#বিপিসির বিটুমিন দেশে সবচেয়ে মানসম্মত#উৎপাদন কম হওয়ায় তদবির বেশি #সিন্ডিকেটে বিপিসির কর্মকর্তারা#প্রকল্পের নামে বরাদ্দ নিয়ে বাইরে বিক্রি#দাম বাড়িয়েও কমানো যাচ্ছে না তদবির
Advertisement
দেশে চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ বিটুমিন উৎপাদিত হয় ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল)। এটি জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ইআরএলের বিটুমিন মানসম্মত। আমদানি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত বিটুমিনের সঙ্গে ইআরএলের বিটুমিন মিশিয়ে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়। বিপিসির আওতাধীন এ প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত বিটুমিনের চাহিদা বেশি। ফলে বড় প্রকল্পগুলো ইআরএলের বিটুমিন পেতে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিপিসিতে তদবির করে।
অভিযোগ উঠেছে, মানসম্মত ও অতিরিক্ত চাহিদা থাকার সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীদের সঙ্গে বিটুমিন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন বিপিসির পরিচালক থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীও। এতে সিন্ডিকেটে বন্দি হয়ে পড়েছে সরকারি বিটুমিন। অতিরিক্ত অর্থ দিয়েও ইআরএলের এ বিটুমিন পাচ্ছেন না ঠিকাদাররা। হাত ঘুরলেই বেড়ে যাচ্ছে দাম। বিটুমিন বিপণন ও সরবরাহে যুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং মধ্যস্বত্বভোগীরা বাড়তি লাভের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন।
বিটুমিন সরবরাহে বিদ্যমান নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য বিপিসি একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির দেওয়া প্রতিবেদনে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য ও প্রকল্পের নামে বিটুমিন নিয়ে বাইরের ঠিকাদারদের কাছে বিক্রির করার বিষয়টি উঠে এসেছে। জাগো নিউজের অনুসন্ধানেও এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
Advertisement
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৮-১০ লাখ টন বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি পর্যায়ে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে বিটুমিন উৎপাদিত হয় ৬০-৬৫ হাজার মেট্রিক টন। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের চাহিদা অনুযায়ী- বিপিসির জ্বালানি বিপণনকারী অঙ্গ প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, যমুনা অয়েল কোম্পানি, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) এবং ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস ব্লেন্ডার্স লিমিটেড (ইএলবিএল) এ বিটুমিন সরবরাহ করে। বিটুমিন সরবরাহের জন্য প্রত্যেক বিপণন কোম্পানির নিজেদের ‘বিটুমিন বরাদ্দ কমিটি’ রয়েছে।
আরও পড়ুন>> ২০ হাজার কোটি টাকায় নতুন রিফাইনারি করছে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন
বিপিসির তথ্যানুযায়ী, সড়ক বিভাগের চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জোন এবং খুলনা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনের উন্নয়নকাজের বিটুমিন দেওয়া হয় পদ্মা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমে। সড়ক বিভাগের রংপুর ও রাজশাহী জোন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আওতাধীন জেলা এবং ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর সিটি করপোরেশনকে বিটুমিন সরবরাহ দেওয়া হয় মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মাধ্যমে।
সড়ক বিভাগের খুলনা, বরিশাল ও গোপালগঞ্জ জোন এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগের আওতাধীন জেলাগুলোতে বিটুমিন দেওয়া হয় যমুনা অয়েল কোম্পানির মাধ্যমে। সড়ক বিভাগের সিলেট জোন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের সিলেট বিভাগের জেলাগুলো এবং সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমানবাহিনী, বন্দর কর্তৃপক্ষ, পৌরসভা ও গণপূর্তের জন্য বিটুমিন দেওয়া হয় এসএওসিএলের মাধ্যমে। এছাড়া গাজীপুর, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের জন্য বিটুমিন বরাদ্দ দেয় ইএলবিএল।
Advertisement
এদিকে, ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত বিটুমিনের সরবরাহে প্রকৃত গ্রাহকদের বিটুমিন প্রাপ্যতা এবং যথাযথ প্রকল্পে ব্যবহার নিশ্চিতকল্পে বিদ্যমান নীতিমালা পর্যালোচনার জন্য গত বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে বিপিসি। কমিটিতে বিপিসির বিপণন বিভাগের পরিচালককে আহ্বায়ক করা হয়। এ কমিটিকে মতামতসহ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। গত ২৮ ডিসেম্বর বিপিসির চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় নীতিমালা পর্যালোচনা কমিটি।
প্রতিবেদনের একাংশে উল্লেখ করা হয়, ‘একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন প্রকল্প ও কাজের বিটুমিন বিতরণকারী কোম্পানি থেকে সরবরাহ নিয়ে থাকে। ফলে একই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে একাধিকবার বিটুমিন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মর্মে জনমনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।’
আরও পড়ুন>> গুণগত মান যাচাই করেই বিটুমিন আমদানি
আরেক অংশে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রায়ই মূল ঠিকাদার বিতরণ কোম্পানির কাছ থেকে বিটুমিন না নিয়ে তার প্রতিনিধি মনোনয়ন দেন। ওই প্রতিনিধি কোম্পানি থেকে বিটুমিন নিয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের প্রকল্পের স্থানে পৌঁছানোর জন্য দায়বদ্ধ থাকেন। বিভিন্ন মাধ্যমে জনশ্রুতি রয়েছে যে, ঠিকাদারের প্রতিনিধিরা কোম্পানির কাছ থেকে নেওয়া বিটুমিন সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের স্থানে প্রেরণ না করে উচ্চমূল্যে অন্যদের কাছে বিক্রি করেন।’
বিটুমিন সরবরাহে গতিশীলতা আনতে নীতিমালা পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদন জমার পর গত ২৫ জানুয়ারি বিপিসি চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে সভা হয়। সভায় সরকারি বিটুমিন বিপণনের অনিয়ম নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত বিটুমিনের (সরকারি) মান আমদানি করা বিটুমিনের চেয়ে অনেক ভালো। এ বিটুমিনের চাহিদা সারা বছরই থাকে। অনেক ঠিকাদার আমদানি করা বিটুমিনের সঙ্গে ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিন মিশিয়ে রাস্তার উন্নয়নকাজে ব্যবহার করছে, যা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এ কারণে ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিনকে কেন্দ্র করে একটি বড় ও শক্ত সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে।’
সভায় বিপিসির মহাব্যবস্থাপক (বণ্টন ও বিপণন) আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘তেল বিপণন কোম্পানিগুলো কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিটুমিন বরাদ্দ দেয়। কমিটির সদস্যদের অনেকে ১০-১৫ বছর ধরে বিটুমিন বরাদ্দ কমিটিতে কাজ করছে। কমিটির কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে বিটুমিন বরাদ্দের ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ শোনা যায়। বিটুমিন বরাদ্দে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর বিটুমিন বরাদ্দ কমিটি প্রতি এক বছর পর পর পুনর্গঠন করা প্রয়োজন।’
ছবি: সংগৃহীত
এদিকে, জাগো নিউজের অনুসন্ধানেও বিপিসির মহাব্যবস্থাপকের বক্তব্যের সত্যতা মিলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা অয়েলে বিটুমিন বরাদ্দ কমিটিতে প্রায় ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে আছেন প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদোন্নতি পাওয়া সহকারী ব্যবস্থাপক আরাফাতুল ইসলাম। বিটুমিন বরাদ্দের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার বিষয় অস্বীকার করেন তিনি। আরাফাতুল ইসলাম বলেন, ‘আমি কোনো পার্টির (ঠিকাদার) কাছ থেকে এক গ্লাস পানি কখনও খাইনি।’
মেঘনা পেট্রোলিয়ামে প্রায় ৯ বছর ধরে বিটুমিন বরাদ্দ কমিটিতে ছিলেন মুসলিম উদ্দিন। চার মাস আগে পদোন্নতি পাওয়ায় তাকে কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এসএওসিএলে ১২ বছর ধরে কমিটিতে আছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মীর মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১১ সাল থেকে আমি বিটুমিন বরাদ্দ কমিটিতে আছি। নিজ থেকে বিটুমিন বরাদ্দ দিতে পারি না। মণি লাল স্যার (কোম্পানির সিইও ও বিপিসির মহাব্যবস্থাপক) যেভাবে বলেন, সেভাবে বিটুমিন দিই।’ নির্ধারিত দরের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আপনি (প্রতিবেদক) মণি লাল স্যারের সঙ্গে কথা বলেন।’
জানতে চাইলে এসএওসিএলের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিপিসির মহাব্যবস্থাপক মণি লাল দাশ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের বরাদ্দ অনুযায়ী ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে প্রাপ্তি সাপেক্ষে নিয়ম অনুযায়ী আমরা বিটুমিন সরবরাহ দিয়ে থাকি। আমাদের এখানে অতিরিক্ত কোনো টাকা নেওয়া হয় না।’
জানা গেছে, বিপিসির বিটুমিন পেতে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সরকারি প্রকল্প হলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মনোনীত ব্যক্তিকে বিটুমিন দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট নির্বাহী প্রকৌশলী কিংবা প্রকল্প পরিচালক প্রতিনিধি মনোনয়ন করে। এজন্য প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদারের প্রতিনিধির ছবি, নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও মনোনীত প্রতিনিধির নমুনা সই সত্যায়িত করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের প্যাডে প্রত্যয়ন দেন প্রকল্প পরিচালক। ওই প্রতিনিধি বিপিসির বিপণন কোম্পানিগুলো থেকে বিটুমিন নিয়ে প্রকল্পের স্থানে পৌঁছে দেন। প্রত্যয়ন সঠিক কি না- তা যাচাইয়ের দায়িত্ব থাকে বিটুমিন বরাদ্দ কমিটির।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বেসরকারি বিটুমিন ব্যবসায়ী ও কমিশন এজেন্টরা সরকারি বিটুমিন ব্যবসায় জড়িয়েছেন। তারা বিপণন কোম্পানি ও বিপিসির কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে এক প্রকল্পের নামে বিটুমিন নিয়ে অন্য ঠিকাদারের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি করেন। সরকারি এসব বিটুমিন বেশি দামে কিনলেও গুণগত মানের কারণে বেসরকারিভাবে আমদানি করা বিটুমিনের সঙ্গে মিশিয়ে রাস্তা তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিপিসিতে ৮০-১০০ ও ৬০-৭০ দুই গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদিত হয়। বাল্কে ও ড্রামজাত করে বিটুমিন সরবরাহ করে ইস্টার্ন রিফাইনারি। বর্তমানে ৮০-১০০ বিটুমিনের প্রতি ড্রামের মূল্য ১২ হাজার ৩০০ টাকা, বাল্কে প্রতি টনের মূল্য ৭৬ হাজার টাকা। ৬০-৭০ গ্রেডের প্রতি ড্রামের মূল্য ১২ হাজার ৮০০ এবং বাল্কে টনপ্রতি দর নির্ধারিত আছে ৭৯ হাজার ৩০০ টাকা। গত ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে এ দর কার্যকর করে বিপিসি।
ড্রামজাত বিটুমিনের হিসাবে প্রতি ট্রাকে ৮৫ ড্রাম করে বিটুমিন সরবরাহ দেয় বিপণন কোম্পানিগুলো। বিটুমিন বরাদ্দ পাওয়া ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট ছাড়া কোম্পানিগুলো থেকে স্বাভাবিকভাবে বিটুমিন পাওয়া যায় না। বিটুমিনের দাম সম্প্রতি ওঠা-নামা করছে। এতে প্রতি ট্রাকে ৯০ হাজার থেকে তিন লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিনের প্রতি ট্রাকের জন্য ১০ লাখ ৮৮ হাজার টাকার পে-অর্ডার হিসেবে পরিশোধ করতে হয়। অতিরিক্ত টাকা নগদ পরিশোধ করা হয়।’ অতিরিক্ত এসব টাকা কোম্পানি থেকে বিপিসির বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয় বলে জানান ঠিকাদাররা।
অন্যদিকে ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিনের বেশি চাহিদার বিপরীতে জোগান কম থাকায় প্রকল্পের জন্য সঠিক সময়ে চাহিদামাফিক বিটুমিন পান না ঠিকাদাররা। ফলে বিভিন্ন সময় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অথবা প্রভাবশালী মন্ত্রীদের পিএস, এপিএসদের মাধ্যমে তদবির করে বিটুমিন ছাড়িয়ে নেন। মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরাও সুযোগ বুঝে বিটুমিন সংগ্রহ করে প্রকল্পের ঠিকাদারদের কাছে বেশি দামে সরবরাহ করেন। আবার এক প্রকল্পের নামে বিটুমিন তুলে অন্য ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেক কোম্পানিতে বিপিসির কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নামেও অলিখিতভাবে বিটুমিন বরাদ্দ থাকে। বিপিসির পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির প্রভাবশালী কর্মচারীর নাম রয়েছে বিটুমিন প্রাপ্তির তালিকায়।
আরও পড়ুন>> বাড়তি এলপিজি নিয়ে বিপাকে ইস্টার্ন রিফাইনারি!
এছাড়া এক প্রকল্পের বিটুমিন সংগ্রহে একজন প্রতিনিধি থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে ঘটছে উল্টো। একই ব্যক্তি একাধিক ঠিকাদারের প্রতিনিধি হিসেবে কোম্পানিগুলো থেকে বিটুমিন উত্তোলন করেন। এসব প্রতিনিধি বিটুমিন উত্তোলন করে অতিরিক্ত দামে বরাদ্দ না পাওয়া ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করে দেন।
চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যানকিন জেভি। চার হাজার ৩৬৯ কোটি টাকার প্রকল্পের জন্য সাত হাজার টন বিটুমিনের চাহিদা দিয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রায় ৭০০ টন বিটুমিন সরবরাহ দেও প্রকল্পটিতে। কিন্তু ঠিকাদারের প্রতিনিধি কোম্পানি থেকে বিটুমিন উত্তোলন করে যথাসময়ে প্রকল্পে সরবরাহ করেননি। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর বিপিসির চেয়ারম্যানকে দেওয়া প্রকল্পটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র্যানকিন জেভির জেনারেল ম্যানেজার মোজাহারুল ইসলাম লিমনের সই করা এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রকল্পের কাজে বিটুমিন উত্তোলন করে সরবরাহ করার জন্য রঞ্জন বড়ুয়া, মো. মারুফুল ইসলাম ও মোস্তফা কামালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্প কাজে উত্তোলন করা বিটুমিন যথাসময়ে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়ায় রঞ্জন বড়ুয়া, মারুফুল ও মোস্তফাকে ম্যাক্স-র্যানকিন জেভির বিটুমিন উত্তোলনকারীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘অব্যাহতির পরেও এ তিন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের (ম্যাক্স-র্যানকিন জেভি) নাম ব্যবহার করে নিজেদের ম্যাক্স-র্যানকিন জেভির পরিচালক (সংগ্রহ ও সরবরাহকারী) ও কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে প্রকল্পের কার্যাদেশ অনুযায়ী বরাদ্দ বিটুমিন উত্তোলনের চেষ্টা করছেন। যে কারণে প্রকল্পের যথাযথ কর্তৃপক্ষ হলেও আমাদের অনুকূলে প্রকল্পের জন্য বিটুমিন সরবরাহ বিলম্বিত হচ্ছে।’
গত ডিসেম্বরে রঞ্জন বড়ুয়াকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প থেকে বিটুমিন সংগ্রহকারী প্রতিনিধি হিসেবে বাদ দেওয়া হয়। তবুও চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে এক্সটেনশন কাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিওয়াইডব্লিউইবি-সিসিইসিসি জেভির (চাংজিয়াং ইচ্যাং ওয়াটারওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো- সিওয়াইডব্লিউইবি ও চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন-সিসিইসিসি) প্রতিনিধি হিসেবে ইএলবিএল থেকে বিটুমিন তিনি উত্তোলন করছেন।
আরও পড়ুন>> সড়কের কাজ শেষ না হতেই উঠে গেল বিটুমিন
একাধিক ঠিকাদারের একই প্রতিনিধিকে বিটুমিন সরবরাহের বিষয়ে জানতে চাইলে ইএলবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক কিংবা নির্বাহী প্রকৌশলী প্রতিনিধি মনোনয়ন দেন। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। আর এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) থাকলে, মনোনয়ন দেওয়া হলে তাদেরও বিটুমিন সরবরাহ দিতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।’ একই ব্যক্তি একাধিক ঠিকাদারের প্রতিনিধি হলে কোনো অনিয়ম হয় কি না, জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করেননি।
ঠিকাদারের প্রতিনিধি হিসেবে কোম্পানি থেকে বিটুমিন সংগ্রহে নিয়োজিত রঞ্জন বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা পরিবহনের কাজ করি। শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের নয়, অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে বিপিসি থেকে বিটুমিন উত্তোলন করি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মীর আকতার হোসেন লিমিটেড, আবদুল মোনায়েম লিমিটেড, এম এম বিল্ডার্স সবাই আমাদের কাছ থেকে বিটুমিন নেয়। তাদের লোকেরা এসে বিটুমিন রিসিভ করতে পারেন না। এজন্য আমাদের অথরাইজড হিসেবে দিয়ে দেন। আমরা ক্যারিং কন্ট্রাক্টরের কাজ করি। আমাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। আমদানি করা বিটুমিনও ঠিকাদারদের সরবরাহ দিয়ে থাকি।’
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড/ছবি: সংগৃহীত
ম্যাক্স-র্যানকিনের চিঠির বিষয়ে তিনি জানেন না বলে দাবি করেন। তবে অভিযোগ থাকলে বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান রঞ্জন বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘বিপিসির বিটুমিন সংগ্রহের প্রতিনিধি হিসেবে বাদ দেওয়া হলেও ম্যাক্স-র্যানকিন আমাদের প্রতিষ্ঠান রহমান করপোরেশন থেকে গতকালও (৫ মার্চ) বিটুমিন নিয়েছে।’ কোম্পানি থেকে বিটুমিন ছাড়াতে অতিরিক্ত কী পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো আসলে মোবাইলে বলা যায় না। অনলাইনে বললে ঝামেলা।’তবে বিষয়টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ম্যানেজ (সামলান) করেন বলে দাবি তার।
আরও পড়ুন>> আলোর মুখ দেখছে ইস্টার্ন রিফাইনারির ২য় ইউনিট, খরচ ২৩ হাজার কোটি
শুধু রঞ্জন বড়ুয়া নন, বিপিসির বিটুমিন সিন্ডিকেটে আরও অনেকের নাম পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোস্তফা কামাল, মোহাম্মদ আলী লিটন, কামরুল, পারভেজ, সাদেক, ওমর ফারুক, নুর মোহাম্মদসহ আরও কয়েকজন সরকারি বিটুমিনের কারবারে জড়িত। তাদের অনেককে ‘বিটুমিন ডন’ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়।
বিপিসির পরিচালক (বিপণন) অনুপম বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে যে নীতিমালায় বিটুমিন সরবরাহ ও বিপণন চলছে, তা আধুনিকায়ন করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরইমধ্যে কমিটির প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে। নীতিমালার খসড়া তৈরি করা হয়েছে।’
বর্তমানে বিটুমিন সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগী রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিটুমিন ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেট অনেক পুরোনো। আমরা সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি। এজন্য বিটুমিনের দাম অনেক বাড়িয়ে দিয়েছি, যাতে তদবির না আসে। তারপরও দেখছি তদবির আসছে। হয়তো এখনও কেউ জড়িত থাকতে পারেন। যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কামরুল নামের এক মধ্যস্বত্বভোগীর সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়টি এড়িয়ে যান এ পরিচালক। তিনি বলেন, ‘আমি বিপিসিতে এসেছি অল্প কিছু দিন হলো।’
বিটুমিন সরবরাহে অতিরিক্ত টাকা লেনদেনের বিষয়ে অনুপম বড়ুয়া বলেন, ‘এগুলো গণমাধ্যমে আসা প্রয়োজন। তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবো।’
বিটুমিনের জন্য মন্ত্রী পর্যায় থেকে তদবিরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী সরাসরি ফোন করেন না। অনেক সময় মন্ত্রীর পিএস ফোন করেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে তদবির আসে। অন্য বিভিন্ন জায়গা থেকেও তদবির আসে। আমরা সবসময় গ্রাহ্য করি না। আবার অনেক সময় তদবির রাখতেও হয়।’
ইকবাল হোসেন/এএএইচ/এসএইচএস/এএসএম