ফরিদপুরের ভাঙ্গা জংশন থেকে বরিশাল হয়ে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত ৩৬৯ দশমিক ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ নির্মাণ করা হবে। এই রেলপথ নির্মাণে প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। বিশদ নকশা প্রণয়ন ও দরপত্র দলিল প্রস্তুতসহ ভাঙ্গা জংশন (ফরিদপুর) থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর কুয়াকাটা পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য সম্ভাব্য সমীক্ষা প্রকল্প বাস্তবায়নের পর এমন ব্যয় ও রেলপথের দৈর্ঘ্যের একটি প্রাক্কলন করা হয়েছে। ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলাসহ মোট সাতটি জেলার ওপর দিয়ে দীর্ঘ রেলপথ নির্মাণ করা হবে।
Advertisement
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানায়, প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদ ধরা হয়েছে সাত বছর। এর মধ্যে দেড় বছর ধরে টেন্ডারিং, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন কাজ করা হবে। সাড়ে চার বছর ধরে প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। বাকি এক বছর ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড ধরা হয়েছে।
আরও পড়ুন: করুণা নয়, ন্যায্য হিস্যা দাবি করছি
প্রকল্পের মূল কাজ: রেললাইনের মোট দৈর্ঘ্য বা রুট লাইন হবে ২১৪ দশমিক ৯১ কিলোমিটার, এর মধ্যে মেইন লাইন ১৯০ দশমিক ১১ কিলোমিটার ও ব্র্যাঞ্চ লাইন ২৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার। তবে ট্র্যাকের মোট দৈর্ঘ্য হবে ৩৬৯ দশমিক ৪০ কিলোমিটার। এর মধ্যে মেইন লাইন ২১৪ দশমিক ৯১ কিলোমিটার ও লুপ লাইন ১৫৪ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার। রেলপথে এমব্যাংকমেন্টের দৈর্ঘ্য হবে ১৬৮ দশমিক ৮৮ কিলোমিটার। ৪৪০টি বক্স কালভার্ট নির্মাণ করা হবে, এর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার।
Advertisement
ভাঙ্গা-কুয়াকাটা রুটে ৩৬ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ: ১০টি মেজর ব্রিজ নির্মাণ করা হবে, এর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৪ দশমিক ৮৬ কিলোমিটার। মেজর সেতুগুলোর উভয় প্রান্তে ৩৬ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ নির্মাণ করা হবে। কুমার, কালিগঙ্গা, শিকারপুর, আমতলী, কীর্তনখোলা, পায়রা, পটুয়াখালী, আন্ধারমানিক, টিয়াখালী, খাপরা ভাঙা নদীর ওপর দিয়ে উড়াল রেলপথ নির্মিত হবে।
আরও পড়ুন: নতুন পদ্ধতিতে যেভাবে কাটবেন ট্রেনের টিকিট
পুরো রেলপথে থাকবে ১৯টি নান্দনিক স্টেশন বিল্ডিং: পুরো রেললাইনে ১৯টি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ করা হবে। স্থানগুলো হলো- ভাঙ্গা জংশন, বরইতলা, টেকেরহাট, মাদারীপুর, কালকিনি, গৌরনদী, উজিরপুর, বরিশাল এয়ারপোর্ট, বরিশাল, দপদপিয়া, বাকেরগঞ্জ, বদরপুর, পটুয়াখালী, কাকুয়া, আমতলী, পায়রা পোট, পায়রা পোর্ট ইয়ার্ড, লেমুপাড়া ও কুয়াকাটা।
আরও পড়ুন: কক্সবাজার ঢেলে সাজাতে ২৪৯৭ কোটি ঋণ দেবে জাইকা
Advertisement
এডিবি ও চীন থেকে ঋণ পাওয়ার প্রত্যাশা: দীর্ঘ রেলপথটি সরকারি অভ্যন্তরীণ বা সরকারি অর্থায়নে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এই জন্য রেলপথটি নির্মাণে বৈদেশিক অর্থায়ন থাকবে বেশি। শুধু ভূমি অধিগ্রহণ খাতে কিছু অংশ সরকারি অর্থ ব্যয় করা হবে। বাকি অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পে চীন অথবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ নেবে সরকার। এরই মধ্যে দুই উন্নয়ন সহযোগীকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে ঋণ চেয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। তবে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি এডিবি ও চীন এখনো সাড়া দেয়নি বলে দাবি করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। প্রকল্পের মোট প্রস্তাবিত ব্যয় ৪১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ৯ হাজার ৫৯৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সরকারি অর্থায়নের বড় অংশই ব্যয় হবে ৫ হাজার ৬৩৮ একর ভূমি অধিগ্রহণ খাতে। বৈদেশিক ঋণ ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
প্রকল্পের অর্থায়ন ও চুক্তি: প্রকল্পের নির্মাণকাজের অর্থায়ন এখনও নিশ্চিত হয়নি। তবে অর্থায়ন সংগ্রহের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। প্রকল্পের অর্থায়ন নিশ্চিত না হওয়ায় এখনও টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি। এডিবি ও চীন থেকে ঋণ মিলবে বলে প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।
আরও পড়ুন: আধুনিক শুল্ক পদ্ধতি গড়ে তুলতে ব্যয় ১৬৮৬ কোটি
ইআরডি’র ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, সমীক্ষা সম্পন্ন করার পরে ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা রুটে ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। সমীক্ষা প্রকল্পের ডাটা ব্যবহার করে চীন, এডিবি ও এশীয় পরিকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) কাছে ঋণ চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এখনও কোনো উন্নয়ন সহযোগী আমাদের কনফার্ম করেনি। আশা করছি দ্রুত সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে একটা ফিডব্যাক পাবো।
পরামর্শক নিয়োগ ও বিশদ ডিজাইন: নির্মাণ প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগ এখনও সম্পন্ন হয়নি। আর বিশদ ডিজাইন সমীক্ষা প্রকল্পের পরামর্শক কর্তৃক শামিল করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: কোরিয়ান ঋণের সাশ্রয় হওয়া ২২৮ কোটি টাকায় কেনা হবে নতুন রেলকোচ
রেলপথ নির্মাণে সমীক্ষা ব্যয় ৪৯ কোটি: রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়েছে ২০২২ সালের জুনে। পায়রা সমুদ্রবন্দর ও কুয়াকাটাসহ বরিশাল, পটুয়াখালীকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনা প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য। বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর এবং ঝালকাঠি-পাথরঘাটা সেকশনে সংযুক্ত হবে রেলপথটি। মূল সমীক্ষায় ব্যয় ছিল ৪২ কোটি ৯৯ লাখ ৭১ হাজার টাকা। পরে প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ৪৯ কোটি ৯৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। সমীক্ষা প্রকল্পের ৪৯ কোটি ৩০ লাখ ৯০ হাজার টাকা যায় পরামর্শকের পকেটে।
এছাড়া বিজ্ঞাপনে ৮ লাখ, গাড়িভাড়ায় ৩৩ লাখ ১৫ হাজার, অফিস স্টেশনারি ও অন্য খরচ ৮ লাখ, সম্মানি ৮ লাখ, ভ্রমণ ভাতা ৪ লাখ এবং প্রকল্প ম্যানেজমেন্ট ইউনিটের (পিএমইউ) জন্য অফিস উপকরণে ৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ করা হয়। প্রকল্পটির আওতায় পায়রা বন্দর থেকে আরও ২৪ কিলোমিটার লাইন নির্মাণের মাধ্যমে কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে সম্ভাব্যতা সমীক্ষাসহ জরিপ ও পথ নকশা নির্ধারণের কাজ শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন: বিশ্বব্যাংকের ৪২৭৫ কোটি টাকা ঋণের বাধা কাটছে
রেলপথ নির্মাণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস. এম. সলিমুল্লাহ বাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শেষে প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৪১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা। প্রথমে সিঙ্গেল লাইন রেলপথ নির্মাণ করা হবে, তবে ডাবল লাইনের প্রভিশনও থাকবে। রেলপথটি নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের একটা মাইল ফলক সৃষ্টি হবে। পদ্মা সেতুর সঠিক সুফল মিলবে এই রেলপথটি নির্মাণের মাধ্যমে।’
এমওএস/এসএইচএস/জেআইএম