অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান। কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। অধ্যাপনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। লিখছেন, গবেষণা করছেন বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।
Advertisement
রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ ও চলমান অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সহসাই থামছে না, এমনকি বিস্তৃতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: বছর গড়িয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। ইউক্রেনের বাখমুত নগরীর পরিস্থিতিকে বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গেও তুলনা করছে পশ্চিমা মিডিয়া। এই যুদ্ধ পরিস্থিতি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরও গতিশীল হবে এবং চলতেই থাকবে। আরও উন্নতমানের অস্ত্র ব্যবহার করবে ইউক্রেন। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। শীতের সময় গতি থাকলেও ইউক্রেন এখন ন্যাটোর সহায়তা নিয়ে পাল্টা আক্রমণ করবে। বাখমুত শহরে রাশিয়ার অনেক অভিযান ইউক্রেন ঠেকিয়ে রাখছে। যদিও শহরটির পরিস্থিতি ভয়াবহ।
Advertisement
আরও পড়ুন>> যে তিন উপায়ে শেষ হতে পারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
বোঝা যাচ্ছে, ইউক্রেন এখন শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবহার করছে এবং তাদের হাতে কিছু বিমান এসেছে, যা ব্যবহার করার জন্য মুখিয়ে আছে। এখন দেখার বিষয় রাশিয়া এই যুদ্ধকে কতটুকু বিস্তৃত করে।
জাগো নিউজ: রাশিয়া কি বিস্তৃতি ঘটাইতেই চাইছে?
এম শাহিদুজ্জামান: রাশিয়া চেষ্টা করছে যুদ্ধটা নিয়ন্ত্রণে রেখে ইউক্রেনকে থামাতে। চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। হাইপারসোনিক মিসাইল, প্রচুর গুলি আর বিমান হামলা করে রাশিয়া তার শক্তির প্রকাশ দেখিয়েছে। আমি মনে করি, রাশিয়া তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়েই মাঠে নেমেছে এবং যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটবে।
Advertisement
জাগো নিউজ: এর পরিণতি কী হতে পারে? কী অপেক্ষা করছে বিশ্বের জন্য?
এম শাহিদুজ্জামান: পরিণতি নিয়ে এখনো বলার সময় আসেনি। এটি নির্ভর করবে ইউক্রেনের জন্য ন্যাটো বাহিনীর সাহায্য প্রক্রিয়ার ওপর। শান্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ এখানে রাশিয়ার ভূ-রাজনীতি রয়েছে।
আরও পড়ুন>> যুদ্ধে যেসব অস্ত্র ব্যবহার করছে রাশিয়া-ইউক্রেন
আমরা পরিসংখ্যান এবং সময় ধরে যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখবো ৬০ বা ৭০ বছর পরপর পৃথিবীর দেশগুলোর সীমানা একই থাকেনি। যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক কারণে এর পরিবর্তন হয়েছে। এই যুদ্ধটাকে আপনি সেই চোখে দেখতে পারেন। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় এতদিন যে নিয়ম ব্যবহার হয়েছে, তা বিভিন্ন জায়গায় ভঙ্গ হবে। লাদাখে সীমানা নিয়ে, অরুণাচলে সীমানা নিয়ে ভারত-চীনের দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হচ্ছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আরাকানের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। ফিলিস্তিনে জরবদখল করে সীমানা দখল করছে ইসরায়েল।
জাগো নিউজ: ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ তুললেন। ইরান-সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটছে। মধ্যপ্রাচ্যে কী বার্তা মিলছে?
এম শাহিদুজ্জামান: ইরান-সৌদি সম্পর্কে ইসরায়েল যথেষ্ট ভয়ে থাকবে। আরও দুই মাস সময় লাগবে বিষয়টি বুঝতে। এর মধ্যে ইসরায়েলের পাল্টা অবস্থান দেখতে হবে। মোসাদ ও সিআইএ কী অবস্থান নেয় তা দেখতে হবে। ইসরায়েলের মধ্যেও তাদের পলিসি নিয়ে বিতর্ক আছে। মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও এখন ইসরায়েলকে নগ্ন সমর্থন দেওয়া বিব্রতকর হয়ে যাবে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে তার হাত-পা বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। আমেরিকার নীতি এখন খুবই দুর্বল। আবার রাশিয়ায় উগ্র জাতীয়তাবাদ খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ধরনের মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে।
কয়েক দশক পরপর এমন নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়। বৈশ্বিক পরিবর্তনও ঘটে এমন মূল্যবোধ থেকে। অনেকটাই ভূমিকম্পের মতো।
জাগো নিউজ: রাশিয়ার অস্ত্র ফুরিয়ে আসছে বলে কোনো কোনো মিডিয়া খবর দিচ্ছে। এমন খবরের সত্যতা নিয়ে কী বলা যায়?
এম শাহিদুজ্জামান: রাশিয়ার অস্ত্র ফুরিয়ে আসছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। দেশটির অস্ত্র ভান্ডার সমৃদ্ধ করার প্রচণ্ড সক্ষমতা রয়েছে। তাদের হাতে প্রযুক্তি রয়েছে আধুনিক অস্ত্র বানানোর। দেশটি ইরান, চীন থেকে অস্ত্র নিচ্ছে। সুতরাং, ফুরিয়ে আসছে বলাটা ভুল হবে। বরং প্রচুর মজুত রয়েছে বলেই আমি বিশ্বাস করি। খবরে দেখলাম, রাশিয়ার অস্ত্র তৈরির কারখানায় উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ। অস্ত্র তৈরির উপাদানের তো কোনো অভাব নেই।
জাগো নিউজ: রাশিয়ার জন্য আসলে চ্যালেঞ্জ কী?
এম শাহিদুজ্জামান: রাশিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ দেশটির জনগণ। যুদ্ধ করার মতো পর্যাপ্ত সামরিক বাহিনী নেই। একটি সময় সরকারি বাহিনীর সঙ্গে প্রাইভেট বাহিনীর দূরত্ব তৈরি হতে পারে। গ্রীষ্মকালে ইউক্রেন আরও উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করবে। এতে রাশিয়ান বাহিনী আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যদিও এখনই এ পরিস্থিতি নিয়ে বলা কঠিন। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, ইউক্রেনে দখল করা অঞ্চল রাশিয়া কোনোভাবেই আর ছাড়বে না। সুতরাং, ইউক্রেন-রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালায় কি না, তা ভাবনার আছে।
জাগো নিউজ: রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালালে কী ঘটতে পারে?
এম শাহিদুজ্জামান: রাশিয়ার কী ঘটবে তা বলা মুশকিল। তবে ইউরোপের দেশগুলো আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে। কারণ রাশিয়ার তেল-গ্যাসের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি ইউরোপ।
আরও পড়ুন>> রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ: যেসব প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের ওপর
অন্যদিকে সৌদি-ইরান সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটলে ইউরোপ-আমেরিকার জন্য আরও চ্যালেঞ্জ বাড়বে। আবার পুতিনের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইলে তাকে অবশ্যই দখল করা অঞ্চলে রাশিয়ার অধীনে রাখতে হবে। সুতরাং, যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটনার আশঙ্কাই বেশি এবং চাপ সৃষ্টি হবে বিশ্বজুড়ে।
জাগো নিউজ: এর দায় পশ্চিমাদেরই দেবেন?
এম শাহিদুজ্জামান: অবশ্যই। সবকিছুর একটা সীমা আছে। ইউক্রেনকে যেভাবে সহযোগিতা করছে, তা সীমা লঙ্ঘন করে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিজেদের জন্যও অস্ত্র মজুত রাখতে হচ্ছে। এর মধ্য থেকে ইউক্রেনকে কতটুকু সাহায্য করা উচিত তার জবাব চাইবে সেখানকার জনগণ। একই অবস্থা আমেরিকায়ও। দিন যত যাচ্ছে, রিপাবলিকানদের কর্তৃত্ব বাড়ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প চাইবে এই যুদ্ধ থামানোর। এসব দিক চিন্তা করলে দেখা যাবে, ইউক্রেনের জন্য সামনে কঠিন সময় আসবে। অনেকটাই দাবা খেলার মতো। যদিও এই যুদ্ধের ক্ষতি ব্যাপক হারে লক্ষ্য করছে সারা বিশ্বের মানুষ।
এএসএস/এএসএ/জেআইএম