ধর্ম

রমজানের প্রস্তুতি নেবেন কীভাবে?

সচেতন ব্যক্তিরা রমজান মাসের রোজা ও ইবাদত-বন্দেগির জন্য আগে থেকেই সঠিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এমনকি তাদের কেউ কেউ এর আগে (রজব মাস) থেকেই প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। রমজান মাস উপলক্ষে প্রস্তুতি নেয়ার কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো-

Advertisement

১. খাঁটি তওবা

তওবা সব সময়ের জন্যই আবশ্যক। তবে যেহেতু এক মহান বরকতময় মাস রমজানের আগমন। তাই এ মাসে বান্দার ও রবের মাঝে যে গুনাহগুলো সম্পর্কিত তা থেকে তওবা করা। যে গুনাগুলো মানুষের অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে ক্ষমা নিয়ে তওবা করা উত্তম। যাতে করে সে এই বরকতময় রমজান মাসে পবিত্র মন ও প্রশান্ত হৃদয় নিয়ে ইবাদাত ও আল্লাহর আনুগত্যে প্রবেশ করা যায়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ

Advertisement

‘আর তোমরা সবাই, হে মুমিনেরা!, আল্লাহর কাছে তওবা কর যাতে করে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সুরা আন-নুর: আয়াত ৩১)

হজরত আগার ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

وعَنْ الأَغَرَّ بن يسار رضي الله عنه عن النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّي أَتُوبُ فِي الْيَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ

‘হে লোক সকল! আপনারা আল্লাহর কাছে তওবা করুন। কারণ আমি দিনে তাঁর কাছে ১০০ বার তওবা করি।’ (মুসলিম ২৭০২)

Advertisement

২. আমল কবুলের দোয়া করা

একজন মুসলিম তার রবের কাছে দোয়া করবে যাতে তিনি তাকে রমজান মাস পাওয়ার তাওফিক দেন। রমজানে সর্বোত্তম দ্বীনি অবস্থা ও শারীরিক সুস্থতার মাঝে থাকতে পারেন। আর তাঁর কাছে এই দোয়া করা যাতে তিনি তাকে তাঁর আনুগত্যে সাহায্য করেন। তাঁর কাছে এই দোয়া করা যাতে তিনি তার আমল কবুল করেন।

কোনো কোনো সাহাবি ও তাবেঈগণ থেকে বর্ণিত আছে, তাঁরা ৬ মাস ধরে আল্লাহর কাছে এই দোয়া করতেন, যাতে তিনি তাঁদের রমজান মাস পাওয়ার তাওফিক দেন, এরপর (রমজান শেষে) ৫ মাস ধরে এই দোয়া করতেন, যেন (রমজানের আমলসমূহ) তাদের কাছ থেকে কবুল করা হয়।

৩. রমজানের আগমনে আনন্দিত হওয়া

রমজান মাসের আগমন একজন মুসলিম বান্দার প্রতি আল্লাহর সুমহান নেয়ামতগুলোর (অনুগ্রহসমূহের) একটি। কারণ রমজান কল্যাণময় একটি মৌসুম। এ মাসে জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ জন্য মাসটির আগমনে আনন্দিত হওয়া। এটি হলো কোরআন নাজিলের মাস, মুমিন মুসলমানের দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ ও চূড়ান্ত সংগ্রামের মাস। আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

قُلۡ بِفَضۡلِ ٱللَّهِ وَبِرَحۡمَتِهِۦ فَبِذَٰلِكَ فَلۡيَفۡرَحُواْ هُوَ خَيۡرٞ مِّمَّا يَجۡمَعُونَ

‘বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর দয়ায়, অতঃপর এর দ্বারা তারা আনন্দিত হোক; তা, তারা যা সঞ্চয় করে তা থেকে উত্তম।’ (সুরা ইউনুস: আয়াত ৫৮)

৪. কাজা ওয়াজিব রোজা থেকে নিজেকে মুক্ত করা

হজরত আবু সালামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলতে শুনেছি-

كَانَ يَكُونُ عَلَيَّ الصَّوْمُ مِنْ رَمَضَانَ فَمَا أَسْتَطِيعُ أَنْ أَقْضِيَهُ إِلا فِي شَعْبَانَ

‘আমার উপর বিগত রমজানের রোজা বাকি থাকত যার কাজা আমি শাবান ছাড়া আদায় করতে পারতাম না।’ (বুখারি ১৮৪৯ ও মুসলিম ১১৪৬)

হাফিজ ইবনু হাজার রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, ‘এ হাদিস দ্বারা হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক শাবান মাসে রমজানের কাজা রোজা পালনের চেষ্টা প্রমাণ করে যে, এক রমজান এর কাজা আরেক রমজান প্রবেশ করা পর্যন্ত দেরি করা জায়েয নয়।’ (ফাতহুল বারি ৪/১৯১)

৫. রোজার হুকুম-আহকাম জানা

রমজান ও রোজা সম্পর্কে পর্যাপ্ত ইলম (জ্ঞান) অর্জন করা, যাতে রোজার হুকুম-বিধি-বিধান এবং রমজান মাসের মর্যাদা সম্পর্কে জানা যায়।

৬. রোজার আগে ক্ষতিকর কাজ থেকে মুক্ত হওয়া

রমজান মাসের ইবাদাত নষ্ট করতে পারে কিংবা একজন মুসলিমকে রোজার ভালো কাজ থেকে বিরত করতে পারে এমন কাজসমূহ দ্রুত সম্পন্ন করে ফেলা।

৭. পরিবারকে রোজার জন্য প্রস্তুত করা

পরিবারের সদস্যবর্গ যেমন-স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে বসে তাদের রোজার বিধি-বিধান শিক্ষা দেওয়া এবং ছোটদের রোজা পালনে উৎসাহিত করা।

৮. ইসলামি বই সংগ্রহ করা

কিছু ইসলামি বই প্রস্তুত করা যা বাড়িতে বসে পড়া সম্ভব। আবার মাসজিদের ইমামকে কিছু ইসলামি বই উপহার দেওয়া, যা তিনি রমজান মাসে লোকদের পড়ে শোনাবেন।

৯. শাবান মাসে রোজা রেখে প্রস্তুতি নেওয়া

 রমজান মাসের প্রস্তুতিস্বরূপ শাবান মাস থেকেই রোজা রাখা শুরু করা। হাদিসে পাকে এসেছে, হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেছেন-

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَصُومُ حَتَّى نَقُولَ لا يُفْطِرُ وَيُفْطِرُ حَتَّى نَقُولَ لا يَصُومُ، فَمَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اسْتَكْمَلَ صِيَامَ شَهْرٍ إِلا رَمَضَانَ، وَمَا رَأَيْتُهُ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ

‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনভাবে রোজা পালন করতেন যে আমরা বলতাম তিনি আর রোজা ভঙ্গ করবেন না এবং এমনভাবে রোজা ভঙ্গ করতেন যে আমরা বলতাম, তিনি আর রোজা পালন করবেন না। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রমজান ছাড়া অন্য কোন মাসের গোটা অংশ সাওম পালন করতে দেখিনি এবং শাবান ছাড়া অন্য কোনো মাসে অধিক রোজা পালন করতে দেখিনি।’ (বুখারি ১৮৬৮ ও মুসলিম ১১৫৬)

হজরত উসামাহ ইব্‌ন যাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, আমি বললাম-

يَا رَسُولَ اللَّهِ لَمْ أَرَكَ تَصُومُ شَهْرًا مِنْ الشُّهُورِ مَا تَصُومُ مِنْ شَعْبَانَ ، قَالَ: (ذَلِكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ بَيْنَ رَجَبٍ وَرَمَضَانَ ، وَهُوَ شَهْرٌ تُرْفَعُ فِيهِ الأَعْمَالُ إِلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ فَأُحِبُّ أَنْ يُرْفَعَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ

‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি আপনাকে শাবান মাসের মত অন্য কোনো মাসে এত রোজা পালন করতে দেখিনি। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘এটি রজব ও রমজানের মধ্যবর্তী একটি মাস, যখন মানুষ গাফিল হয় এবং এমন মাস যখন আমলসমূহ রাব্বুল আলামিনের কাছে উঠানো হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে আমার আমল আমি রোজা পালন রত অবস্থায় উঠানো হবে।’ (নাসাঈ ২৩৫৭)

১০. কোরআন তেলাওয়াত করা

হজরত সালামাহ ইবন কুহাইল বলেছেন, ‘(রমজানের আগে) শাবান মাসকে ক্বারীগণের মাস বলা হতো।’

হজরত আম্‌র ইবনে কাইস রাহমাতুল্লাহি আলাইহি শাবান মাস শুরু হলে, তাঁর দোকান বন্ধ করে কোরআন তিলাওয়াতের জন্য অবসর নিতেন।

হজরত আবু বাকর আল-বালাখি বলেছেন, ‘রজব মাস হল বীজ বপনের মাস, শাবান মাস হল ক্ষেতে সেচ প্রদানের মাস এবং রমজান মাস হল ফসল তোলার মাস।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘রজব মাসের উদাহরণ হল বাতাসের ন্যায়, ‘শাবান মাসের উদাহরণ মেঘের ন্যায়, রমজান মাসের উদাহরণ বৃষ্টির ন্যায়; তাই যে রজব মাসে বীজ বপন করল না শাবান মাসে সেচ প্রদান করল না, সে কীভাবে রমজান মাসে ফসল তুলতে চাইতে পারে?’

হে মুসলিম উম্মাহ! রজব মাস গত হয়েছে, শাবান মাসের আর এক সপ্তাহ বাকি আছে। যদি রমজান মাস পেতে চান? তাহলে রমজানের রোজা পালন ও ইবাদত-বন্দেগির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে রমজানের রোজা ও ইবাদত-বন্দেগির জন্য প্রস্তুতি যথাযথভাবে প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফিক দান করুন। আমিন।

এমএমএস/এএসএম