ্নিসংযোগ ছিল নিয়মিত ঘটনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতিকে যে মুক্তি সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের আপামর জনসাধারণ যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাংলাদেশ ভৌগোলিক স্বাধীনতা পেলেও মুক্তির সংগ্রাম আজও অব্যাহত রয়েছে।
জাতির পিতা যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন তা বন্ধ করে দেওয়ার জন্যই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরে সংঘটিত হয় বর্বর হত্যাযজ্ঞ। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬। দীর্ঘ একুশ বছর নানা চড়াই-উৎরাই ও আন্দোলন-সংগ্রামের পথ পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে আবার বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার নতুন যাত্রা শুরু হয়। এই যাত্রা অব্যাহত আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫২ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। অথচ এই দীর্ঘ সময়েও একাত্তরের গণহত্যার স্বীকৃতি যেমন আন্তর্জাতিকভাবে আদায় করা যায়নি, তেমনি গণহত্যার দায়ে কাউকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। এই প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্যের ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়নি।
ইতিমধ্যে তিনটি আন্তর্জাতিক সংস্থা একাত্তরে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যাকে জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংস্থাগুলো হলো; লেমকিন ইনস্টিটিউট, জেনোসাইড ওয়াচ এবং ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন ফর সাইটস অব কনসিয়েন্স। কিন্তু জাতিসংঘ একে আজও স্বীকৃতি দেয়নি। এই স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। এ নিধনযজ্ঞের সাথে জড়িতদের বিচার করতে হবে।
দুঃখের ব্যাপার হলো, একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীর এদেশীয় দোসররা এখনো এদেশের মাটিতে সক্রিয়। তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতি ও আদর্শকে ধূলিসাৎ করতে আজও বদ্ধপরিকর। জেনোসাইডের বিচার না হলে শহীদদের রক্ত-ঋণ যেমন শোধ হবে না, তেমনি পাকিস্তান বাহিনীর এদেশীয় দোসরদেরও প্রতিহত করা যাবে না।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে এটা ঠিক কিন্তু দেশের রাজনীতিতে এখনো বিভেদ ও বিভ্রান্তির অসংখ্য উপাদান রয়ে গেছে। দেশ ও জনগণের শত্রুরা দেশ ও গণবিরোধী অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। স্বাধীনতার মাসে আমাদের অঙ্গীকার হোক, মানবিক এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে আমরা যেন ভ্রষ্ট না হই।
২০ মার্চ, ২০২৩
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
এইচআর/ফারুক/এমএস