১৪ মার্চ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করে বাংলাদেশ। তাও টি-২০ ফরম্যাটে, যে ফরম্যাটে বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্বল। ঐতিহাসিক সেই জয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাকিব আল হাসান।
Advertisement
সাকিব এখন বাংলাদেশের টেস্ট ও টি-২০ অধিনায়ক। শুধু অধিনায়ক বলেই নয়, সাকিব মাঠের নেতৃত্বে এবং পারফরম্যান্সেও ছিলেন দলের নেতা। দলও ছিল দারুণ উজ্জীবিত। ইংল্যান্ড দল থাকতে থাকতেই বাংলাদেশে পৌঁছায় আয়ারল্যান্ড। ১৮ মার্চ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ জয় পায় রেকর্ড গড়ে।
যদিও ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল। কিন্তু রেকর্ড গড়া এই জয়ের লাগামও সাকিব আল হাসানের হাতেই। দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান করেছেন, উইকেটও পেয়েছেন। এই দুই জয়েই বাংলাদেশের নায়ক সাকিব আল হাসান। এই দুই জয়ের মাঝখানে ব্যবধান মাত্র তিনদিনের।
মাঠের নায়ক সাকিব আল হাসান এই তিনদিন ছিলেন খলনায়ক। মাত্র তিনদিনের মধ্যে নায়ক থেকে খলনায়ক, খলনায়ক থেকে আবার নায়ক বনে যাওয়া একমাত্র সাকিব আল হাসানের পক্ষেই সম্ভব। মাঠে এবং মাঠের বাইরে এমন দ্বৈত চরিত্র, বাংলাদেশে তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটেই পাওয়া কঠিন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত ক্রিকেটার এসেছেন, তাদের মধ্যে সাকিব আল হাসান সেরা, সেরা মানে তার আসলে কোনো দ্বিতীয় নেই।
Advertisement
শুধু বাংলাদেশ নয়, সাকিব বিশ্বেরই সেরা অলরাউন্ডার। নিয়মিত খেললে সাকিবের সামনে সুযোগ ছিল সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার। একই সঙ্গে দলের সেরা ব্যাটসম্যান এবং সেরা বোলার হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কোনো কারণে সাকিব না থাকলে বাংলাদেশকে দুজন খেলোয়াড়ের কথা ভাবতে হয়।
মাঠের পারফরমার সাকিব আল হাসানের একজন ভক্ত আমি। শুধু আমি নই, বাংলাদেশের জান সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের পোস্টার বয় সাকিবের সামনে সুযোগ ছিল কোটি তরুণের আইডল হওয়ার। কিন্তু মাঠের নায়ক সাকিব, মাঠের বাইরের খলনায়ক। তার মতো কারও আইডল হওয়ার সুযোগ নেই।
বিভিন্ন সময়ে আমি সাকিবকে নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছি। তাতে সাকিব ভক্তদের অনেক গালিও খেয়েছি। আমি সাকিববিরোধী নই, আমিও সাকিবের ভক্ত। আমি খালি চেয়েছি, সাকিব মাঠে এবং মাঠের বাইরে সবার আইডল হয়ে উঠুন। আমি চেয়েছি, সাকিব যেন মাঠের বাইরের ভুলগুলো শুধরে নেন। কিন্তু দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে, সাকিব আসলে নিজেকে শোধরাবেন না। তাই আমিও ভেবেছিলাম, সাকিবকে নিয়ে আর কিছু লিখবো না। কিন্তু সাকিব এমন সব কাণ্ড করেন, না লিখে পারা যায় না।
কেউ কেউ বলেন, বিতর্কই আসলে সাকিবের পারফরম্যান্সের ফুয়েল। মাঠের বাইরে বিতর্ক এলেই মাঠে জ্বলে ওঠেন তিনি। ভক্তদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা, তাদের মারধর করা তো ডাল-ভাত। আরও বড় বড় কেলেঙ্কারিতেও সাকিবের নাম এসেছে বারবার। জুয়াড়িদের সাথে যোগাযোগের কারণে এক বছর নিষিদ্ধ ছিলেন ক্রিকেটে। তারপরও শিক্ষা হয়নি।
Advertisement
জেনেশুনে একটি জুয়াড় সাইটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়েছিলেন। তার নাম এসেছে শেয়ার কেলেঙ্কারিতেও। সাকিব একজন ব্যবসায়ী। হোটেল, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, কাঁকড়ার খামার, স্বর্ণ ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা– দেশে-বিদেশে নানারকম ব্যবসায় তিনি বিনিয়োগ করেছেন। ব্যাংকও কিনতে চেয়েছিলেন, তবে অনুমতি পাননি।
সাকিবের ব্যবসা নিয়ে আমার আপত্তি নেই। যে কারও ব্যবসা করার অধিকার আছে। কিন্তু সাকিবের কাঁকড়ার খামারের শ্রমিকরা যখন পাওনা টাকার দাবিতে মানববন্ধন করেন, আমার খারাপ লাগে। শেয়ার ব্যবসা করতে গিয়ে যখন শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েন, আমি লজ্জিত হই। অনেকে বলেন, সাকিব লোভী; তার আর কত টাকা লাগবে। এখানেও আমার আপত্তি।
সাকিবের কত টাকা লাগবে, সেটা আমি আপনি ঠিক করে দেওয়ার কেউ নই। বৈধভাবে সাকিব কেন, যে কারও যত ইচ্ছা টাকা কামানোর অধিকার আছে। আর আমার-আপনার কাছে যেটা লোভ মনে হচ্ছে, সাকিবের কাছে সেটা প্রয়োজন হতে পারে।
আরেকটা কথা হলো, যত ভালোই হোন, একজন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৪০ বছর পর্যন্ত। অবসর নেওয়ার পর কিন্তু সাকিব আর এখনকার মতো টাকা কামাতে পারবেন না। শেষ বয়সে দুস্থ খেলোয়াড় হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা নেওয়ার চেয়ে সময় থাকতে টাকা কামানো অনেক সম্মানজনক। আর চাইলেও তো সবাই সাকিব আল হাসানের মতো টাকা কামাতে পারবেন না। শুধু সাকিব নন, বিশ্বের সব তারকা খেলোয়াড়ই তাদের তারকাখ্যাতিকে আয়ের উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন।
সবই ঠিক আছে, কিন্তু সাকিবের টাকা কামানোর প্রক্রিয়াটা সবসময় স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্ন নয়। সমস্যাটা এখানেই। এ কারণেই অনেকে তাকে লোভী বলেন। খেলে টাকা কামাবেন, অ্যান্ডোর্সমেন্টে টাকা কামাবেন, ব্যবসা করে টাকা কামাবেন। কিন্তু তাই বলে সাকিবের মতো একজন পারফারমারকে জুয়াড়িদের কাছ থেকে টাকা নিতে হবে, জুয়াড় সাইটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে হবে, শেয়ার কেলেঙ্কারি করে টাকা কামাতে হবে?
সর্বশেষ যে বিতর্ক নিয়ে তোলপাড়, তা হলো- সাকিব দুবাইতে আরাভ জুয়েলার্স নামে একটি স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে গেছেন, যার মালিক একজন খুনের মামলার পলাতক আসামি। এমন কিছু ঘটলে সাকিব ভক্তরা বলেন, সাকিব কীভাবে জানবেন, কে খুনি আর কে জুয়াড়ি। সাকিব দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘুরে ঘুরে টি-২০ টুর্নামেন্ট খেলছেন, চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। তিনি যদি মানুষ না চেনেন, তাহলে কীভাবে হবে।
দুবাইয়ে খুনের মামলার আসামির স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে যাওয়া প্রসঙ্গেও তার ভক্তরা বলছেন, সাকিব তো পুলিশ নন, গোয়েন্দা নন, সাংবাদিক নন; তিনি কীভাবে জানবেন যে আরাভ খুনের মামলার আসামি। প্রথম কথা হলো, যে কেউ টাকা দিলেই তার দোকান উদ্বোধন করে দেওয়াটা সাকিবের মাপের তারকার সাথে যায় না। আর আরাভের কথা শুনে মনে হচ্ছে, সাকিবের সাথে তার পরিচয় দীর্ঘদিনের।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাংলাদেশের গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ দাবি করেছেন, গোয়েন্দারা আগেই সাকিবকে আরাভ খানের ব্যাপারে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু সে সতর্কবার্তাকে পাত্তাই দেননি সাকিব। এখন গোয়েন্দা প্রধান হারুন বলছেন, প্রয়োজনে এই ঘটনায় সাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটারকে যদি খুনের পলাতক আসামির সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগে পুলিশি জেরার মুখে পড়তে হয়, তাহলে এরচেয়ে লজ্জার আর কিছু থাকবে না। শুধু পুলিশের পরামর্শ উপেক্ষা করেছেন, তাই নয়; বিসিবিকেও গোনায় ধরেননি সাকিব।
অবশ্য কখনোই তিনি বিসিবিকে পাত্তা দেন না। খেলার বাইরের যে কোনো বাণিজ্যিক কাজে বিসিবির অনুমতি নিতে হবে চুক্তিবদ্ধ সব ক্রিকেটারকেই। কিন্তু সাকিব কখনোই সেটা মানেন না। তিনি খুনের মামলার আসামির স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে দুবাই গেছেন, সেটা বিসিবি জানেই না।
সাকিবের নানা অপকর্মের পক্ষে তার ভক্তরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুক্তি দেন। সবচেয়ে আপত্তিকর যুক্তি হলো- দেশের সবাই যখন দুর্নীতি করছে, তখন সাকিব করলে দোষ কী? কী ভয়ঙ্কর ভাবনা। এটা ঠিক দুর্নীতি এখন বাংলাদেশের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই না হলেও অনেক মানুষ দুর্নীতির সাথে জড়িত। কিন্তু তাই বলে সাকিবের দুর্নীতি বা অপকর্ম জায়েজ হয়ে যায় না।
সাকিব খেলা থেকে, অ্যান্ডোর্সমেন্ট থেকে, ব্যবসা থেকে, দোকান উদ্বোধন থেকে টাকা আয় করুক, আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কত হাজার কোটি লাগবে, সেটাও আমরা ঠিক করে দেবো না। আমার কথা হলো, সাকিব যাই করুন, সেটা যেন তার তারকাখ্যাতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। মাঠের নায়ক যেন মাঠের বাইরেও আমাদের নায়কই থাকেন।
লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।
এইচআর/ফারুক/জেআইএম