বিংশ শতাব্দীর পূর্বের হাজার বছরে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মধ্যে কমপক্ষে ৩৩টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এরমধ্যে একটি যুদ্ধ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলেছে ১১৬ বছর, যা ইতিহাসে ‘হানড্রেড ইয়ার্স ওয়ার’ বা শত বছরের যুদ্ধ বলে পরিচিত। এই যুদ্ধ কেবল বন্দুকের যুদ্ধ ছিল না, সামাজিক ও ধর্মীয় সংঘাতও দুই দেশকে অনেক বছর ধরে বৈরি করে রেখেছিল।
Advertisement
ফ্রান্সের প্রোটেস্ট্যান্ট অনুসারিদের মদদ দিত ইংল্যান্ড, আর ইংল্যান্ডের ক্যাথলিকদের পেছনে সমর্থন দিতে ফ্রান্স। অর্থাৎ শত্রুতা তাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল এবং আর তাই বহু রক্ত ঝরেছে দুই জাতির সংঘাতে। কিন্তু এখন যখন আমরা দেখি ফরাসি প্রেসিডেন্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছেন, আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে দুই দেশ একই মত পোষণ করছেন (সাধারণত তাই করে থাকে), তখন ভাবতে হয়, কী করে হাজার বছরের বৈরিতা বন্ধুত্বে রূপ নিল!
ইউরোপ জুড়েই জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ লেগে থাকতো। কিন্তু আজ পশ্চিম ইউরোপের পাশাপাশি অবস্থানকারী দেশগুলো যুদ্ধ ভুলে গিয়ে ইউনিয়ন গড়ে তুলেছে, যেখানে একটি দেশের সঙ্গে আরেকটি দেশের বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতা থাকলেও কোনো জাত্যাভিমানগত সংঘাত নেই। এক দেশের নাগরিক আরেক দেশে অবাধে বিচরণ করছে। এক কথায় মিলে মিশে বসবাস করছে। কী করে সম্ভব হলো? এর প্রধান কারণ হলো, ইউরোপীয়রা অতীতের অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাইতে শিখেছে, অনুতপ্ত হতে শিখেছে। যা পাকিস্তানের মতো দেশের শেখা হয়নি। বরং উল্টোটা হয়েছে।
মার্চ মাস চলছে। ১৯৭১ সালের এই মার্চেই রাজধানী ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্বিচারে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সেই দিনটি থেকেই প্রতিরোধের জন্য, মুক্তিযুদ্ধের জন্য দিকবিদিক ছুটতে শুরু করে বাংলাদেশের ছাত্র-তরুণ সমাজ এবং স্বাধীনতাকামী মানুষ। কিন্তু প্রথমদিকের যুদ্ধটা ছিল কেবলই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একচেটিয়া হত্যা নির্যাতনের সময়। রাস্তায়, নদীতে, সেতুর নিচে শুধু নিরিহ মানুষের লাশ।
Advertisement
এরপর ভারতের সহায়তায় মুক্তিবাহনীরা সংগঠিত হয়, প্রতিরোধ শক্তি বাড়তে থাকে। অবশেষে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ১০-১২ দিনের মাথায় অত্যাচারী, পৃথিবীর অন্যতম নিষ্ঠুর সেনাবাহিনী হিসাবে পরিচিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পন করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, পরাজয়ের মুখে দাঁড়িয়েও পাকিস্তানী সেনারা লুট, ধর্ষণ থেকে নিস্কৃত হয়নি। আমাদের কথা না, হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টেও আছে। এরা এতটাই কামুক প্রকৃতির ছিল যে ১২ ডিসেম্বর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াতুল্লাহ কয়েকটি মেয়েকে তার বাংকারে নিয়ে যায় স্ফুর্তি করতে। অথচ তখন তার সেনাদের উপর শত্রুর গোলা আছড়ে পড়ছে। আর নিয়াজি, খোদাদাদ খান, জেহানজেব আরবাবদের কাহিনী বলে শেষ করা যাবে না। সেটা অন্য একটি লেখায় লিখব।
ইকরাম সেহগাল পাকিস্তানের একজন বিমান বাহিনীর অফিসার ছিলেন। তার পিতা পাঞ্জাবি এবং মা ছিলেন বাঙালি। হুসেইন শহীদ সহরোয়ার্দী ছিলেন তার নানীর চাচাতো ভাই। তিনি ১৯৬৫ সালে এবং ১৯৭১ সালে পাক-ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন এবং বই লেখেন। তিনি লিখেছেন, ‘সৈনিকেরা যখন নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তারা আর সৈনিক থকে না। ফলে তারা বুলেটের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে না, যা তাদের প্রকৃত কাজ। মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত যে ত্রাস তারা পূর্ব পাকিস্তানে করেছে তা ছিল অমার্জনীয়।’
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর থেকে পাকিস্তান উচ্চাকাঙ্খি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করার আশায়। মোশতাক সরকার এই কনফেডারেশনের দিকে যাতে না যায় সেজন্য ভারতের হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। এরপর সার্ক গঠনের সময় হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং পাকিস্তানের জিয়াউল হকের মধ্যেও একটা প্রচেষ্টা ছিল। এমনকি ১৯৯৪ সালে বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের সময় পাকিস্তানের সঙ্গে এমন একটি সম্ভাবনার বিবেচনা চলছিল যে পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ হলে পাকিস্তান ঢাকা বিমানঘাঁটি ব্যবহার করবে।
এ সম্ভাবনা নিয়ে ইসলামাবাদের ইনিস্টিটউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এ যে আলোচনা হয় সেখানে ইকরাম সেহগাল উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু এই পাকিস্তান কখনো মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইবার কথা চিন্তাও করেনি। উল্টো ২০১৬ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিশেষ আদালত মীর কাশিম আলী, কাদের মোল্লাদের মৃত্যুদণ্ড দিলে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট তার তীব্র নিন্দা জানায়! এরপর
Advertisement
বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাধারণ সম্পর্কও তিক্ত হয়ে উঠতে থাকে। ২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও কার্যত দুই দেশের মধ্যে সাধারণ ভিসা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও পাকিস্তানের বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার যে প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে তা মূলত ভারত বিরোধী একটি সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘকালীন বড় সমস্যাগুলো সমাধান হয়েছে। এখনো যে ছোটখাটো দু-তিনটি সমস্যা রয়েছে সেই ছিদ্র দিয়ে পাকিস্তান বারবার ঢুকতে চেষ্টা করছে। ২০১৯ সালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী টেলিফোন করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের ব্যাপারে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন। তারা মনে করেন, বাংলাদেশের ৩৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে একটি অসন্তোষ রয়েছে।
২০২০ সালের ২২ জুলাই পাকিস্তানের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় দুই দেশের ভাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতি জোর দেন। এতসব চেষ্টা করলেও পাকিস্তান বাংলাদেশের দীর্ঘকালের দাবি ১৯৭১ সালের যুদ্ধে অপরাধের ব্যাপারে ক্ষমা না চাওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান নিয়েই আছে। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সব সরকারই একই মানসিকতা বহন করে।
বরং তারা এখনো পাকিস্তানের জনগণকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে ওই যুদ্ধের জন্য মুক্তিকামী বাঙালিরাই দায়ী, ভারতের প্ররোচনায় তারা পাকিস্তানকে ভেঙে দিয়েছে। পাকিস্তানের টেক্সটবুক, জাদুঘর থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অঙ্গণে যে শিক্ষা দেওয়া হয় সেখানে পরিষ্কার যুদ্ধের জন্য বাঙালিদের দায়ী করা হচ্ছে এবং এই যুদ্ধ ভারতের উস্কানিতে হয়েছে বলে নতুন প্রজন্মকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
২০২১ সালে পাকিস্তানে একটি ড্রামা ফিল্ম মুক্তি দেওয়া হয়েছে যার নাম ‘খেল খেল মে’। সেই ছবিতে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে যুদ্ধের পূর্বে অবাঙালিদের উপর নির্যাতন, হত্যা চালানো হয়েছে এবং সেই হত্যাকাণ্ড করেছে হিন্দুস্তান থেকে আসা সেনারা। এই অপপ্রচারের কোনো মানে হয়? অপপ্রচারও সথ্যের কাছাকাছি থাকতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বড় ছিলেন, অথবা বোঝার বয়স হয়েছে তারা জানেন, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে সরাসরি পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্বে একটি ভারতীয় বাহিনী তো দূরের কথা, একজন ভারতীয় সশস্ত্র নাগরিককেও কেউ দেখেননি। সেখানে ঘরে ঘরে ঢুকে হিন্দুস্তানিদের হত্যা করার এই আসমানি গল্প পাকিস্তানের কৌতুকাভিনেতা রঙ্গলার অভিনয়কেও হার মানায়।
শুধু পাকিস্তান নয়, এদেশের পাকিস্তানি দোসররাও আজ অবধি তাদের কৃতকর্মের জন্য সামান্য অনুতাপ প্রকাশ করেনি। বরং বিগত ৫০ বছরে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে এদেশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে বারবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। সুতরাং ক্ষমা তো আর কাউকে ঘরে দিয়ে আসা যায় না! ক্ষমা পেতে হলে নিজেদেরকেও শুধরে নিতে হয়!
লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।mohshin266@gmail.com
এইচআর/জেআইএম