জাতীয়

‘রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের চীননির্ভরতার বদল দরকার’

আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস বিষয়ক গবেষক। মূলত স্বাধীন গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ১০টি। ‘অরাজ’সহ বিভিন্ন জার্নালে নিয়মিত লেখেন।

Advertisement

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে পড়াশোনা। ছাত্রাবস্থায় সামরিকজান্তাবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সমর্থনে ডাকসুর সদস্য নির্বাচিত হন তখন। বর্তমানে আগ্রহের জায়গা রাষ্ট্রপ্রশ্ন এবং দক্ষিণ এশিয়ার এথনো-পলিটিক্স।

রোহিঙ্গা ফেরত প্রসঙ্গে চীনের ভূমিকা নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

Advertisement

জাগো নিউজ: রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার উদ্যোগে চীন এখন যে ভূমিকা রাখছে, তা কীভাবে মূল্যায়ন করা যায়?

আলতাফ পারভেজ: রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে মিয়ানমারে একটা নির্মম বাস্তবতার শিকার হয়ে। সেই বাস্তবতার বদল না ঘটিয়ে তাদের আবার সেখানে যেতে বলা বা পাঠানোর চেষ্টা উৎসাহব্যঞ্জক কোনো খবর নয়। চীনের দূতায়ালিতে যদি এরকম কিছু ঘটে তা রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার জন্য আগ্রহী করবে বলে মনে হয় না।

একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যায়। রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারে উৎপীড়নের শিকার হয় তার একটা বড় কারণ সেখানকার নাগরিকত্ব আইনে তাদের সে দেশের নাগরিক হিসেবে অধিকারচ্যুত করা হয়েছে। এখন ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের শান্তিতে থাকতে হলে ওখানে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করতে হবে। চীন কিন্তু মিয়ানমারকে এ বিষয়ে কোনো চাপ দিয়েছে বলে জানা যায় না।

আরও পড়ুন>>কিছু রোহিঙ্গা নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে জাপান: রাষ্ট্রদূত

Advertisement

মিয়ানমারের ওপর তাদের বেশ প্রভাব আছে। তারা আন্তরিক হলে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরার পরিবেশ আরও আগেই ভালোভাবে নিশ্চিত হতে পারতো। কিন্তু চীন পাঁচ বছর ধরে রোহিঙ্গা বিষয়ে মিয়ানমারের জান্তার অবস্থানকেই সমর্থন দিয়ে এসেছে। ফলে তার দূতায়ালিতে যে কোনো প্রত্যাবর্তন উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাসী করে রাখবে। বাংলাদেশেরও এ বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি।

জাগো নিউজ: ১০ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে কয়েক হাজার ফেরত নেওয়ার মধ্য দিয়ে সংকট কোন দিকে মোড় নিতে পারে?

আলতাফ পারভেজ: ১০ লাখ রোহিঙ্গার ক্যাম্পগুলোতে প্রতি মাসে দুই-তিন হাজার নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে। আর প্রত্যাবর্তনের কথা শোনা যাচ্ছে এক-দুই হাজারের। অর্থাৎ, প্রতীকী একটা প্রত্যাবর্তন কর্মসূচির কথা শুনছি আমরা। সমস্যা হলো লাখে লাখে— সমাধান চিন্তা হচ্ছে হাজারে। এই টোকেন উদ্যোগ কেন? কারা এ থেকে লাভবান হবে? যে কেউ সহজে বুঝতে পারবে, এরকম টোকেন কর্মসূচি দিয়ে মিয়ানমার সরকার তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কমাতে চাইছে কেবল। যেহেতু প্রত্যাবর্তনের জন্য মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি মোটেই সহনীয় হয়নি, সুতরাং রোহিঙ্গারা আশাবাদী হবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক মহলও এ ধরনের টোকেন উদ্যোগে শামিল হবে বলে মনে হয় না। জাতিসংঘকে বাদ দিয়ে এরকম উদ্যোগ নেওয়া হলে তার ভিত্তিও দুর্বল থেকে যাবে।

আরও পড়ুন>>রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে অর্থনৈতিক ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে

জাগো নিউজ: চীনের এমন উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কোনো বার্তা মিলছে কি না?

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ায় ঠান্ডাযুদ্ধের নানান আলামত আমরা সবাই দেখছি। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এখানে নানাভাবে তাদের প্রভাব বলয় বাড়াতে চাইছে। সেটা অস্বাভাবিক নয়। বাংলাদেশকেও সব সময় তার স্বার্থে অগ্রাধিকার দিতে হবে—এটাও স্বাভাবিক।

আমরা দেখেছি, তীব্র আন্তর্জাতিক জনমত সত্ত্বেও চীন গত পাঁচ বছর লজ্জাহীনভাবে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের মদত দিয়ে গেছে সব বিষয়ে। এটাও অস্বাভাবিক নয়। কারণ মিয়ানমারের চলতি অগণতান্ত্রিক সরকারকে তার দরকার। সুতরাং, নৈতিকভাবে চীনের নিন্দা করে তো লাভ নেই। প্রশ্ন হলো, চীনের এই স্বার্থের খেলায় বাংলাদেশ তার স্বার্থ বিসর্জন দেবে কি না? নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার কাছেও বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া ঠিক হবে না। প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গা বিষয়ে আমরা কার সঙ্গে বন্ধুত্বে লাভবান হবো? গত পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা কী বলছে? একটা দেশকে তো তার অভিজ্ঞতা থেকেই ভবিষ্যৎ নীতি-কৌশল ঠিক করতে হবে? আমরা কি তাই করছি?

জাগো নিউজ: মিয়ানমার জান্তা সরকারের চোখে রোহিঙ্গা ইস্যু এখন কীভাবে দেখা হচ্ছে?

আলতাফ পারভেজ: ২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের হত্যা-ধর্ষণের সময় দেশটির সশস্ত্র বাহিনী রোহিঙ্গাদের যেভাবে দেখতো এখনো সেভাবেই দেখে। তারা কি কোথাও তাদের অবস্থান পরিবর্তনের কথা বলেছে? কেউ কি সেরকম কিছু দেখাতে পারবে? মিয়ানমার সরকার, সেখানকার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের এখনো সে দেশের নাগরিক মনে করে না। প্রশ্ন হলো তাহলে কোন বিবেচনায় বিশ্বসমাজ রোহিঙ্গাদের তাদের হাতে তুলে দেবে? কোন ভরসায় রোহিঙ্গারা সেখানে যাবে?

জাগো নিউজ: বাংলাদেশ সরকার এখন কী করতে পারে?

আলতাফ পারভোজ: রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিকৌশল গত পাঁচ বছর সুবিধাজনক ফল দেয়নি। অর্থাৎ, রোহিঙ্গাদের আমরা ফেরত পাঠাতে পারিনি। সুতরাং, আমাদের পুরো বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনা করতে হবে এবং নীতিকৌশল পাল্টাতে হবে। যদি আমরা আদৌ আশ্রয় শিবির থেকে মানুষগুলোকে ফেরত পাঠাতে চাই। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অতি ধূর্ত এবং বর্ণবাদী একটা সংস্থা। এই সত্য উপলব্ধি না করলে আমরা বারবার বোকা বনতে থাকবো।

আরও পড়ুন>>রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেড়েছে খুন, টার্গেটে ‘মাঝি-স্বেচ্ছাসেবক’

জাগো নিউজ: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুনে নাশকতার প্রমাণ মিলছে। কোনো বিশ্লেষণ আছে কি না?

আলতাফ পারবেজ: রোহিঙ্গাদের একটা বড় দুর্ভাগ্যের কারণ তাদের কোনো পরিণত রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। বাংলাদেশও এ বিষয়ে তাদের গত পাঁচ বছরে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারেনি। সম্প্রতি এ বিষয়ে কিছু উদ্যোগ নিয়েছিল রোহিঙ্গা তরুণরা। ফলে এই জনগোষ্ঠীর ভেতরকার কায়েমি স্বার্থবাদী সন্ত্রাসীরা খুনোখুনিতে মেতে উঠেছে। যখনই কোনো রোহিঙ্গা সংগঠকের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে তাকে হত্যা করা হচ্ছে। ক্যাম্পবাসী জানাচ্ছে, ওই সন্ত্রাসীরাই এখন ক্যাম্পগুলোতে আগুন দিচ্ছে তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে। নিরাপত্তা বাহিনী এ অবস্থা সামাল দিতে পারছে না। এর সমাধান হলো রোহিঙ্গাদের ভেতর থেকে ব্যাপকভিত্তিক নেতৃত্ব ও সংগঠন তৈরি।

আরও পড়ুন>> রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ভয়াবহ আগুনে পুড়লো ২ হাজার ঘর

জাগো নিউজ: কী আছে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে?

আলতাফ পারভেজ: রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে অসহায়ভাবে আছে। তাদের ভাগ্য এখন বাংলাদেশ ও বিশ্বসমাজের হাতে। এটা দুর্ভাগ্যের দিক যে, বিশ্বসমাজ পাঁচটি বছর পরেও মিয়ানমারের নিপীড়ক শাসকদের রোহিঙ্গা প্রশ্নে বিচার শেষ করতে পারেনি। আশ্রয় শিবিরের মানুষগুলোকেও ফেরত পাঠাতে পারেনি। এ অবস্থার বড় এক দায় অবশ্যই গণচীনের। কারণ এই দুই উদ্যোগে তারা পুনঃপুনঃ মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে—অসহায় রোহিঙ্গাদের পক্ষ নয়।সুতরাং, রোহিঙ্গা বিষয়ে বাংলাদেশের চীননির্ভরতার বদল দরকার।

এএসএস/এএসএ/এমএস