দেশজুড়ে

ভুয়া এনজিও খুলে অন্তত ৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, নিঃস্ব হাজারো গ্রাহক

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শ্যামপুর ইউনিয়নের বাবুপুর গ্রামের খাইরুল ইসলামের স্ত্রী সিনিয়ারা খাতুন। দিনমজুর স্বামীর প্রতিদিনের আয় থেকে জমানো টাকা রেখেছিলেন বিসিফের শ্যামপুর শাখায়। উদ্দেশ্য ছিল জমানো টাকা দিয়ে ভাঙাচোরা টিনশেড বাড়ি ভেঙে তৈরি করবেন ইটের বাড়ি। তবে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তার টাকা নিয়ে পালিয়েছে বিসিফ নামের একটি অবৈধ এনজিও। এখন নিঃস্ব হয়ে পথে পথে ঘুরছেন সিনিয়ারা খাতুন।

Advertisement

একই উপজেলার কয়লার দিয়াড় গ্রামের জলিল উদ্দিনের ছেলে রজিবুল ইসলাম পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে শতকষ্টে কিছু কিছু করে দীর্ঘ ছয় বছরে জমিয়েছেন প্রায় তিন লাখ টাকা। কিন্তু তার সব টাকা নিয়েই পালিয়েছে বিসিফ। পথে বসেছেন রজিবুল ইসলাম। চোখের পানি ফেলে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ ছাড়া কোনো উপায় দেখছেন না তিনি।

সিনিয়ারা, রজিবুলের মতো কয়েক হাজার গ্রাহক নিজেদের জমানো টাকা সঞ্চয় করেছেন এনজিওটিতে। তবে নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ অবৈধ ওই এনজিওতে জমা রেখে সর্বস্ব হারিয়েছেন তারা।

গ্রাহকদের সঞ্চয়ের টাকা ফেরত দিচ্ছে না বাংলাদেশ আইডিয়াল সোসাইটি ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন-বিসিফ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় গ্রাহকের ৪০-৫০ কোটি টাকা নিয়ে কয়েকমাস আগে শ্যামপুরসহ কয়েকটি শাখায় তালা মেরে তারা পালিয়েছেন বলে অভিযোগ গ্রাহকদের।

Advertisement

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা যায়, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নিবন্ধন বা অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে ক্ষুদ্র ঋণ পরিচালনাকারী বিসিফের মূল মালিক ছিলেন রাজশাহীর গোদাগাড়ীর কামাল উদ্দিন, শিবগঞ্জ উপজেলার তেলকুপি এলাকার জহুরুল ইসলাম, শিবগঞ্জের মিজানুর রহমান ও বাবর আলী। তবে কয়েকটি শাখার কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার পর তারা পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: গ্রাহকের ২০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট

কামাল উদ্দিনের দাবি, তিনি প্রতিষ্ঠানটির সাবেক নির্বাহী পরিচালক। জহুরুল ইসলাম বলছেন, এর সব দায়ভার কামাল উদ্দিনের। বাকি অন্যতম দুই মালিক মিজানুর ও বাবর আলীও দায়িত্ব নিতে অপরাগ। তাদের এই অন্তর্দ্বন্দ্বে পথে বসেছেন হাজারো গ্রাহক।

শ্যামপুর ইউনিয়নের চামা বাজারের লেদমিস্ত্রি গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘আমার প্রতিদিনের পারিশ্রমিক ও পরিবারের সবার মিলে দোকানের পাশেই থাকা বিসিফে জমা রেখেছিলাম প্রায় ১৬ লাখ টাকা। তবে এনজিওটির মালিকরা টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন। অনেক কষ্টে ব্যবসা বাড়ানোর জন্য টাকাগুলো জমিয়েছিলাম। আমাকে নিঃস্ব করে সব নিয়ে গেছেন তারা।’

Advertisement

বিসিফে প্রায় তিন লাখ টাকা রেখেছিলেন রজিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিসিফ নামের ওই এনজিওর মালিক ছিলেন চারজন। এর মধ্যে কামাল হোসেন নামের একজনের সঙ্গে আমার এখনো কথা হয়। তিনি নওগাঁর মহাদেবপুরে ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করেন। তিনি মাঝে মধ্যে মোবাইলে আমার সঙ্গে কথা বললেও টাকা দিচ্ছে না। তিনি বলছেন, জহরুলের কথা। জহুরুলকে ফোন দিলে বলছেন, কামালের কথা।’

ভুক্তভোগী গৃহবধূ রুনা খাতুন বলেন, ‘আমার দেবর, আমার ও আমাদের স্বজনদের মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা ছিল ওই এনজিওতে। কিন্তু তারা এখন পালিয়ে গেছে। আমরা এখন এ টাকা কোথায় পাবো? মালিকপক্ষ ও কর্মীদের কেউ ফোন ধরছে না।’

ষাটোর্ধ্ব মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এক বছর আগে নাতনির বিয়ের জন্য ২০ হাজার টাকা রেখেছিলাম। কিছুদিন আগে নাতনির বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। তাই এদের কাছে টাকা চাইতে এসেছিলাম। কিন্তু তারা টাকা দেয়নি। অনেক কষ্টে ঋণ দিয়ে নাতনির বিয়ে দিলাম।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরও কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করে বলেন, আমাদের মতো হাজারো মানুষ তাদের কাছে টাকা পাবে। কিন্তু তারা ইচ্ছা করে আমাদের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বাড়িসহ সম্পদ করছেন। এনজিওর মালিক পক্ষের একজন শিবগঞ্জের বাবর আলী। তিনি শিবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশে এনজিওর টাকায় তৈরি করেছেন আদর্শ হাসপাতাল নামের একটি হাসপাতাল। কামাল হোসেন রাজশাহীতে বাড়ি কিনেছেন প্রায় চার কোটি টাকা দিয়ে।

গ্রাহকদের দাবি, জেলাজুড়ে বিসিফের ১৪টি শাখা ছিল। প্রত্যেক শাখা থেকেই কয়েক কোটি টাকা করে হাতিয়ে নিয়েছে সংস্থাটি। প্রথমবার পালিয়ে যাওয়ার পর অভিনব কৌশল অবলম্বন করা হয়। বিসিফের জায়গায় টানানো হয় ‘আদর্শ ফাউন্ডেশন’ নামের একটি নিবন্ধিত এনজিওর সাইনবোর্ড।

চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি গ্রামের সহজ-সরল সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে বিসিফের ছয় সদস্যকে আটক করে র‌্যাব। ওইদিন রাত ৯টার দিকে নাচোল পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মাস্টারপাড়ায় সুফিয়ান বিদ্যা নিকেতন অ্যান্ড প্রাইভেট হোম সংলগ্ন বিসিফের অফিস রুম থেকে তাদের আটক করা হয়।

এ ঘটনায় করা মামলায় অন্যতম আসামি করা হয়ে বিসিফের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কামাল উদ্দিনকেও। তবে তাকে এখনো গ্রেফতার করা হয়নি।

এ বিষয়ে বিসিফের সাবেক নির্বাহী পরিচালক কামাল উদ্দিন বলেন, বিসিফ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার পরও আমার নাম ব্যবহার করে বিভিন্নভাবে হয়রানির করা হচ্ছে। আমি গ্রাহকের কোনো টাকা হাতিয়ে নিইনি। বাবর আলী এনজিওর টাকা দিয়ে শিবগঞ্জে আদর্শ হাসপাতাল নির্মাণ করেছেন। আমি তাকে সেসব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। আমার কাছে কোনো টাকা নেই।

জানতে চাইলে বাবর আলী বলেন, ‘আমাদের ভুল বুঝিয়ে সব টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছেন কামাল উদ্দিন। আমার কাছে কোনো টাকা নেই।’

এনজিওর টাকায় হাসপাতাল নির্মাণের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ হাসপাতাল এনজিওর টাকায় না। আমি নিজের টাকায় শেয়ার কিনেছি।’

তবে বিসিফের অন্যতম মালিক জহরুল ইসলাম বলেন, এখনো নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন কামাল উদ্দিন। সার্বিকভাবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তিনিই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। কামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে সংস্থাটির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ করেন তিনি।

ইসলামী ব্যাংকের নওগাঁর মহাদেবপুর শাখায় মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে জানা যায়, বিসিফের নির্বাহী পরিচালক কামাল উদ্দিন সেখানে কর্মরত। তবে তার বিষয়ে ফোনে কোনো তথ্য দেওয়া যাবে না বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাব-৫ সিপিসি-১ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ক্যাম্পের কোম্পানি অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রুহ-ফি-তাহমিন তৌকির বলেন, গ্রাহকদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই বিসিফ নামের একটি অবৈধ এনজিওর ছয়জনকে আটক করে র‌্যাব। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ। তবে গ্রাহকরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে বাকি আসামিদেরও আটক করা হবে।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবুল হায়াত জাগো নিউজকে বলেন, গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি আমার জানা ছিল না। শিবগঞ্জে এমন অনেক এনজিও আছে যারা অবৈধভাবে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এরাও তাদের মধ্যে অন্যতম বলে জানতে পেরেছি। তবে বিসিফের বিষয়ে আমি এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সোহান মাহমুদ/এসআর/এমএস