মতামত

কাদের কারসাজিতে কেজিতে ১০০ টাকা মূল্যবৃদ্ধি?

জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় সংকটে আছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষ। অন্যদিকে আয় না বাড়ায় জীবনযাপনের খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ।

Advertisement

চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ, মাংস, সবজি থেকে শুরু করে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। বাড়তি ব্যয়ের চাপ সামাল দিতে নিত্যদিনের খাদ্যতালিকা থেকে কাটছাঁট হচ্ছে অনেক কিছু। অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এই অবস্থা থেকে কবে মুক্তি পাবো, এই প্রশ্ন আজ সবার।

গত এক বছর ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছেই। একই সঙ্গে বেড়েছে বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া। পাইপলাইনের গ্যাসের দাম বেড়েছে, এলপিজি গ্যাসের দাম বেড়েছে, সর্বশেষ এক মাসে দুবার বাড়লো বিদ্যুতের দাম। কিন্তু সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়েনি।

অনেক কাটছাঁট করে চলার পরও হাতে টাকা থাকছে না। বিদ্যুতের দাম বাড়া মানে সবকিছুর দাম আবার বাড়বে, যা জনগণের ওপর চাপ ছাড়া আর কিছু নয়। এক দফায় মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর আরেক দফা মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণা আসছে। কাজেই মূল্যবৃদ্ধির এ সাইকেল সহসা থামছে না বলেই মনে হচ্ছে।

Advertisement

২০২২ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ১০ দশমিক ০৮ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনটির এর আগের বছরের (২০২১) হিসাব অনুযায়ী জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল ৬ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ হিসাবে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার হার ৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। ২০২৩ সালে এই সূচক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে।

মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে ব্রয়লার মুরগি। বিক্রি হচ্ছে ২৫০-২৬০ টাকায়। ব্রয়লার মুরগি ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদন খরচের চেয়ে প্রতি কেজি মুরগি খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ দামে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদনে খরচ হয় করপোরেট পর্যায়ে ১৩০-১৪০ টাকা।

তবে খুচরা খামারি পর্যায়ে এই খরচ হয় ১৫০-১৬০ টাকা। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের এক মতবিনিময় সভায় এই তথ্য উঠে এসেছে। কথা হচ্ছে, কাদের কারসাজিতে প্রতি কেজিতে ১০০ টাকা দাম বাড়ছে? এটা বুঝতে পারা কি খুব কঠিন? প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলেছে, ২০২১ সালের অক্টোবরে মানুষের আয় বেড়েছিল ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত বছরের অক্টোবরে আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৯১ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে আয় বেশি বেড়েছে ০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। একই সময়ের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৭০ থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ হয়েছে। তবে পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই হিসাব (মূল্যস্ফীতি ও আয় বাড়ার তথ্য) নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একাধিক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা। প্রতিটি মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করেই দেখুন, আপনার আয় কতোটা বেড়েছে।

Advertisement

সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। এতে নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। ব্যয় বাড়ার অসংখ্য কারণ আছে, যা আমরা অনেকেই জানি। ব্যবসায়ীদের লোভ বেড়ে গেছে। তারা বেশি মুনাফা করছে। কম মুনাফায় এখন আর তারা সন্তুষ্ট নয়।

এর প্রভাব শেষ পর্যন্ত ভোক্তার ওপর পড়ছে। ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেল, গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি এসব নানা কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। এতে মানুষের ব্যয়ও বাড়ছে। কিন্তু আয় বাড়েনি। বরং অনেক ক্ষেত্রে মানুষের আয় কমেছে।

মানুষের আয়-রোজগার যখন বাড়ে তখন নিত্যপণ্যের মূল্য বাড়লেও তা সহনীয় হয়। কিন্তু অনেক মানুষের আয়-রোজগার বাড়েনি। কর্মজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থা বেশি সংকটাপন্ন। গত বছর খারাপ গেছে, এই বছর ভালো যাবে, তারও কোনো আশার আলো দেখছি না। আমাদের দেশে ভোক্তারা সংগঠিত নয়। আবার তাদের সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব যাদের হাতে তারাই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখি হচ্ছে, সবাই বলছে, সরকার সবক্ষেত্রে সফলতা দাবি করলেও বাজারে এসে ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু হায় হায় করলেই তো হবে না। মানুষকে তো বাঁচাতে হবে। কীভাবে সাধারণ মানুষকে একটু ভালো রাখা যায় তার উপায় বের করতে হবে। মানুষ এটুকু বিশ্বাস করে যে, সরকারের আন্তরিকতার অভাব নেই। বাজারেও এর প্রতিফলন দেখতে চায় মানুষজন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে পর্যাপ্তভাবে কাভার করার জন্য যথাযথ পরিবীক্ষণের সঙ্গে ওএমএস কার্যক্রম শক্তিশালী করা উচিত।

দেশে এক কোটি পরিবারকে খাদ্য সহায়তা আরও বাড়ানো উচিত। দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতাও বাড়াতে হবে। এছাড়া অস্থায়ীভাবে আওতা বাড়ানোর মাধ্যমে খাদ্য, খাদ্যবহির্ভূত মৌলিক পণ্য এবং দুস্থ জনগোষ্ঠীর কাছে নগদ টাকা হস্তান্তর কর্মসূচি বাড়ানো উচিত।

যেহেতু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর তুলনায় শহুরে জনগোষ্ঠী মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি চাপ এবং অসহায়ত্বের সম্মুখীন হচ্ছে, তাই সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করার মাধ্যমে শহুরে নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতি আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। এ ছাড়া শহুরে নিম্ন মধ্যম ও মধ্যম আয়ের পরিবারের জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা স্কিম তৈরি করা উচিত, যাতে তারা সফলভাবে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়।

মৌলিক জ্বালানি পণ্য, বিশেষ করে ডিজেলের ওপর আবার ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে, কারণ এটি সেচ এবং জনসাধারণ ও পণ্য পরিবহন খরচের একটি বড় অংশ নির্ধারণ করে। এছাড়া বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পর্যবেক্ষণ বাড়ানো উচিত। সবাই বলে, সরকারের লোকেরাই জিনিসের দাম বাড়ায়।

সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কোথাও মেলে না তেল, চিনি, আটা। সেক্ষেত্রে সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ক্যাব ও গণমাধ্যমকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/ফারুক/এএসএম