এ বছর হজ গমনেচ্ছুদের মধ্যে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। এক লাফে হজের খরচ বেড়েছে লাগামহীনভাবে। হজ পালনের জন্য ব্যয়ের এই উল্লম্ফন অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে এবছর হজযাত্রা থেকে নিরুৎসাহিত করে ফেলেছে বলে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।
Advertisement
গত বছর হজে যেতে চার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হতো। এবছর নানা খরচ দেখিয়ে সেটা বেড়ে হয়েছে প্রায় সাত লক্ষ টাকা। অনেকে মধ্যবিত্ত ঈমানদার মুসলমান বহুদিন যাবত চার-পাঁচ লাখ টাকা যোগাড় করেও ব্যয়ের বিশাল বহর দেখে এবছর হজের নিয়ত বাতিল করেছেন। তাঁদের জন্য বিষয়টি খুবই পীড়াদায়ক।
কাড়ি কাড়ি টাকার মালিক হলেই সবার জীবনে হজে যাবার সুযোগ হয় না। অনেক বিত্তশালী আছেন যারা শুধু অর্থ জমিয়ে রাখেন এবং ভাবেন এখনো সময় হয়নি, আমি আরো বুড়ো হয়ে নিই তারপর হজে যাব। তারা এভাবে ভ্রান্ত ধারণায় নিজেকে হজ্জ থেকে বিরত রাখেন।
এভাবে সারা জীবন পার হয়ে গেলেও অনেকের পবিত্র হজ পালন করা ভাগ্যে জোটে না। কিন্তু একজন সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য জীবনে একবার হজব্রত পালন করা ফরজ। অনেকে হজের উসিলায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) পবিত্র রওজা শরীফ একবার জিয়ারত করার বাসনা পোষণ করে বহু কষ্ট করে টাকা জমিয়ে হজের নিয়ত করেন। আমাদের দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাচ্চা মুসলমানদের মধ্যে এই প্রবণতা দীর্ঘদিনের। কিন্তু এবছর অনেকের সেই পবিত্র আশায় ছেদ পড়তে শুরু করেছে।
Advertisement
এবছর আগামী ২৮ জুন থেকে পবিত্র হজ পালন করা হবে। করোনার কারণে গত কয়েক বছর হজে যাত্রায় বিঘ্ন ঘটেছে। আমাদের দেশের জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষ হজের কোটার সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। এবছর ১ লক্ষ ২৭ হাজার ১৯৭ জন হজযাত্রী যাবার পূর্ণ কোটা পেয়েছি আমরা। সে হিসেবে এবছর হজের নিয়্যত করে প্রাক নিবন্ধনকরীর সংখ্যা বেড়ে যাবার কথা। কিন্তু প্রথম দফায় প্রাক্ নিবন্ধনকরীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১ হাজার ৫৯১ জন। যা মোট কোটার মাত্র ২৭%। অর্থ্যাৎ নিবন্ধনকারীর জন্য এখনও ৭৩% খালি পড়ে আছে।
দ্বিতীয় দফায় নিবন্ধনের জন্য সময় বাড়ানো হয়েছে। বহু ধর্মপ্রাণ মুসলমান হজে যেতে চান। কিন্তু সাত লক্ষাধিক টাকা খরচ করে হজে যাবার সামর্থ্য নেই বহু আকাঙ্খী প্রার্থীর। বাড়তি অর্থ যোগাড় করতে না পেরে অনেক মধ্যবিত্ত এবছর আশা ছেড়ে দিয়েছেন।
অন্যদিকে আর্থিক কারণে প্রাক্ নিবন্ধন বাতিলের হিড়িক পড়েছে বলে জানা যাচ্ছে। আগের বছরগুলোর মতো এবছর হজগমনেচ্ছুরা ততট ব্যস্ত নন। হজ এজেন্সিগুলোও অলস সময় পার করে হতাশায় ভুগছেন।
ট্রাভেল এজেন্সিগুলো বলছেন, হজের খরচটা বাড়তি বিমান ভাড়ার কারণে অনেকে সামর্থ্যের বাইরে চলে গেছে। হজ করার ইচ্ছের মধ্যে বাধ সেধেছে অতিরিক্ত খরচ। প্রতিবছর সরকারী খরচে প্রায় বিরাট বহর হজে যেতেন। এবছর সেখানে অনেকটা কড়াকড়ি আরোপ করায় সেখানেও গতি কমেছে। অর্থ্যাৎ, পবিত্র হজ পালনের মতো বড় ধর্মীয় কাজে দূরদর্শীহীনতা এবার চরম গতিহীনতা সৃষ্টি করেছে এবং এই সেক্টরে হতাশার সুর ছড়িয়ে দিয়েছে।
Advertisement
বলা যায় হঠাৎ করেই গত বছরের তুলনায় এবছর হজের খরচের সঙ্গে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে প্রায় দুই লক্ষ টাকা। ওমরাহ করার খরচ বেড়েছে এক লক্ষ টাকা। অথচ, ট্যুরিস্ট ভিসায় সৌদিতে যেতে বিমান ভাড়া মাত্র ৬০-৭০ হাজার টাকা। পবিত্র হজ ও ওমরাহ পালনের জন্য বিমান ভাড়ায় এত বৈষম্য কেন তৈরি করা হয়েছে তা সবাইকে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি করে তুলেছে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, বিমান ভাড়ার এই বৈষম্য বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় কাজে যাবার ক্ষেত্রে চরম অসহযোগিতা ও আত্মিক শান্তি সংকোচন নীতি গ্রহণের নামান্তর।
আকাশপথে মাইলেজের হিসাব করলে সৌদি ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে ভাড়ার পরিমাণ বেশি। আকাশপথে বেশি খরচের কথা চিন্তা করে সমুদ্রপথে হজযাত্রার কথা ভাবা হলেও সেটা এবছর মোটেও সম্ভব নয় বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের নিজস্ব বিমানের ভাড়া বাড়ানোর ফলে ঢাকা টু জেদ্দা সৌদি এয়ারলাইন্সের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে।
ফলে সৌদি এয়ারলাইন্স অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া পেয়ে লাভবান হচ্ছে। অথচ এ বছর বাংলাদেশ বিমানের লাভের আশায় হজ যাত্রীদেরে ভাড়া বাড়ানো হলেও মূলত দেশের টাকা সৌদি এয়ারলাইন্সের হাতে চলে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া,পাকিস্তান প্রভৃতি দেশের সরকার হজের জন্য বড় অংকের ভর্তুকি দিয়ে থাকে। অথচ আমাদের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে হজ খরচের জন্য সরকারি ভর্তুকি নেই।
আমাদের দেশে চারদিকে মূল্যস্ফীতির প্রভাব হজকেও আক্রান্ত করে তুলবে এটা মোটেও কাম্য ছিল না। করোনা সংক্রমণ ও যুদ্ধের কথা বলে বলে ব্যবসায়ীদেরকে মাথায় তুলে রাখা হয়েছে। এসব কথা বলে ক্রমাগতভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতাকে বল্গাহীন করে তোলা হয়েছে। যা এখন কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর বিদ্যুতের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে আরো দুর্বিষহ করে তুলেছে। মানুষের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে সকল ঈমানদার মুসলমান অতিকষ্টে সঞ্চিত অর্থ দিয়েও এবছর হজে যাবার সামর্থ্য হারিয়ে মনোকষ্ট পাচ্ছেন এবং আগামী বছর যাবার জন্য সান্ত্বনা খুঁজছেন তাদের জন্য এখনই ভালো কিছু বলা কঠিন।
কারণ আগামী বছরে হজে যাবার বিশ্ব-পরিবেশ পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক অবস্থা এবছরের মতো অনুকূলে থাকবে কি-না তা বলাই বাহুল্য। সামনে আর কদিন পরই রোজার মাস আসছে। এ সময় খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মূল্যস্ফীতি এবং পাশাপাশি হজের খরচে উল্লম্ফণ একবারেই বেমানান হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। পৃথিবীর সকল দেশে ধর্মীয় কাজে উৎসাহ দিয়ে দ্রব্যমূল্য কমানো হয়।
বাজারে অলিতে-গলিতে শুরু হয় নামমাত্র মূল্যে ‘সেল’দেবার মহোৎসব। অনেক দেশে বিনামূল্যে খাদ্য, ওষুধ, পোশাক বিতরণ করা হয়। আমাদের দেশে এর উল্টো চরিত্রের বহিপ্রকাশ ঘটতে শুরু করে। বিদেশে যে কোনো উৎসবের আগে দাম কমানো হয়, আমাদের দেশে বাড়ানো হয়।
ধর্মীয় উৎসব শুরু হবার বহু আগেই আমাদের লোভী ব্যবসায়ীরা নীতি মুনাফা লাভের মাধ্যমে গণ-শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার নীতি গ্রহণ করেন। এটা খুবই অমানবিক ও লজ্জাজনক ব্যাপার। এক শ্রেণির ব্যবসায়ী ও লুটেরাদের নিকট আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মন-প্রাণ, আশা-ভরসা মূল্যবৃদ্ধির বেড়াজালে বন্দী হয়ে পড়ে। এবছর রোজা ও হজ মৌসুমে এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ভয়ংকর প্রবণতা তাদেরকে লাভের উপর মহালাভ পরিস্থিতি এনে দিয়ে সুপারস্মার্ট বানিয়ে তুলেছে।
সেসব মানুষ লোক দেখানো জৌলুস নিয়ে প্রচারণা করতে ভালোবাসে, যারা অভাবীদের কথা নিয়ে ভাবতে পছন্দ করে না, যারা তিলে তিলে কষ্টার্জিত অর্থে জীবনে একবার হজ ও নবী (সা.) রওজা জিয়ারত করতে আশা পোষণ করে বিফল হয়ে রোনাজারি করে গোপনে অশ্রুপাত করে, যারা আত্মার পরিশুদ্ধি চায় না-তাদের দুষ্টু চক্রের এই জটিল জালকে ছিন্ন করতে কে এগিয়ে আসবে? এভাবে তাদের কারণে ধর্মপ্রাণ মানুষের আত্মিক প্রশান্তি লাভের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে তার প্রতিকার কী?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/এমএস